ঢাকা, শুক্রবার, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ০৫ জুলাই ২০২৪, ২৭ জিলহজ ১৪৪৫

জাতীয়

একসঙ্গে এনজিও প্রতিষ্ঠা, খুন করে ছদ্মবেশে ৬ বছর! 

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২২
একসঙ্গে এনজিও প্রতিষ্ঠা, খুন করে ছদ্মবেশে ৬ বছর! 

ঢাকা: ২০০১ সালে আশুলিয়ার একটি গার্মেন্টসে চাকরির সুবাদে শহিদুল ইসলাম ও শাহিন আলমের (৩৮) মাঝে সখ্যতা গড়ে ওঠে। পরিচয় সূত্রে শাহিন একটি এনজিও প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন শহিদুলকে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী গত ২০০৪ সাল থেকে প্রাথমিকভাবে ঢাকা জেলার ধামরাই থানাধীন গোয়াড়ীপাড়ায় একটি অফিস ভাড়া নিয়ে ‘বাংলা সমাজ উন্নয়ন সংস্থা’ নামে একটি সঞ্চয় ও ক্ষুদ্র ঋণদান সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন তারা। এতে শহিদুল বেশ কিছু অর্থ ঋণ দিয়ে দেন।  

পরে ২০০৫ সালে তারা গার্মেন্টেসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এনজিও কার্যক্রমে পুরো মনোনিবেশ করেন। এনজিওতে তারা দুজনেই সমান অংশীদার ছিলেন। এনজিও প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তারা ২ জন নারী কর্মী নিয়োগ দিয়ে ধামরাই এলাকায় ৪টি প্রোগ্রামে ৪৫০ জন সদস্য সংগ্রহ করেন। এরপর সঞ্চয়, ঋণদান এবং ফিক্সড ডিপোজিট কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন। ঘটনার সময় পর্যন্ত এনজিওটি আনুমানিক ৯ থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ দিয়েছিলো।  

শাহিন ও শহিদুল সমান অংশীদার থাকলেও শহিদুল এনজিওটির কর্মচারী এবং সদস্যদের কাছে তার কর্মদক্ষতা ও ভালো ব্যবহারের জন্য খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তাদের প্রতিষ্ঠিত এনজিও ব্যবসায় লাভের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বাড়ছিল। একসময় তাদের একাউন্টে সদস্যদের সঞ্চয়ের বেশকিছু টাকা জমা হয়।  

এতে শাহিনের লোভ জন্মায় এবং শহিদুলের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে এনজিওর সব লভ্যাংশ নিজের করে নেওয়ার জন্য মনে মনে ফন্দি আঁটেন।  

একপর্যায়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে শাহীন এনজিওর মালিকানা নিজের করে নেওয়ার জন্য শহিদুলকে প্রস্তাব দিলেও তিনি রাজি হননি। তাই শহিদুলকে হত্যার জন্য শাহিন তার মামাতো ভাই টাঙ্গাইলের সন্ত্রাসী রাজা মিয়াকে নিয়ে হত্যার ছক আঁকেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী শহিদুলকে হত্যা করেন শাহিন আলম।  

মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক।  

তিনি বলেন, ‘মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার চাঞ্চল্যকর শহিদুল ইসলামকে নৃশংসভাবে গলাকেটে হত্যা মামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মো. শাহিন আলমকে (৩৮) মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর থানা এলাকা থেকে আটক করা হয়। গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাতে হত্যা মামলার প্রধান আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। সে দীর্ঘ ৬ বছর বিভিন্ন ছদ্মবেশে পলাতক ছিল৷’

তিনি জানান, ‘ঘটনার দিন আনুমানিক সন্ধ্যা ৭টার দিকে ধামরাইয়ের ঢুলিভিটা নামক স্থানে সন্ত্রাসী রাজা মিয়া একটি মাইক্রোবাস নিয়ে অপর আসামি সাহেদ, কুদ্দুস, বিষ্ণু সুইপার এবং ড্রাইভার রহম আলীসহ আসে। এরপর আসামি শাহিন ভুক্তভোগী শহিদুলকে তার মামাতো ভাই আসছে বলে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য ঢুলিভিটায় মাইক্রোবাসের কাছে নিয়ে যায়। ভুক্তভোগী সেখানে গেলে আসামি রাজা মিয়া তাদের সঙ্গে পাত্রী দেখতে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। রাত হয়ে যাওয়ায় ভুক্তভোগী রাজী না হলে আসামিরা তাকে তার বাসায় নামিয়ে দিয়ে তারা পাত্রী দেখতে যাবে বলে জানায়। তখন ভুক্তভোগী সরল বিশ্বাসে রাজী হয়ে মাইক্রোবাসে ওঠে। মাইক্রোবাস কিছুদুর যাওয়ার পর আগে থেকে মাইক্রোবাসের ভেতর রাখা রশি দিয়ে আসামি বিষ্ণু ভুক্তভোগীর গলা পেঁচিয়ে, আসামি রাজা রুমাল দিয়ে মুখ চেপে, আসামি শাহীন ও কুদ্দুস কাধ চেপে এবং আসামি সাহেদ পা চেপে ধরে শ্বাসরোধ করে নির্মমভাবে হত্যা করে। ’

হত্যার আলামত লোপাট ও মরদেহ গুম:
র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক জানান, শহিদুলের দেহ নিথর হয়ে গেলে আসামিরা মরদেহ গুম করে আলামত লোপাট করার পরিকল্পনা করে। তারা কালামপুর, সাটুরিয়া হয়ে নির্জনস্থান বেতুলিয়া ব্রিজের ঢালে ভুক্তভোগীর নিথর দেহ নিয়ে মাইক্রোবাসটি থামায়। আসামি শাহীন আলম ও রাজা মিয়া মাইক্রোবাস থেকে নেমে শহিদুলের মরদেহটি ব্রিজের নিচে নিয়ে যায়। সেখানে আসামি রাজার হাতে থাকা ধারালো অস্ত্র নিয়ে শাহীন ভুক্তভোগীর মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর জবাই করে ভুক্তভোগীর দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে খন্ডিত অংশ ফেলে দেয়। তারা খন্ডিত মস্তক হাতে থাকা পলিথিন ব্যাগে মুড়ে পূনরায় মাইক্রোবাসে করে নাগরপুরের দিকে রওনা হয়। নাগরপুরের জগতলা নামক স্থানে মাইক্রোবাস থামিয়ে রাজা ও শাহিন ভুক্তভোগীর খন্ডিত মস্তক খালের পাড়ে কাদামাটিতে পুতে রেখে টাঙ্গাইলের দিকে রওনা হয়।  

হত্যার আলামত গোপন ও এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডটি ধামাচাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আসামিরা নম্বরবিহীন মাইক্রোবাস ভাড়া করে নিয়ে আসে এবং হত্যাকাণ্ডের পরপরই মাইক্রোবাসটি বিক্রি করে দেয় বলেও জানান র‌্যাবের এই কর্মকর্তা।  

তিনি আরও জানান, ২০০৬ সালের ২১ মে সকালে স্থানীয়রা চেয়ারম্যানের মাধ্যমে সাটুরিয়া থানা পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে মস্তকবিহীন মরদেহ উদ্ধারের পর সুরতহাল প্রতিবেদন করে। ওই দিনই থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।

যেভাবে ঘটনার রহস্য উদঘাটন:
২০০৬ সালের ২৩ মে ভুক্তভোগীর ভাই সাইফুল ইসলাম ধামরাই থানায় নিখোঁজ জিডি তালিকাভুক্ত করতে যান। তখন ধামরাই থানা পুলিশ জানায় যে, সাটুরিয়া থানা এলাকায় একটি মস্তকবিহীন যুবকের অজ্ঞাতনামা মরদেহ এবং নাগরপুর থানা এলাকায় খন্ডিত মস্তক পাওয়া গেছে। তখন শহিদুলের ভাই মরদেহ শনাক্ত করে।  

র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক বলেন, তদন্তে নেমে পুলিশ শাহীনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এক পর্যায় শাহীন ভুক্তভোগীকে হত্যার ঘটনা স্বীকার করে এবং আদালতে ফৌজদারী কার্য বিধির ১৬৪ ধারা অনুযায়ী অন্যান্য আসামিদের নাম উল্লেখ করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।  

আসামি শাহীন আলম ১০ বছর হাজত খেটে ২০১৬ সালে জামিন নিয়ে আত্মগোপনে চলে যায় এবং এই মামলায় আর কখনো হাজিরা দেয়নি। মামলাটি তদন্ত করে তদন্ত কর্মকর্তা দীর্ঘ সময় মামলার নথিপত্র পর্যালোচনা এবং সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আদালতে গ্রেফতার ২ আসামি শাহিন আলম ও সাহেদ এবং পলাতক আসামি রাজা মিয়া, আ. কুদ্দুস, বিষ্ণু সুইপার, রহম আলী ড্রাইভার ও মাইক্রোবাসের মালিক সেলিমসহ সর্বমোট ৭ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।  আদালত পর্যাপ্ত স্বাক্ষ্য প্রমাণের উপর ভিত্তিতে দীর্ঘ বিচারকার্য পরিচালনা করে গত ২০২১ সালের ১ ডিসেম্বর আসামি মো. শাহিন আলমকে মৃত্যুদণ্ড, আসামি সাহেদ, রাজা মিয়া, আব্দুল কুদ্দুস ও বিষ্ণু সুইপারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।  

আত্মগোপনে থাকাকালীন আসামি শাহীনের জীবনযাপন:
র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) ডিআইজি মো. মোজাম্মেল হক জানান, আসামির বিরুদ্ধে হত্যা মামলা রুজু এবং ঐ মামলায়  শাহিন আলম মৃত্যুদণ্ড সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় গ্রেফতার এড়ানোর লক্ষ্যে লোক চক্ষুর আড়ালে চলে যায়। পরিচিত লোকজন থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখার জন্য সে বিভিন্ন ছদ্মবেশ ধারণ করে রংপুর, আশুলিয়া, পল্লবী, উত্তরা, টঙ্গীসহ ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে ছিলো। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় আসামি নিজের পরিচয় গোপন করার জন্য ক্রমাগতভাবে পেশা পরিবর্তন করে। প্রথমদিকে সে ফেরিওয়ালা, গার্মেন্টসের অপারেটর, রাজমিস্ত্রী, ইলেক্ট্রিক, স্যানিটারী মিস্ত্রী হিসেবে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল। গ্রেফতার এড়ানোর কৌশল হিসেবে সে বিভিন্ন সময় রংপুর, দিনাজপুর, চাপাইনবাগঞ্জ এলাকায় অবস্থান করেছে। সর্বশেষ পুলিশের কাছে ধরা পরলে তার মৃত্যুদণ্ড  কার্যকর হবে এই ভয়ে পরিবারসহ দেশ ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। সেই উদ্দেশ্যে সে সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর)  রাতে মানিকগঞ্জের ঘিওরে তার স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে আসে।  

র‌্যাব-৪ বিগত বেশ কিছুদিন ধরে তাকে আটকের চেষ্টা করলেও অবশেষে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে একটি চৌকস আভিযানিক দল মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর হতে তাকে আটক করতে সক্ষম হয়।  

কে এই শাহিন আলম: 
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ১৯৭৪ সালে ঢাকা জেলার ধামরাই থানাধীন গোয়াড়ীপাড়া এলাকায় আসামি শাহিনের জন্ম। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। আসামি ২০০১ সালে স্থানীয় একটি স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করে স্থানীয় একটি এনজিওতে চাকরি করতো। এনজিওর চাকরি বাদ দিয়ে গার্মেন্টেসে কাজ শুরু করলেও পরবর্তীতে ভিকটিমের সঙ্গে মিলে নিজেরাই এনজিও প্রতিষ্ঠা করে। ব্যক্তিগত জীবনে আসামি বিবাহিত, তার কোনো সন্তানাদি নেই।

আটক আসামিকে সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন আছে বলেও জানায় র‌্যাব।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২২
এসজেএ/এসএ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।