** নীল উড়াল: সপ্তত্রিংশ পর্ব
৩৮.
তানিয়া মেয়েটি অসাধারণ দক্ষতা দেখালো বটে। তারুণ্যের কর্মস্পৃহায় সে কতটা প্রাণচঞ্চল, বাইরে থেকে টের পাওয়া যায় না।
কোনও ঝুঁকি নেওয়া হয় নি। আমার আর মার্গারেটের দেশত্যাগের সিডিউল করা হয়েছে একই সঙ্গে। কেউ কাউকে বিপদের মধ্যে রেখে আমরা যেতে রাজি হই নি। সেভাবেই সব ঠিক করেছে তানিয়া। আজ রাতেই আমাদের ফ্লাইট। আমরা এয়ারপোর্ট থেকে দুই প্লেনে দুই পথে চলে যাবো। মার্গারেট প্যারিস আর আমি মন্ট্রিয়ল। মার্গারেটের প্লেন ছাড়বে দশটায়। আমার বারোটায়। আহা! মার্গারেটকে ছাড়া লম্বা দু’টি ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে নিরস বিমানবন্দরে! কেন, সে আমার সঙ্গে কানাডা চলে যেতে পারে না। আমার শিশুসুলভ আহ্লাদে নিজেই মনে মনে হেসে ফেলি। এখন হাসার সময় নয়।
তানিয়ার ভাই বলেছে, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সব কিছু সেরে ফেলতে হবে। এই সময়টা সে আমাদের আড়াল করে রাখবে। আমার প্রতিপক্ষ জানে না, আমি ঢাকায় ফিরে এসেছি। জানলে তারা নানা দিক থেকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তাদের ধারণা, আমি স্থল সীমান্ত পথে ভারত হয়ে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছি। তাদের মনোযোগ এখন ঢাকার বাইরে। কিন্তু অচীরেই যখন ঢাকায় আমার উপস্থিতি জেনে যাবে, তখন তাদেরকে সামলানো আসলেই অসম্ভব হবে। ফলে যা করার, অতিদ্রুতই করতে হবে।
ঝুট-ঝামেলার মধ্যেই এক ফাঁকে তানিয়াকে কয়েকটি অনুরোধ করি। কিছু ব্যক্তিগত আর কিছু অফিসিয়াল। রোকসানার মামলাটা দেখা-শোনা করা অফিসিয়াল কাজের মধ্যে পড়ে। মার্গারেট অফিসের তরফে একজন ব্যারিস্টার ঠিক করেছে। যিনি পুরো আইনগত দিক সামলাবেন। একটি প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গেও চুক্তি করা হয়েছে। তারা গোপনে তদন্ত করে রোকসানার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ ও আসল খুনি শনাক্ত করবে। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে ব্যারিস্টার সাহেব আইনি লড়াই চালাবেন। চেষ্টা করবেন, এই মামলা থেকে আমাকে সরিয়ে আনতে। প্রয়োজনে বিদেশি তদন্ত সংস্থা দিয়েও পুরো মামলাটি আবার ওপেন করা হবে।
তানিয়াকে ব্যক্তিগত অনুরোধ করতে আমার সঙ্কোচ হচ্ছিল। উন্নয়নকর্মীর নৈব্যর্ক্তিকতায় সে আমার দ্বিধা কাটাতে সাহায্য করলো। আমি ওকে ফুলির কথা বললাম। সাইফুল, তার স্ত্রী আর মিষ্টি ছেলে-মেয়েদের কথাও বলি। ওদের জন্য কিছু উপহার দেওয়ার ইচ্ছা আমার মধ্যে ছটপট করছে। আমি নিজে গিয়েই ওদের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে দেশ ছাড়ার আগে আত্মপ্রকাশ করলে চলবে না। আত্মগোপনে সব কাজ করতে হবে। তানিয়া ছাড়া আর কেউ নেই, যাকে দেশের ভেতরের এই কাজগুলো করার জন্য বলতে পারি।
তানিয়া সানন্দে কাজগুলো বুঝে নিল। আমি তানিয়াকে বলি:
-তুমি কি কখনও রমনা পার্কে গিয়েছো?
তানিয়া উত্তর দিল:
-কেন নয়! অবশ্যই গিয়েছি।
আমি হেসে বললাম:
-বেড়াতে বা ঘুরতে যাওয়ার কথা বলছি না আমি। আমি বলছি, তুমি কি কখনও সেখানে গিয়ে পার্কের বৃক্ষ-গুল্ম-পত্রালী এবং প্রকৃতিতে মিশে থাকা মানুষগুলোকে গভীরভাবে দেখেছো?
তানিয়া নিজের অপারগতা জানালো:
-না, এমন নিবিড় ভাবে আমি কখনও সেখানে যাই নি।
আমি তানিয়ার দিকে চেয়ে মুচকি হাসিতে বলি:
-যদি কখনও সেখানে যাও, গভীরভাবে দেখো সব কিছু, তবে দেখতে পাবে, অলৌকিক সন্ধ্যার রহস্যে প্রাচীন গাছের নীচে একজন বিবাগী-উদাসী মানুষ বসে আছেন বহু মানুষকে নিয়ে। লোকটির নাম শফি মামা। তিনি কোনও কথা বলবেন না। তোমার প্রশ্নেরও উত্তর দেবেন না। নিজের ইচ্ছা হলে হয়ত কিছু বলবেন আকাশের দিকে তাকিয়ে। সব মানুষ তার কথা বুঝবে না। কেউ কেউ বুঝবে। আর বুঝবে গাছ-গাছালি-পাখি-পতঙ্গ-প্রকৃতির অন্ধকার। সম্ভব হলে তাকে দেখে এসো। তাকে কোনও প্রশ্ন করবে না। তিনি যদি নিজে থেকে তোমার কাছে জানতে চান, তবে তাকে জানিও, আমি তার সব কথা বুঝতে পেরেছি। আমিও তার মতো একজন বিবাগী মানুষ। বিবাগী ছাড়া বিবাগীর কথা আর কে বুঝবে!
তানিয়া অবাক হয়ে এই প্রথমবার আমার ভেজা চোখ দেখলো।
যাতে আমার চেহারা দেখতে না পায়, সেজন্য আমি আরেক দিকে মুখ ফিরিয়ে তানিয়াকে বললাম:
-তানিয়া, শফি মামার আশেপাশে তুমি ফুলি নামের একটি কিশোরী মেয়েকে দেখতে পারে। তাকে কি তুমি আমার একটি কথা বলতে পারবে?
তানিয়া আর্দ্র গলায় বললো:
-কি কথা?
আমি বহু কষ্টে আমার বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠস্বর লুকিয়ে বললাম:
-ফুলিকে বলো, তোমার বিবাগী ছেলে তার প্রিয় স্বদেশে থাকতে পারে নি। সে বিদেশ চলে গেছে। কিন্তু সে কোনো একদিন মা বলে ডাকার জন্য তোমার কাছে আসবে।
তানিয়া তাড়াতাড়ি আমার সামনে থেকে চলে গেলো। ওর দু’চোখ বেয়ে দরদর করে অশ্রু ঝরছে। আমি অশ্রুসিক্ত চোখে তানিয়ার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকাই। কিন্তু কিছুই দেখতে পারছি না আমি। আজ আমার দু’টি চোখই ভীষণ ঝাপসা হয়ে আছে। মনে হচ্ছে সাইফুলের মেয়ে আর পুত্রটির শরীর ভিজে যাচ্ছে আমার অশ্রুতে। আহ! কি মায়াবী শিশুরা। সাহসী সাইফুল, একদিন অবশ্যই ফিরে এসে তোমাকে দেখে যাবো, বন্ধু আমার!
আমার ভেতরের বাধ-ভাঙা জলের প্লাবন থামাতে আমি প্রসঙ্গান্তরে চলে আসি। আমি শেকসপিয়ার থেকে বিড়বিড় করে ব্রুটাসের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আবৃত্তি করি: 'There is tears for his love, joy for his fortune, honour for his valour, and death for his ambition. Who is here so base that would be a bondman?'
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৭
জেডএম/