৯.
কেসস্টাডির হিস্ট্রিগুলো পড়ছি আর বিচিত্র অভিব্যক্তি জেনে অবাক হচ্ছি। ডা. ফাহমিদ তার রোগীদের আদ্যোপান্ত পুরো বিবরণ, বয়স, জন্মস্থান, লিঙ্গ, পেশা/বৃত্তি, শিক্ষা, রোগের উৎপত্তি, কারণ, বর্তমান সমস্যা, চিকিৎসার ধাপ ইত্যাদি বেশ সাজিয়ে লিখে রেখেছেন।
আগে হিস্ট্রিগুলো পড়ে নিই। তারপর এক দুজনের সঙ্গে দেখা করা যেতে পারে। কে জানে, নিজের উপর আস্থাহীন, বিচ্ছিন্ন এসব মানসিক রোগী আমাকে সময় ও পাত্তা দেবে কি-না! আবার এসব রোগীর অভিজ্ঞতা নিয়ে নতুন নতুন মাদকাসক্তের সঙ্গে কথা বললেও একটি আলোচনা-বৃত্তের দরজা খুলে যাবে। মানব মনের গভীর-গহীন অতলে পৌঁছার আশায় আমি কেসস্টাডিতে গভীর আগ্রহ ভরে ডুবে যাই।
খাতার প্রথম পাতায় পর্যবেক্ষণের ঢঙে কিছু অবজারভেশন লিখা; এগুলো ডা. ফাহমিদের, না অন্য কোনও মনস্তত্ত্ব বিশেষজ্ঞের, স্পষ্ট বুঝার উপায় নেই। তবে কথাগুলো অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যেমন:
....মানসিক নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব এবং বিচ্ছিন্নতার উপমার জন্য দ্বীপ থেকে আর ভালো উপমা কীইবা হতে পারে! কবিতা, গান, চিত্রকর্মে তাই দ্বীপ মানে একাকী একজন। সামাজিকতা নেই, নেই পারিবারিক দায়িত্ববোধ। মনের এই ‘সেন্স অব নাথিংনেস’কে প্রকাশ করা হয় ‘লস্ট এম্পায়ার’ বা হারানো সাম্রাজ্যের সঙ্গেও। ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিত্বের মধ্যমণিও তো একটি দ্বীপ। প্রশ্ন হলো, দ্বীপটি জীবন্ত না মৃত; সমাজ-সংযুক্ত না বিচ্ছিন্ন। এর উপর নির্ভর করে মানুষটি মানসিকভাবে কেমন, সেটা। অতএব, মানব মনের গভীরে অবস্থিত দ্বীপটির চিকিৎসা দিয়ে মানসিক সমস্যার সমাধানের সূচনা করতে হবে। ....
বাহ! মানুষ আর দ্বীপ। বেশ মজার উপমা তো। মানব মনের অতি গভীরের গোপন অংশের প্রতীক হিসাবে একটি দ্বীপকে কল্পনা করতেও বেশ রোমান্টিক ও কাব্যিক ছোঁয়া অনুভব হয়। যাক সে সব। বরং একটি একটি করে কেস স্টাডিতে চোখ বুলানো যেতে পারে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কিংবা মাদকাসক্ত মানুষদের মনের গভীর দ্বীপের দেখা পাওয়া যায় কি-না, সে চেষ্টাই করা ভালো। আমি প্রথম কেসের পাতায় তাকাই:
...আজকাল সারাক্ষণ মন ভার হয়ে থাকে। ভীষণ একা মনে হয় নিজেকে। মনে হয় কেউ নেই আমার। প্রিয়জন, বন্ধুবান্ধব, সুহৃদ-শুভাকাক্সক্ষী কেউ নেই। সবাই সবাইকে নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। আমার মনের ওপর জমে আছে নিঃসঙ্গতার অন্ধকার মেঘ। ভোর থেকে শুতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মনে হয় একখণ্ড নিকষ কালো মেঘের ঘেরাটোপের মধ্যে বসবাস করছি। এসব কিছুর মূলে অসীম একাকিত্ব, আমি ঠিক বুঝতে পারি। আমার তুচ্ছ মানব-অস্তিত্বের অর্থ কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। দুঃসহ বিষণ্নতার চাপে আমার একদার স্মৃতিময় স্বপ্ন ও কল্পনার একান্ত ভুবনটি এখন বিষণ্ন। এমন অভিজ্ঞতা অনেক লেখক-শিল্পীর হয়ে থাকে বলে শুনেছি। তাঁরা মনোভুবনের তমসা থেকে এক সময় বেরিয়েও আসতে পারেন সৃষ্টির পথ ধরে। আমি বের হতে পারছি না। আমার আতঙ্ক, আমি বিষণ্নতার এই রুদ্ধগ্রাস থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারব না। এসব কথা কাউকে বলা যায় না। সবাই নিজের জগতে ব্যস্ত। আমাকে সময় দেওয়ার ফুসরত নেই তাদের। আর সাধারণ গড়পড়তা মানুষ এসবের গূঢ়ার্থ বুঝবেও না। আসলে বেশির ভাগ মানুষই ছকবাঁধা দৈনন্দিন জীবনের ছোট ছোট সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে বেশ সুখে-আনন্দে আছে। এদের চিন্তার জগত বড়ই ক্ষুদ্র আর সংকীর্ণ। এটাই জীবনের সাধারণ বিধান। কিন্তু আমি এই সাধারণ নিয়মের মধ্যে টিকতে পারছি না। প্রতিদিন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছি। একাকি হচ্ছি। কাউকে পাচ্ছি না। আমার ঘুম, জাগরণ, জীবন, যৌবন ব্যর্থ ও অব্যবহৃত হয়ে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি এর কোনওই প্রতিকার করতে পারছি না। অনাদিকালের মহা সৃষ্টিযজ্ঞে তৈরি হয়ে গেছে পৃথক জগত। আমাদের জন্য। তোমাদের জন্য। তোমাদের জগত ভিড়াক্রান্ত। আমরা একাকি। আমাদের জগতের ভেতরে শুধু বোধ ও চেতনার আলো-ছায়ার খেলা; সে জগতের ভেতরে আরও আরও জগত। অদৃশ্য যুদ্ধ নিরন্তর বেঁচে থাকার জন্য; নিজের সঙ্গে নিজেরই দ্বৈরথ। যুদ্ধে যারা পরাজিত, তাদের সামনে আত্মবিনাশের পথ। ব্যক্তিগত বেদনা ও নৈরাশ্যের দহন। তখন নিজেকে মনে হয় বাইরের কেউ; নিজেকে নিজেই চিনতে পারি না; নিজেকেই মনে হয় ‘বাইরের বহিরাগত লোক’: ‘আউটসাইডার’। কিছু মানুষ যেন ‘আউটসাইডার’ হয়েই জন্মায়। এটা কি নিয়তি! এই যেমন আমি সারা জীবন সব ব্যাপারে ‘বহিরাগত’ থেকে গেলাম। আমার এই প্রবণতা ও লক্ষণ সবাই বুঝতে পারে না। অন্তর্মুখী হয়ে হয়ে জীবনের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন, বহিরাগত, অচেনা জীবনে আমি ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছি। নিঃসাড় মানুষের মতো জীবনের নিয়ম রক্ষার ভূমিকা পালন করছি; কখনও অভিনয়। সবাই ধরতে পারে না আমার এই খেলা। সুরভি বুঝে ছিল। অনেক বেশি কাছে এসে তবেই অনুভব করেছিল আমাকে। আমার হাজার দুয়ারী মনের রাজ্যে এক-একটি দরজা খুলে সে অবাধে যাতাযাত করেছে। একান্ত আমার সঙ্গে কথা বলেছে চুপিসারে। সে-ও আর নেই। আমার সঙ্গে জীবন জড়িয়ে কোথায় যাবে সে? বৈষয়িক মানুষের মতো অঙ্কের খাতায় আমাকে যোগ-বিয়োগ করে হিসাব মিলাতে পারে নি। ওকেইবা দোষ দিই কেন! ওর পরিবার, অভিভাবক, সমাজ চীনের প্রাচীরের মতো সামনে দাঁড়িয়ে গেল। আমাকে একটি চোরা নীল স্রোতে ভেসে ভেসে এখন সংগোপনে সুরভির স্মৃতিযাপন করতে হচ্ছে। আমার কষ্ট, নিঃসঙ্গতা, একাকিত্বে এই আমার পরম উদ্ধার। ...
বিবরণটি এখানেই অসমাপ্তভাবে শেষ। তারপর ডা. ফাহমিদের কিছু নোট। ওষুধ-পত্রের নাম। পরের কেসটি একটি মেয়ের। বয়স লিখা আছে আটাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মাতক। ঢাকা শহরের বাসিন্দা। আর্থিক অবস্থা উচ্চবিত্ত।
...মাথার মধ্যে শূন্যতা ছাড়া কিছু নেই। অনুভূতিহীন। স্বপ্নহীন। শ্রুতিহীন। স্পর্শহীন। সম্পর্কহীন। শব্দহীন। গন্ধহীন। বর্ণহীন। স্বাদহীন। আমি বাস করছি ‘নেই’-এর জগতে। নির্দয় শূন্যতার ভিতর আমি অনন্ত সুদূরে হেঁটে যাই। সেখানে স্মৃতি ও সত্ত্বা রক্তাক্ত প্রজাপতির মতো মৃত্যুন্মুখ। আমি আছি মানুষের ভ্রুণ ডুবিয়ে রাখা সায়েন্স মিউজিয়ামের বাদামী তরল জগতের বোতলবন্দি জীবনে। মৃত্যুর গন্ধ মেখে পতঙ্গ উড্ডয়ণে। কখনও মনে হয়, দুপুরের নিঃসঙ্গ রৌদ্রে ভেসে যাচ্ছি মেহগনি পাতার আড়ালে। ইদানিং ব্যাখ্যাহীন ঘোরের উদাসীনতা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অন্তরে-বাহিরে। মাথায় স্থাপিত দুরন্ত মনিটর থেকে ভিজুয়ালাইজেশনের রঙিন ক্ষুদ্রাকৃতির বলগুলো অদ্ভুত মেলোডি প্রস্তুত করছে: ‘আই লং টু সি দ্য সানলাইট ইন মাই রিদম...। ’ চারদিকে উদ্দাম অন্ধকার। রাশি রাশি কৃষ্ণচূড়া আকাশের নীলাভ্রে আগুনের ধ্বস্ত সৌন্দর্যের লকলকে শিখা ছড়িয়ে সেই আদি ও অকৃত্রিম আঁধারেতেই লীন। মাথার মধ্যে একটি অচেনা উড়োজাহাজ কালো অন্ধকার বুদবুদ ছড়িয়ে এই মাত্র চলে গেল। আমি কোথায় আছি? এ কোন জগত, যা আমি চিনি না? আমি যাকে খুঁজি, সে তো আঁধারেই হারিয়ে গিয়েছে। আমার মগজে শূন্যবৃত্ত পথ। চলে যায় আমাকে নিয়ে আদিম অন্ধকারে। সেখানে তুমি আর আমি একাকার। আমার জীবন, যৌবন, উচ্ছ্বাস তোমার নিত্য-সন্ধানে আমার মধ্যেই গুঞ্জরিত। অব্যক্ততার বোঝা বহনের জন্য শরীর আর প্রস্তুত নেই। শুধুই ক্লান্তি। অবসাদ। শুধুই তোমার অপেক্ষা। নীল বাতাসের ভেলায় ভাসমান বেহুলার মতো আমি লখিন্দরের প্রতীক্ষায়। ...
না, আর পড়তে পারছি না। আজ এ পর্যন্তই থাক। আনন্দ যেভাবে ছড়ায়, কষ্ট আর বেদনাও সেভাবেই সংক্রমিত হয়। মনে হচ্ছে আমি বেদনাক্রান্ত কতিপয় তরুণ-তরুণীর যাপিত যাতনায় অতলান্ত গভীর-গহীনে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি।
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৯, ২০১৭
জেডএম/