বাবা তুমি ক্যামন আছো?
তোমায় মনে পড়ছে খুব! রাত পোহালেই মনে পড়ে,
ভোরের মিষ্টি হাওয়ায় শিশির ভেজা ঘাসের ’পরে তোমার হাত ধরে
মর্নিং ওয়াকে আমি শহরময় ক্যামন ঘুরে বেড়াতাম ছেলেবেলায়।
ক্লান্ত শরীরে অফিস ফেরত এই তুমি ঘরে ফিরেই
ডাকবাংলো বাড়ির উঠোনে বসতে বেতের সোফা পেতে।
বাগানে হাস্নাহেনা, রজনীগন্ধা গাছের নিচে হারমোনিয়ামে রেওয়াজ,
আবৃত্তি, ক্লাসিক্যাল গান আর ওয়ার্ড মেকিং খেলায় আমায় ক্যামন মাতিয়ে রাখতে!
মনে পড়ে বাবা? ছুটির দিনে সাঁতার শেখাতে বাংলোবাড়ির শানবাঁধানো পুকুর ঘাটে
আমায় নিয়ে তোমার সেই ডুব সাতার খেলা! পটুয়াখালীর বাংলোবাড়ির পেছন লেকে
শ্যাওলা জলে ভাসতে ভাসতে রান্না-বাটি, পুতুল বিয়ে কত্তোদিন খেলেছি!
ছুটির বিকেলে সন্তানের বায়না মেটাতে সেই ইঞ্জিন নষ্ট স্পিডবোটে
বৈঠা হাতে তুমিই আমার মাঝি হতে!
মনে পড়ে! স্বাধীনতা দিবস, ভাষা দিবস, বিজয় দিবস, আর শিশু একাডেমিতে
গান, আবৃত্তি, ডিবেট কম্পিটিশানের ফার্স্ট প্রাইজটি নিয়ে আমি ঘরে ফিরতেই সেকি তোমার আনন্দ!
রোভার স্কাউড, বিএনসিসি, স্টেডিয়ামের সেই মার্চ পাস্টে আমার লিডারশিপকে সফল করতে
কনকনে শীতের ভোরে তুমিই আমার সঙ্গে যেতে! মনে পড়ে বাবা?
সাদা ফিতেয় বেণী বেধে দিয়ে ন’বছরের ছোট্ট শিশু
এই আমাকে কোলে নিয়ে গাইতে তুমি হেমন্তের গান ‘আয় খুকু আয়!’
মনে পড়ে বাবা?
বাবার সঙ্গপাগল নাছোড়বান্দা এই আমি স্কুল পালিয়ে ছুটে যেতাম তোমার প্রেসে,
‘লেটার প্রেস’ পদ্ধতিতে তখন পত্রিকা ছাপা হতো, পটুয়াখালীতে ‘পায়রা’ পত্রিকার সম্পাদক তুমি;
পত্রিকার প্রুফ, মেকাপ, গেটাপ সব ঠিক ঠাক, মুদ্রণের এমন আগমুহূর্তেই
‘লেটার প্রেস’ এলোমেলো করে পুরো হাউজ তোলপাড় করতাম!
শব্দার্থ জানতে চাইলে বরাবরই তুমি বলতে, ডিকশনারি দ্যাখো!
উত্তরে আমি বলতাম, তুমিই তো আমার জীবনে বড় ডিকশনারি
একেকটি অক্ষর জড়ো করে বাবা; তুমিই শেখালে আমায় কবিতা লেখা।
আজকাল একা হলেই বাবা স্মৃতির পাতায় তোমায় হাতরে ফিরি!
বুকের গুমোট ব্যথা অষ্টপ্রহর গ্রাস করে আমার কণ্ঠনালী!
তবু, আকণ্ঠ করি পান তোমার সেই অমৃত নির্দেশ: বাইরে নয়, ভেতরে আমি যেন সুন্দর হই!
চাকচিক্য নয়, আমার অলঙ্কার যেন হয় স্বল্প কথা,
ঔদ্ধত্য নয়, বিনয় আর মাহাত্ম্য যেন হয় আমার সৌন্দর্য
আশৈশব এসবে বেড়ে ওঠা চেতন-মনন মাঝে মধ্যেই আমাকে বিট্রে করে।
কী হবে এত ভালোয়? সব ভালোইতো আজকাল অসুস্থতা!
কেন শেখালে আমায় ধর্ম ভীরু নয়, খোদাভীরু হও
চারিদিকে একি দেখছি আমি? ধর্মের নামে অধর্মের যুদ্ধ, জাতিতে যুদ্ধ, নীতিতে যুদ্ধ; যুদ্ধ রাজনীতিতেও!
অনিয়ম আর লেবাসের বিষাক্ত বাতাসে এখানে সত্য হয় মিথ্যে, মিথ্যে হয় সত্য
অন্তরে বাইরে চারিদিকে কেবলই দেখি ছন্দপতন!
ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃতির ঘাড় চেপে বসে আছে ফিউশন নামক যে সন্ত্রাস
তা এখন মানুষের মূল্যবোধেরও টুটি চেপে ধরেছে; আক্রান্ত পুরো সমাজ!
কাজে নয়, এখানে তেল আর চাপাবাজিতেই বড় হয় অযোগ্য আর দুর্বৃত্তদের কেউ কেউ।
তোমার সেই অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে বাবা,
‘ঘুষ না খেলেও উর্ধ্বতন বসকে ঘুষ দিতে হবে’ বসের এমন সিদ্ধান্তে কোলকাতায়
বসের মুখের সামনেই রেজিগনেশন লেটার দিয়ে তুমি বলেছিলে ‘এই নিন আপনার ঘুষ!’
তুমি তখন রয়েল ইন্ডিয়ান নেভির কমিউনিকেশন অফিসার
এমন সাহসী সরকারি কর্মকর্তা, একইসঙ্গে বাংলা সাংবাদিকতার গোড়ার দিকে ‘আজাদ’, ’ইত্তেহাদ’
আর ‘নবযুগ’ এর মতো দৈনিকে তোমার নির্লোভী সাংবাদিকতা! এই প্রজন্মের কাছে খেলো গল্প এখন!
বাবার মঙ্গলালোকে নিজেকে স্নান করিয়ে যে পেশা সাংবাদিকতাকে বেছে নিলাম
সত্যের অপলাপে ভেস্তে গেছে সেইকালের সাংবাদিকতা!
ফাঙ্গাস পড়েছে এখন জাতির বিবেকের আম সত্তায়;
বিবেক নামক শব্দটিকে জাদুঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে
‘জাতির বিবেক’ সাইনবোর্ডধারী কতক নির্লজ্জ সাংবাদিক;
ওদের কাছে সাংবাদিকতা মানেই ‘কি যেন হনুরে!’
সততা শব্দের আব্রু খুলে দিয়ে সাংবাদিকতা পেশাকে
ওরা ন্যাংটা করে ছেড়ে দিয়েছে খোলা আকাশের নিচে!
জীবিকার প্রয়োজনে ভাসমান যৌনকর্মীরা যেমন
একইসঙ্গে চালায় টাকা আর জৈবিকতার লেন-দেন!!
গেলো দশ বছরের সাংবাদিকতা পেশায় ওদের জন্য চাদর বিছাতে পারিনি
আমার বিবেকের জমিনে!
তাই এত আমার অপারঙ্গমতা!
ওরা আমায় বলে, আমি ব্যাকডেটেড!
অথর্ব এই আমি নীরবেই হাসি! আর,
কিছুই পারি না কিছুই জানি না এমন অপবাদের সবটুকুনই
মাথায় করে বয়ে চলছি বিনয়ের সৌহার্দ্যে!
কারণ আমি জানি, মূল্যায়নের আগে নিজের মূল্যবান হওয়া চাই
আমি এও জানি, ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধে পাপিষ্ট এ কতক নামধারী সাংবাদিকের চেয়ারের অযোগ্যতা।
বাবা! বিনষ্টির এত্তোসব জন্ম সয়ে বড্ড টায়ার্ড আমি!
তোমার পবিত্র করতল আমার মাথায় রাখো বাবা!
আমায় সিক্ত করো তোমার আশীর্বাদের অমিয় আলোকে
আমৃত্যু আমার বটবৃক্ষ এই তুমি আমায় শান্ত করো বাবা!
শৈশবের মতো তোমার আলোক শিখা ছড়িয়ে দাও আমার সৃজনে, মননে, আমার অন্তরে!
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৫ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৪