৪০.
ভালোবাসা টেনে আনে, ভালোবাসা দূরে সরিয়ে দেয়। মার্গারেটের কাছ থেকে এক ধরনের ভালোবাসা বুকে নিয়ে আমি চলে আসি আরেক ভালোবাসা কাঁঠালবাগানে।
কাঁঠালবাগানের পথ দিয়ে বাবা হেঁটে আসতেন। মাথা উঁচু লিকলিকে সংসারের কর্তা। তাঁর ছায়া ডিঙিয়ে পেছনে দৌড়াতাম আমি এক স্বপ্নবালক। ভারী সুন্দর বাগান-ঘেরা বাড়ির সামনে হুডখোলা জিপ, উইন্ড স্ক্রিনে ওয়াইপারের জলকাটা দাগে আমার পরাবাস্তব প্রতিবিম্ব। পাশে এসে বাবা দাঁড়াতেন-আমার কাঁধে তাঁর ভরসার হাত। মনে আছে, বাবার কলিগ একটা চকোলেট দিয়েছিলেন, সেই চকোলেট আঙ্কেল একদিন চিরদিনের জন্য চলে গেলেন। বাবা তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে উদাস গলায় বলতেন, ‘থাকার জন্য কেউ থাকে না। থাকে শুধু মাটি ও ছাই। ’ আমিও বাবার মতো আকাশ দেখতে চাইতাম। আমার দৃষ্টির শেষ দূরত্বে ফ্যাক্টরির টিনের চালে হিরের নাকছাবির মতো জ্বলত দুপুর। বুকভরা শ্বাসে মায়ের রান্নাঘরের চা পাতার ঘ্রাণ। তাঁর স্নেহমাখা আঙুল দেখাত ট্রাফ হাউস ড্রায়ার মেশিন। হিউমিডিফায়ারের কুয়াশায় ভিজে যেতো আমার কিশোর চোখের পাতা। সব তেমনি আছে: স্মৃতির আলমারিতে। অবিকল আছে কখনও বেড়াতে গিয়ে মগজের সুতোয় নিয়ে আসা সবুজ ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া চা বাগান। সবুজ সিঁথির মতো সরু পথ। অনন্তে চলে যাওয়া রাস্তা।
স্বদেশের পথ থেকে চিরদিনের অন্তরের পথে যেতে যেতে শেষবার চলে এসেছি কাঁঠালবাগানে। আদিবাস্তুভিটা। শেষ প্রহরীর মতো আগলে আছেন বার্ধ্যক্যের উপান্তে উপনীত ছোটখালা। ইতিহাসের পেছন পেছন পায়ে হেঁটে রেট্রোগ্রেডের মতো আমি চলে এসেছি তাঁর কাছে। আমাকে দেখেই ছোটখালা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন:
-তোর কি হয়েছে? কোথায় ছিলি? পত্রিকায় কি সব লিখছে তোকে নিয়ে?
আমাকে দেখে তার শান্ত-সমাহিত মুখ উদ্বেগে ভরে গেলো। অস্থিরতায় তিনি মৃদু কাঁপছেন। আমি কোনও উত্তর দিই না। আমার আসার শব্দ শুনে খালার পেছনে এসে দাঁড়ানো অন্তরার মুখের দিকে তাকাই। অন্তরা নির্বাক। নিশ্চুপ। সে কি জানতো, আমি আসবো? ওর সঙ্গে কথা না বলে আমি কোথাও যাবো না? ওর সঙ্গে দেখা না হলে যে নীল-রহস্যের অনেকটুকুই অজানা থেকে যাবে? সে কি জানে এই কথা?
কোনও অভিব্যক্তি নেই অন্তরার মুখে। চোখের নীচে কালো কালি। মুখে অস্পষ্ট ছায়া। মনে হয়, এই মেয়ে জগৎ-সংসারে নেই! হঠাৎ ওর জন্য আমার মন খারাপ হয়ে এলো।
ছোটখালা পেছন ফিরে অন্তরাকে দেখে বলেন:
-কি রে অন্তরা, তোর ভাইয়া কথা বলছে না কেন? কি হয়েছে আমাকে বল?
সারা ঘরে নিশ্ছিদ্র নীরবতা। কেউ কথা বলছে না। না আমি। না অন্তরা। মৌনতা সহ্য করতে পারছেন না বয়সী মহিলা। ছোটখালা যেন অদৃশ্য কারও প্রতি ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। জনান্তিকে বললেন:
-তোদের কিচ্ছু বুঝি না আমি। কিচ্ছু না।
ছোটখালা হতাশায়, ক্ষোভে বিড়বিড় করতে থাকেন।
আমার বেশিক্ষণ বসার সময় নেই। এখনই প্লেনের ডাক পড়বে। মার্গারেট সম্ভবত এতোক্ষণে এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেছে। সে আমাকে দেখতে না পেলে খুব দুঃখ পাবে। মার্গরেটকে আমি দুঃখ দিতে পারবো না। আমি চাই, ওকে আনন্দে প্লেনে তুলে তারপর নিজের উড়ালে ভাসতে। চারদিকে নীল উড়ালে ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী, পৃথিবীর অসুখী মানুষ-জন! আমরাও ভাসবো আমাদের নিজস্ব উড়ালে।
আমি ধীরে ধীরে সোফা ছেড়ে উঠি। ছোটখালার কাছে গিয়ে কদমবুচি করি:
-দোয়া করো খালা। আবার কখনও দেখা হয় কিনা, জানি না। দোয়া করো।
আমার গলার শব্দে ছোটখালার চাপা কান্না তীব্র বেগে বন্যার তোড়ের মতো ভেসে এলো। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কাঁদতে লাগলেন। আমার ভিতরটাও হু হু করে উঠছে। ছোটখালার জন্য। অন্তরার জন্য।
আমি আস্তে করে ছোটখালার বাঁধন থেকে বের হয়ে আসি। মায়ার বাঁধন, স্নেহের বাঁধন বড় ভয়ানক। একবার আঁটকে গেলে আর বেরুনো যায় না। আমার মধ্যে অকস্মাৎ জেগে উঠেছে বন্ধন-মুক্তির গান। রণে-রণাঙ্গনে বন্ধনের মায়া, স্নেহের বাঁধন কেবলই পিছু টানে। পৃথিবীর এই মায়ার খেলা, মানুষের ভিতর ও বাহিরের মায়ার এই রহস্যময় বাঁধন দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায় অতি মহার্ঘ্য মানবজীবন। আমি টের পাচ্ছি, আমাকে ঘিরে ক্রমেই ধরছে অন্তহীন মেঘের মতো পুঞ্জ পুঞ্জ মায়ারাশি।
আমি আর কোনও কথা বলি না। শব্দহীন পদক্ষেপে ঘর থেকে বের হয়ে আসি। ছোটখালা উদাস মুখে আমার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছেন। অন্তরা আমার পেছন পেছন বের হয়ে আসছে। ও নিজের পা নিজেই যেন টেনে নিতে পারছে না। পুরো শরীর পাহাড়ের মতো ভারী হয়ে আছে। অন্তরার মনে হয়, জীবন বড়ই দুর্বহ। তবু এ জীবনকে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত টেনে নিতেই হবে একাকী পদভারে। অন্তরা অতি কষ্টে পা টেনে টেনে আমাকে অনুসরণ করে। (আগামী পর্বে সমাপ্য)
বাংলাদেশ সময়: ১০৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৭
জেডএম/