নাটোর: মো. রাজিব হোসেন (৩০), দরিদ্র পরিবারে জন্ম, কাজ করেন ওয়ার্কশপ মেকানিক হিসেবে। বাড়ি নাটোরের গুরুদাসুপর উপজেলার বিয়াঘাট গ্রামে।
শৈশবে শখ ছিল, চার চাকার গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর। কিন্তু সেই শখ পূরণে দরকার অনেক টাকা। যা তার নেই। তাই বলে কি শখ পূরণ হবে না? এমন প্রশ্ন তার মনে বার বার ঘুরপাক খাচ্ছিল। সংসারের অভাব অনটনের কারণে পঞ্চম শ্রেণির বেশি পড়ালেখা করতে পারেননি তিনি। তবে স্থানীয় হাফেজিয়া মাদরাসা থেকে ৩০ পাড়া কোরআন মুখস্ত করেছেন রাজিব।
স্বপ্ন তো স্বপ্নই, ক’জনারই বা পূরণ হয়? কিন্তু রাজিব তার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিয়েছেন।
তাই তো শৈশবের শখ মেটাতে শেষ পর্যন্ত ২০১৩ সালে উপজেলার রাবারড্যাম বাজারে একটি ওয়ার্কশপের গ্যারেজ করেন। সেখানে বিভিন্ন গাড়ি মেরামত করতে শুরু করেন। শুরু হয় তার পথচলা। অন্যের গাড়ি মেরামতের পাশাপাশি নিজেই একটি চার চাকার গাড়ি তৈরির সিদ্ধান্ত নেন।
২০১৮ সালে এসে গ্যারেজের বাতিল যন্ত্রাংশ ও মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন দিয়ে ছোট জিপ গাড়ির আদলে ছোট একটি গাড়ি বানাতে শুরু করেন। ২০২৩ সালে এসে সেই গাড়িটি চলাচলের জন্য উপযোগী হয়েছে। গাড়িটির নাম দিয়েছেন ‘ভিলেজ পাজেরো’। এখন সেই ‘ভিলেজ পাজেরো’ গাড়িতে করে রাজিব ঘুরে বেড়াচ্ছেন গুরুদাসপুরের অলিতে গলিতে।
শুধু একাই নয়, রাজিব নিজের তৈরি গাড়িতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়েও ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন জায়গায়। তার গাড়িটি দেখতে অন্য রকম হওয়ায় নজর কাড়ছে সবার। গাড়িটি দেখতে এবং ঘুরে বেড়াতে ওয়ার্কশপে ভিড় জমাচ্ছেন অনেকে।
গুরুদাসপুর উপজেলার বিয়াঘাট ইউনিয়নের মো. নিজামুদ্দিন হোসেনের ছেলে রাজিব হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে নাটোর শহরে বেড়াতে গিয়ে এমন একটি গাড়ি দেখে ওঠার শখ হয়েছিল। কিন্তু চড়া হয়নি। তখন থেকেই স্বপ্ন ছিল একটি গাড়ি কেনার। কিন্তু টানাটানির সংসারে গাড়ি কেনার সুযোগ নেই। গ্যারেজে কাজ করতে করতে একদিন হঠাৎ মনে হলো বাতিল যন্ত্রাংশ আর মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন দিয়ে একটি ছোট গাড়ি তো বানানো যায়! সেই ভাবনা থেকেই গাড়িটি বানাতে শুরু করি। পাজেরোর আদলে বানিয়ে ফেললাম একটি গাড়ি। নাম দিয়েছি ‘ভিলেজ পাজেরো’। কারণ গ্রামে আমার বসবাস এবং গ্রামের রাস্তা দিয়ে এ গাড়ি নিয়ে বেশি সময় চলাচল করি, তাই এমন নাম দিয়েছি। গাড়িটির সামনে চালকের পাশে একজন এবং পেছনে দুজন বসতে পারেন।
এক লিটার পেট্রোলে ৩০ কিলোমিটার ঘুরে বেড়ানো যায় জানিয়ে তিনি বলেন, এ গাড়ি চালিয়ে স্ত্রী, সন্তান নিয়ে নাটোর, বগুড়া, রাজশাহী, ঈশ্বরদী এবং বন্ধুদের নিয়ে কুষ্টিয়া, যশোর, সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত বেড়িয়েছি। আমার দোকানে অনেক মানুষ ভিড় করেন গাড়ি দেখতে। অনেকেই ভাড়া নিতে চান। কিন্তু আমার ভাড়া দেওয়ার ইচ্ছা নেই।
শখের বসে কেউ ঘুরতে চাইলে আশপাশ ঘুরিয়ে আনি। তবে সপ্তাহের শুক্রবার ফ্রি থাকি। শুক্রবারই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়া হয়। গাড়িটির কিছু কাজ এখনও বাকি আছে। ওপরে ছাউনি দিয়ে রং করার ইচ্ছে আছে। হাতে একটু টাকা হলে গাড়িটি ঠিক করে নতুনের মতো করার চেষ্টা করব, যোগ করেন রাজিব।
তার ওয়ার্কশপে গিয়ে দেখা যায়, গাড়ির পেছনে লেখা রয়েছে ‘আগে তেল দিন’। স্থানীয়রা জানান, কেউ ছবি তুলতে চাইলে কিংবা ভিডিও করার জন্য আশপাশের এলাকায় ঘুরতে যেতে চাইলে গাড়িতে আগে তেল কিনে দিতে হয়। এজন্যই গাড়ির পেছনে লিখে রাখা হয়েছে, ‘আগে তেল দিন’।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য শরিফুল ইসলাম বলেন, রাজিব অনেক মেধাবী ছেলে। অভাব অনটনের কারণে লেখাপড়া করতে পারেনি। তার বানানো গাড়ি নিয়ে আমি অনেক জায়গায় ঘুরেছি। তবে সে গাড়ির কোনো ভাড়া নেয় না। তেল দিলেই রাজিব ফ্রি থাকলে ঘুরতে নিয়ে যায়। তবে আর্থিকভাবে রাজিবকে সহযোগিতা করা হলে সে আরও ভালো কিছু উপহার দিতে পারবে। একই কথা বললেন আরও অনেকে।
গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শ্রাবনী রায় বাংলানিউজকে জানান, বিষয়টি জেনে খুব ভালো লাগছে। একজন সাধারণ গ্যারেজ মেকানিক ও স্বল্প শিক্ষিত মানুষ এতো সুন্দর একটি গাড়ি বানিয়ে ফেলেছেন, এটা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এ উদ্ভাবনের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সাধুবাদ জানাই। পাশাপাশি তিনি যদি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা চান, তাহলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তাকে সহায়তা করা হবে। তবে এখনও তিনি কোনো সহায়তা চাননি।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৯ ঘণ্টা, মে ২২, ২০২৩
এসআই