ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

উপন্যাস

মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ১)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৬
মধ্যবিত্ত | কিঙ্কর আহ্‌সান (পর্ব- ১)

১.
কান্না, জল একটু ছাই,
সময় নিয়ে তাই পোড়াই।

মা জানেন তিনি আজ মারা যাবেন।


কলকাতায় প্রচণ্ড গরম। রাস্তার বাইরে দাঁড়িয়ে লেবুর শরবত খাচ্ছি।  
ফুচকা খেয়েছিলাম একটু আগে। এক রুপিতে দু’টো ফুচকা।  
ফুচকার ভেতরে তেতুল আর মরিচের তৈরি বিশেষ রস। খুব ঝাল হলে হাতে তৈরি আলুর চিপসে ছোট্ট একটু কামড়। নেশা ধরে যায়। পেট ভরার জন্য দুপুর বেলা গোটা পনের ফুচকা খেলেই হলো।
এদিকে, কম দামে ভালো ভালো খাবার পাওয়া যায়। রাস্তার পাশে ভ্রাম্যমাণ দোকান তুলে বসে যায় ব্যবসায়ীরা। আমার জন্য সুবিধা। স্বাস্থ্য নিয়ে টেনশন নেই। ফিটফাট আছি। ওলট-পালট খেলেও পেট ঠিক! 
গত কয়েকটা দিন এসব খেয়েও সুস্থ আছি খুব। সকাল হলেই ডিম ভুনা, গরম ভাত। যে হোটেলে থাকি সেখানকার রসুইঘরে সবকিছুই ঝাল ঝাল রান্না হয়। ঝাল খেতে পারি না।  
আম খুব সস্তা এদিকে। কেজি মাত্র ত্রিশ রুপি। বারো মাসই এমন। দামে ওঠানামা নেই।  
আম কিনে আনি। ঝাল এড়াতে আম দিয়ে ভাত খাই। দু’টো আম ভাত দিয়ে মাখিয়ে খাবার পর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। হাসপাতালে যাওয়ার পথেই মাটির ঘটিতে গরম গরম দুধ চা। একদম ফ্রেশ।  
কখনও অবশ্য থামস্ আপও খাওয়া হয়। ক্লোল্ড ড্রিংকস। একটু ভাব নিয়ে চুমুক! 



দেশ ছাড়ার পর খাওয়ার ধরন বদলেছে। সঙ্গে আসা বাবা, বড় মামা আর ছোট বোন রুবি বিপদে পড়লেও আমি মানিয়ে নিয়েছি। এই অবস্থায় আবদার চলে না। মায়ের অসুস্থতার সময়ে মানিয়ে নিতেই হবে! 
অপারেশন আজ। হুড়মুড়িয়ে গরম বাতাস আসছে। আমার ক্ষিধে কমে না। টেনশন হলেই পেট খালি হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকে অভ্যাস। বড় মামার চোখ রাঙানি এড়িয়ে ঝালমুড়ি নেই দশ রুপির। ঝালমুড়িটা ভালো করে। অনেক পেয়াজ আর নারকেল দিয়ে বানায়। মুড়ির সঙ্গে মাখানো ঝোলের টেস্টটাই অন্যরকম। মুড়ি খেতে খেতে যখন মুখের ভেতর ছোট ছোট সেদ্ধ, মিষ্টি আলুর টুকরা পড়ে তখন আরামে চোখ বুজে আসে।  
ঝালমুড়ি মুখে দিয়েই আমি চোখ বন্ধ করে থাকি। অন্যকিছু নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করে না। মায়ের অপারেশন নিয়ে টেনশন করতে ইচ্ছে করে না। খাবার নিয়ে ভেবে অন্য সবকিছু ভুলে যেতে চাই।
‘তোর মা মনে হয় আর পারলো না থাকতে। ’ কথাটা বলেই বাবা ফুঁপিয়ে কাঁদে।  
আমি বাবার কান্না দেখি। এই লোক সচরাচর কাঁদে না। বয়স্ক একটা মানুষের কান্না দেখতে ভালো লাগে না।  
‘দুলাভাই কাঁদবেন না তো। দোয়া করেন। কাজে লাগবে। ’ শুকনো গলায় বলে মামা। মন তারও ভালো নেই। আমুদে লোকটা শোকে-ভয়ে ফাঁপা বেলুনের মতোন চুপসে আছে।  
ডাক্তার বলেছেন, বিষয়টা আর তাদের হাতে নেই। সাধ্যমতোন চেষ্টা করবেন বাকিটা ভাগ্যের ওপর।  
অপারেশন হবে একটু পর। বারো ঘণ্টার মেজর অপারেশন।  
আমার ছোটবোন রুবির জন্মের পর থেকেই মা অসুস্থ। অলুক্ষণে রুবি। কষ্টের শেষ নেই মায়ের। মুখ থেকে দমক দমক রক্ত বের হয়। জ্বর-কাঁশি প্রতিদিনের গল্প। রোগ ধরা পড়ে না।
দেশের ডাক্তার বাদ যায়নি কোনো। দেশে কেউ বলে টিবি আবার কেউ বলে ব্রঙ্কাইটিস। পীর, ফকির সবার কাছে ছোটা হয়েছে। উপকার নেই কোনো।  
অবস্থা যখন খুব খারাপ তখন আসতে হলো ভারতে। কোনো নোটিশ ছাড়াই হুট করে। হাসপাতালে ভর্তির পরপরই ডাক্তার বিশ্বজিৎ জানালেন, অবস্থা ভালো না। অপারেশন লাগবে। শেষ চেষ্টা। ঠিক হবার চান্স কম।  
অপারেশনের জন্য রাজি হওয়া ছাড়া উপায় নেই। বাবা রাজি হলেন। পরিবারের সবাইকে রাজি হতে হলো।  
শুধু মা বললেন, ‘আমি অপারেশন করবো না। আমাকে তোরা মারিস না। দেশে নিয়ে যা। আমি সুস্থ হয়ে যাবো দেখিস। ’
অসুস্থ কারও কথা আমলে নিতে নেই। আমরাও নেইনি।


অপারেশন হবে কিছুক্ষণ পরেই। মনমরা সবাই। মনে হয় আমার মায়ের আজ শেষ দিন। এই কলকাতা শহরে মারা যাবে আমার মা। ভালো লাগে না। এসব ছাইপাশ, কষ্ট নিয়ে পড়ে থাকতে ভালো লাগে না।  
অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে চাই। এই মাটির পৃথিবীতে দুনিয়ার সব কষ্ট একা নিতে চাই না।
রাগে দুঃখে গোগ্রাসে ঝালমুড়ি গিলতে থাকি। পুরো কলকাতা গিলে ফেলতে ইচ্ছা করে। আই হেইট কলকাতা।



এই মুহূর্তে দেশের কথা ভাবতে চাই। প্রিয় দেশের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে ভালোবাসার বাড়িটার কথা।  
বরিশালে আমাদের ছোট্ট একটা বাড়ি আছে। মধ্যবিত্তের মাথা গোঁজার ঠাঁই। বাড়ির খয়েরি গেটটা সবসময় শরীরে কাগজি ফুল আর লতা-পাতা পেঁচিয়ে পেটফোলা অজগরের মতোন ঝিমায়।  
বাড়ির নাম ‘আপন ভিলা’। চুপচাপ, শুনশান। গোরস্থান রোড থেকে বের হয়ে কাঁচা ইটের রাস্তা ধরে ত্রিশ-পয়ত্রিশ গজ হেঁটে আসলেই সবার আগে খয়েরি গেটটা চোখে পড়বে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বাড়ি।  
ঝা চকচকে উঠোন দেখে তাজ্জব বনে যেতে হয়। পরিষ্কার রাখার জোর চেষ্টা! 
আমার মায়ের শুচিবায়ু আছে। অপরিষ্কার কোনোকিছু সে সহ্য করতে পারে না। সবকিছু ঝকঝকে তকতকে থাকা চাই। মায়ের কারণে আমরা ভাই-বোন আর বাবাও নোংরা কোনো কিছু পছন্দ করি না।
করার উপায় নেই। কারণ, মাকে ভয় পাই। খুব বেশি ভালোবাসি বলেই হয়তো এই ভয় পাওয়া!   
মা বলেছিলো, টাকা-পয়সা একটু জমলে ঈদের পরেই পুরো উঠোনটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধাবে বাবা। ভেতরে বসার জন্য ছোট ছোট টুলও থাকবে। তখন দেখতে জমাটি হবে। কিন্তু সেটি হবার জো নেই আর। মায়ের চিকিৎসায় বেরিয়ে যাচ্ছে টাকা। ধার-দেনা হয়েছে অনেক।  
টাকা-পয়সার কথা বাদ দিয়ে বাড়ির কথায় আসি। ভেতরটা একদম সাজানো গোছানো, ফিটফাট। গেটে ঢোকার ঠিক পরপরই নিয়ম মেনে সৌন্দর্য বাড়াতে দাঁড়িয়ে গেছে সুপারি, নারকেল, মেহগনি আর গোলাপ, জবা ফুল। রজনীগন্ধা আছে একটা।  
পাম ট্রি গাছের গা ঘেঁষে কতগুলো পাতাবাহারও আছে। কিছু চড়াই, শালিক, কাক এ বাড়ির দিকেই থাকে। একটা মন খারাপ করা শান্ত পুকুর, পাড় ঘেঁষে দাঁড়ানো গাছগুলোর ছায়া বুকে নিয়ে বিষণ্ন গান গেয়ে যায় দিনভর। শ্যাওলায় ভর্তি সিমেন্টর ঘাট। পেট মোটা বিড়াল টুটু প্রতিদিন দুপুরে চুরি করে দুধ খেয়ে পালিয়ে যায় পুকুর পাড়ের পথ ধরে। ভারি লাগে দেখতে তখন বিড়ালের পাগলামি। এ বাড়ির সব সুন্দর। শান্ত সুন্দর!
আমার কলেজ কাছেই। ঘর থেকে বের হলেই ফনিক্স সাইকেলটা সঙ্গে নেই। নগদ তিন হাজার টাকা দিয়ে কেনা সাইকেল। সাইকেলের সামনে একটা অটো লাইট লাগানো আছে। রাতে চলাফেলার জন্য লাগে। মাসে একবার ব্যাটারি বদলালেই হয়। একটা মস্ত তালা আছে। সেটা চাকার সঙ্গে পেঁচিয়ে লাগানো। এদিকে চুরির ভয় আছে। তাই সাবধান! বাইক চালানোর ইচ্ছা থাকলেও বাবা দেয় না। কলেজ ও টিউশানির জন্য সাইকেলটাই ভরসা।  
দেশে প্রতিদিন বিকেলে নিয়ম মেনে বের হই। মন ভালো করা বিকেলে, আকাশের নীল রঙের অতিরিক্ত ঝাপাঝাপি করা বিকেলে যেতে হয় মাহবুবার জন্য। মাহবুবা আমার স্টুডেন্ট। ভালো নাম তানঝি।
প্রাইভেট টিউশানিতে হাত খরচটা উঠে আসে। বাবা হাতখরচ নিয়ে যন্ত্রণা দেয়। তাই অবসরে মাহবুবাকে পড়িয়ে দু’টো আয় করছি।
স্টুডেন্টের বাড়িতে গেলেই প্রতিদিন বাড়ির কাজের লোক ক্ষিতিশ সন্দেশ, মুড়ি আর দুধ চা নিয়ে আসে। খাওয়া শেষ হলেই পড়ানো শুরু। আমি খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করি। অনেক সময় নিয়ে খাই। ভালো লাগে।  
খাওয়ার লোভে মাহবুবার বাসায় যাওয়ার দিনগুলো মিস করি না। সে আমার কাছে ছবি আঁকা শেখে। মাহবুবা সামনে উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। ক্লাসে ছবি আঁকার ঝামেলা নেই। ছোটবেলায় ছিলো। মাহবুবা তবুও ছবি আঁকতে চায়। শিখতে চায়। নিজের বাবার কাছে ছোট্ট আবদার তার এই।  
বাবার এই ঢং পছন্দ না। সে বলে, ‘ছবি আঁকা ধুয়ে কি পানি খাবো? ইন্টারটা দিলেই বিয়ে। এতো বড় ধিঙ্গি মেয়ে পাহারা দেওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব না। ’ এই শহরে ইন্টারে পড়া মেয়ে মানেই বিয়ের বয়স হয়েছে। তাকে আর ঘরে রাখা যাবে না। রাখলেই সর্বনাশ। দেশের অবস্থা ভালো না। বখাটে ছেলেরা কখন না কী করে বসে! মান-সম্মান রাখতে হবে তো নাকি!  
মাহবুবার মায়ের কারণে ছবি আঁকানো শেখার কাজটা আমি পেয়েছি। আমি আর্ট কলেজের স্টুডেন্ট নই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফিজিক্স নিয়ে পড়ছি। সায়েন্সের স্টুডেন্ট। মেট্রিকে বায়োলজির জন্য ব্যাঙ, মানুষের হাড় এসব আঁকতে হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই আঁকার হাত ভালো। নিজের চেষ্টায় ছবি আঁকা নিয়ে দু-একটা বাইরের বইও পড়েছি। এসব যোগ্যতার কারণেই পড়ানোর সুযোগটা হয়েছে।  
মাঝে মাঝে ছবি আঁকার পাশাপাশি ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি এসবও পড়াতে হয়। মাহবুবার মা মেয়েকে নিয়ে লড়াই করেন মেয়ের বাবার সঙ্গে। তিনি চান, মেয়ে মানুষ হোক। পড়াশোনা করে ছেলেদের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিক।
মাহবুবার সবকিছুতে তার খবরদারি চলে। খবরদারি চলে আমার ওপরেও। আমাকে বলেছেন, ‘খালি আঁকাঝোকা করলে হবে না স্যার। এই বেতনে অন্যরা ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ সব পড়ায়। পড়াবেন স্যার। মাঝে মাঝে পড়াবেন। মেয়েদের এখন আর পড়াশোনা ছাড়া গতি নাই। কী বলেন?’ 
কথা মেনে নিয়েছি। যার হাত দিয়ে বেতন আসে তার সব কথা শুনতে হয়। প্রায় প্রতিদিন অল্প কিছুক্ষণ ড্রইং করেই ফিজিক্সের বই নিয়ে বসি। টর্ক, চক্র এইসব পড়াই।


পড়াতে পড়াতে মাহবুবার সঙ্গে আলাপ হয়। তার অনেক কিছুর সঙ্গেই পাঠ্যপুস্তকের যোগাযোগ নেই। লুকাবো না, যেকোনো বিষয়ই হোক না কেন, মাহবুবার সঙ্গে গল্প করতে আমার ভালোই লাগে।
কলকাতা আসার আগে শেষবারের মতোন গিয়েছিলাম ওর বাসায়। বিকেলে। তখন আকাশ লাল হয়ে ছিলো। ডিমের কুসুম যেভাবে ছড়িয়ে যায় ঠিক সেভাবে সূর্যের আলোর লাল রঙ ছড়িয়ে পড়েছিলো আকাশে।



ফনিক্স সাইকেলটায় তালা দিয়ে মাহবুবার ঘরে ঢুকতেই কাজের লোক ক্ষিতীশ এক গ্লাস পানি দিয়ে যায়। ছেড়ে দিয়ে যায় টেবিল ফ্যানটা। শার্টের ওপরের বোতামটা খুলে আমি একটু শান্তি করে ফ্যানের বাতাস খাই। ভালো লাগছিলো।  
মাহবুবা আসে। টেবিলে বসে। অনেক হোমওয়ার্ক দেওয়া আছে। সামনে পরীক্ষা। পড়ার চাপ আছে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলাম। জানালা লাগোয়া নিম গাছ। পাতা এসে ঢুকে পড়েছিল গ্রিল দিয়ে। পাতার অদ্ভুত ক্ষমতা। ছোঁয়া লাগলেই সতেজ লাগে।  
মন ভালো ছিলো খুব। কারণ, বেতন হবে। কড়কড়ে নোট আসবে হাতে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ঘ্রাণ টাকার। ফুল, পাতা, সুগন্ধী সব হার মেনে যায় টাকার কাছে। ঠিক করেছিলাম টাকা পেলেই চলে যাবো রয়েল হোটেলে। মোগলাই আর দুধ চা মেরে দেবো। মায়ের জন্য শাড়ি কিনবো। নিজের জন্য কিছু কেনাকাটাও দরকার। বেতন না হলে বিপদ! 
মানিব্যাগ সব মিলে দেড়-দুইশো টাকা আছে। বাকিটা ভর্তি ভিজিটিং কার্ডে। ফোলা মানিব্যাগ দেখে অনেকেই ঘাবড়ে যায়। মনে করে অনেক টাকা কাছে। মানুষের এই চমকে যাওয়াটা ভালো লাগে। তাই মিছেমিছি কার্ড ভরে মানিব্যাগ মোটা করি।  
শেষ পর্যন্ত বেতন হয়নি। টাকা ছাড়াই বের হয়েছি বাইরে।  
একদিন আমার অনেক টাকা হবে। আমি এই স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখতে দোষ নেই।  
তবে হ্যাঁ, আমার কোনো স্বপ্নই আমার নিজের জন্য না। মায়ের জন্য।  
খুব বেশিক্ষণ ছিলাম না টিউশানিতে। ফেরায় সময় মাহবুবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসিনি। মেজাজ খারাপ ছিলো। মেয়েটার হাসি শোনা হয়নি। মেয়েটা সারাক্ষণ হাসে। কারণে অকারণে হাসে। হাসিটা অদ্ভুত। শুনলে মনে হয় কাঁচ ভাঙছে।  
মাহবুবাকে পড়িয়ে ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়েছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে। শহরটা ছোট। সাইকেল নিয়ে টান দিলেই হয়। যেখানেই যাই না কেন পাঁচ থেকে দশ মিনিটের পথ। ব্যাডমিন্টন খেলে আবার বিবির পুকুরের পাড়ে আড্ডা। আলুর চপ, একটু লবণ আর শসা।  
বাড়ি ফিরতে ফিরতে একটু রাতই। তখনও বুঝিনি মা ভালো নেই। একবারও মনে হয়নি। বুকের ভেতরটায় ভয় লাগেনি।  
বাড়ি ফিরেই দেখলাম সাদা রঙের একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে বাড়ির সামনে। প্রায়দিনই থাকে। আগে চমকাতাম। এখন আর চমকাই না। দশ-বারো বছর ধরে যার মা অসুস্থ তাকে এতো চমকালে হয় না। ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে ধীরে সুস্থে ঘরে ঢুকেই দেখি স্ট্রেচারে তোলা হচ্ছে মাকে। জ্ঞান নেই। মুখের কোনা থেকে গড়িয়ে পড়ছে সাদা ফেনা।  
আর মনে নেই। মনে থাকলেও এখন বলতে পারবো না। সময় লাগবে একটু।
আপাতত থাক। মাকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হবে। চাইলেও পারছি না ভাবনাকে দূরে সরিয়ে দিতে। মন ভার হচ্ছে। মা যে আমার খুব প্রিয়।
‘মা, মাগো। ’ খুব কাঁদতে ইচ্ছা করে। পানি কেনার কথা বলে বাবা আর মামার কাছ থেকে আড়াল হই।  
কোঠারি হাসপাতালের ওয়াশরুমে ঢুকলাম। মুখে পানি দিলাম। দেখি হালকা হতে পারি কিনা।  
জানি শোকের বয়স অল্প হয়। মানুষ ভুলে যেতে পছন্দ করে। মাকেও হয়তো ভুলে যাবো। একদিন-দুইদিন তারপর ছবি হয়ে থাকবে। মা ন্যাওটা ছেলে আমি। মুখে না বলতে পারলেও মাকে নিয়ে আমার দুশ্চিন্তার শেষ নেই।  
মা মারা যাবে। ডাক্তাররা আশা দিতে পারছেন না।
কলকাতার আকাশে আজ কি একটু ঝড় হতে পারে না? ভয়ঙ্কর ঝড়। ধুলোয় ঢেকে যাবে পুরো শহরটা। ঘরবন্দি হবে মানুষ। গাছ, গাছের পাতায় তোলপাড় হবে। ডাল ভেঙে পড়ে রাস্তা বন্ধ হবে। এলোমেলো হবে তুমুল হাওয়ায়। সব এলোমেলো।  
তারপর ঝড় শেষে হবে নীরব বৃষ্টি। তখন আমি মাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে নেবো। সুস্থ হয়ে সে যাবে তার বাড়ি ‘আপন ভিলা’য়। ভিজতে ভিজতে।
ওয়াশরুম থেকে বের হই। বাবা আর মামার কাছে যাই। তাদের হালকা করতে হবে। ভয় পেলে চলবে না।
‘মায়ের কিছু হবে না। টেনশন নাই। সব ঠিক থাকবে। উন্নত চিকিৎসা। ’ এতোটুকুন বলে বাবা-মামাকে হালকা করতে গিয়ে নিজেই কেঁদে ফেলি। বাচ্চাদের মতোন।  
বাবা জড়িয়ে ধরেন। তিনিও কাঁদেন। বলেন ‘বাঁচানো যাবে না রে। যাবে না। ’
ঝড় শুরু হয়। কলকাতায়। আজব কাণ্ড!
কিসের আলামত জানা নেই। আমি এখন কিচ্ছু জানি না। জানতে চাই না।
শুধু কাঁদতে চাই। কান্নার দরকার আছে।  
মাহবুবা পাশে থাকলে ভালো হতো এসময়।  
কেন এমন মনে হলো?
কেন? ছি!
চলবে…

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৬
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

উপন্যাস এর সর্বশেষ