গাছটির কলম সম্রাটের মেয়ে সঙ্ঘমিত্রা জাহাজে করে শ্রীলঙ্কায় নিয়ে রোপন করেন। পরবর্তী তেরশ’ বছর ধরে এ গাছটিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় রাজধানী অনুরাধাপুর।
গাছটি আসলে ছিল ডুমুরের একটি প্রজাতি, যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘ফিকাস রিলিজিওসা সেন্টার’। নামই প্রমাণ করে, গাছটি ধর্মীয় ভক্তির প্রতীক। অশোকের শাসনকালেরও হাজার হাজার বছর আগে থেকেই ডুমুর আধ্যাত্মিকতার প্রতীক।
‘ফিকাস রিলিজিওসা সেন্টার’ ৭৫০টি ডুমুর প্রজাতির একটি, যা প্রত্যেক প্রধান ধর্মের বৈশিষ্ট্য এবং রাজা-রাণী, বিজ্ঞানী ও সৈন্যদের প্রভাবিত করেছে।
দেশে দেশে রোগ নিরাময়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে আসছে ৮০ মিলিয়ন বছর আগে উদ্ভূত প্রাগৈতিহাসিক এ গাছটি।
অশোক দ্য গ্রেটের বোধিবৃক্ষ ডুমুর বৌদ্ধ, হিন্দু ও জৈন ধর্মে দুই সহস্রাব্দের বেশি সময় ধরে প্রচুর সম্মান পেয়ে আসছে। ধর্মগ্রন্থে একই গাছের স্তবগান করা ছাড়াও যুদ্ধের কাজে লাগিয়েছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগের বৈদিক মানুষেরা। সিন্ধু সভ্যতারও শিল্পবাহী এ ডুমুর গাছ।
শক্তিসম্পন্ন ডুমুর গাছের বৈচিত্র্য ইন্দোনেশিয়ার মানুষের মাঝেও একতা এনেছে। এর আনত শিকড় অনেক দ্বীপের এ জাতি গঠনের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতীকেও পরিণত হয়েছে।
পর্তুগিজরা সমুদ্রপথে ১৫৩৬ সালে বার্বাডোস দ্বীপ জয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন উপকূল বরাবর ফিকাস সিট্রিফোলিয়া প্রজাতির ক্রমবর্ধমান ডুমুর গাছ দেখে। এর শিকড় রক্তাভ-বাদামি ও শাখা মানুষের চুলের জট পাকানো সুতার মতো ঝুলন্ত ছিল। ‘দাড়িওয়ালা মানুষের’ মতো দেখতে হওয়ায় একে বার্বাডোস নামে অভিহিত করা হয়।
এশিয়ার ক্রান্তীয় ও উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চল জুড়ে সংস্কৃতির ক্ষমতার প্রতীক ও প্রার্থনার স্থান হিসেবে ডুমুর গাছকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এ ডুমুর সৃষ্টির গল্প লোকাচারবিদ্যা ও উর্বরতার শেষকৃত্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ও তার সৈনিকেরা ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ভারতে এসে এ গাছের নানা সুবিধা উপভোগ করেন। আধুনিক উদ্ভিদবিদ্যার প্রতিষ্ঠাতা গ্রিক দার্শনিক থিওফ্রাস্টাস ভোজ্য ডুমুর ফিকাস ক্যারিকা নিয়ে গবেষণা করেন।
মিশরের ফারাওদের কবরে শুকনো ডুমুর দেওয়া হতো, যেন তাদের পরকাল যাত্রা নির্বিঘ্ন হয় ও আত্মা শান্তিতে থাকে। তারা বিশ্বাস করতেন, মা দেবী হাথর একটি পৌরাণিক ডুমুর গাছ থেকে উদ্ভূত হয়ে তাদেরকে স্বর্গে স্বাগত জানাবেন।
মিষ্টি ডুমুর ফিকাস ক্যারিকা উত্তর ও পূর্ব মিসরীয় কয়েকটি প্রাচীন সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য ছিল। সুমেরীয় রাজা উরুকাগিনা প্রায় ৫ হাজার বছর আগে এ সম্পর্কে লিখেছেন। বাদশাহ্ দ্বিতীয় বখতে-নাসার ব্যাবিলনের ঝুলন্ত বাগানে ডুমুর রোপণ করেন, গানে গানে এর প্রশংসা করেন ইস্রায়েলের রাজা শলোমন।
প্রাচীন গ্রীক ও রোমানরা বলেছেন, ডুমুর গাছ স্বর্গ থেকে পাঠানো হয়েছিল। মিষ্টি ও সুস্বাদু এ ফল ফাইবার, ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধ হওয়ায় এর পুষ্টি সুবিধা হাজার হাজার বছর ধরে পরিচিত। ফল ছাড়াও ডুমুরের বাকল, পাতা, শিকড় ও ক্ষীর উন্নতমানের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। গবেষকরা পরীক্ষা শেষে জানান, ডুমুর পাতা ও বাকলের মধ্যেকার যৌগিক ব্যাকটেরিয়া, প্যারাসাইট ও টিউমারের বিরুদ্ধে কার্যকর।
প্রথম শতাব্দীর রোমান দার্শনিক প্লিনি দ্য এল্ডার লিখেছেন, ‘ডুমুর বলকারক ও শ্রেষ্ঠ খাদ্য, যা দীর্ঘদিনের অসুস্থতা উপশম করে’।
ডুমুরের রোগ নিরাময় ক্ষমতার একটি বিখ্যাত উদাহরণ বাইবেলে লিপিবদ্ধ হয়েছে। যিহূদার রাজা হিষ্কিয় মৃত্যুরোগে আক্রান্ত হলে দাসরা তার ত্বকে চূর্ণ ডুমুরের পেস্ট প্রয়োগে সুস্থ করে তোলেন।
বাংলাদেশ সময়: ০০৫৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৭
এএসআর/