ধর্ম বিশ্বাস, সংস্কার-কুসংস্কার, লোকাচার বহুকাল ধরে খ্যাতিমানদের মৃতদেহকে নিয়ে নানা কারবার করেছে। মৃতদেহটি যদি সাধুসন্তের হয়, নিদেন পক্ষে যদি হয় কোন বীর বা বিখ্যাত রাজন্যের তাহলে তো কথাই নেই! হয়ত প্রাণহীন পুরো দেহটি কিংবা এর অংশ বিশেষ বসে গেছে পূজার আসনে।
প্রাচীন গ্রিসের মানুষ, বৌদ্ধ কিংবা পার্সিদের মধ্যে পরলোকগত দেহভিত্তিক নানা চিন্তা ও উদ্যোগ সুবিদিত। প্রচলিত রয়েছে নানা বিচিত্র বিষয় খ্রিস্টানদের মধ্যেও। ইংরেজ-খ্রিস্টান পাদ্রি সাইমন স্টক ১২৬৫ সালে মারা যান ফ্রান্সে। ১৯৫১ সালে মহা সমারোহে তার হাড় নিয়ে আসা হয় ইংল্যান্ডে। মৃত ধর্মীয় নেতাদের দেহের একাধিক অংশ একত্রিত করাটা ক্রমে একটা ভীষণ পবিত্র কাজ হয়ে দাঁড়ায়। এবং বাজারে নামে ঠগ-জোচ্চোরেরা। চালু হয় সাধুসন্তের দেহের অংশবিশেষ বলে দাবি করে নকল জিনিস বিক্রির ব্যবসা। ব্যবসার দাপটে ক্রমে ক্রমে ঘুচে যায় ধর্মনেতাদের সঙ্গে খ্যাতনামা অন্যদের ফারাক। যে কোনও ক্ষেত্রে বিখ্যাত ব্যক্তির দেহাংশ হলেই তা মূল্যবান হয়ে দাঁড়ায়। এবং হয়ে যায় পূজ্য বা সংরক্ষণযোগ্য দ্রষ্টব্য।
হুজুগ মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়, তার একটি হাস্যকর উদাহরণ হলো: একজন আমেরিকান ডাক্তারের কাছে নাকি এখনও যত্নে সংরক্ষিত রয়েছে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ানের ( নেপোলিঁয় নোনাপঁ ) পুরুষাঙ্গটি। তবে, তথ্য না-হয়ে এটা গুজবও হতে পারে।
যা গুজব নয়, সত্য, তা হল, এখনও সযত্নে রাখা বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলেই-এর একখানি নিখুঁত আঙুল। ইতালির এই মহাকাশ-বিজ্ঞানী মারা যাওয়ার একশ‘ বছর পর তাঁর ডান হাতের মধ্যমাটি কেটে নেওয়া হয় শবদেহ থেকে। তারপর থেকে তা সাজিয়ে রাখা হয়েছে ফ্লোরেন্স-এর ‘মিউজিয়াম অব দ্য হিস্ট্রি অব সায়েন্স’-এ। ওই আঙুল যেন এক প্রতীক। ঊর্ধ্বে অঙ্গুলি নিদের্শ করে ওই বিজ্ঞানী মাটির মানুষদেরকে দেখিয়েছিলেন আকাশে গ্রহ-নক্ষত্রের চলন। দূরবিনে চোখ রেখে আবিষ্কার করেছিলেন মহাবিশ্বের অদেখা-জগত। যা ভেঙে দিয়েছিল মানবচিন্তার পুরনো ধ্যান-ধারণা-বিশ্বাস।
গ্যালিলিওর গবেষণা যেমনভাবে এনেছিল বিজ্ঞানের নবযুগ, তেমনি তাঁর কর্তিত অঙুলি যেন নতুন পথের দিকনিদের্শক।
বিভিন্ন অঙ্গের মত, বিখ্যাত-মানব মস্তিষ্কও কেটে রাখা হয়েছে স্মারক বস্তু বা গবেষণা উপাত্তরূপে। মস্তিষ্ক বা ব্রেন-এর বিভিন্ন প্রকোষ্ঠ মানুষের প্রতিভা কিংবা চরিত্রের নানাদিক নিয়ন্ত্রণ করে--- এরকম একটি ধারণা একদল বিজ্ঞানী প্রাচীনকাল থেকেই প্রচার করে আসছেন। গত শতাব্দীর গোড়ার দিকে জার্মান স্নায়ুবিজ্ঞানী অস্কার ভোগট এবং তাঁর ফরাসি স্ত্রী সিসিল ভোগট এ ব্যাপারে গবেষণা করে বিখ্যাত হন। ১৯২৬ সালে এক অভিনব ও নতুন ধরণের চাকরির প্রলোভনে ওই বিজ্ঞানী দম্পতি পশ্চিমা জগত ছেড়ে চলে আসেন তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের নাভীমূল মস্কোয়। চাকরি বেশ বিচিত্র।
১৯২৪ সালে মারা যান বলশেভিক বিপ্লবের অবিসংবাদী নেতা ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন। কম্যুনিস্ট নেতৃত্ব ঘোষণা করেন: লেনিন মৃতুঞ্জয়ী; লেনিনের মৃত্যু নেই। বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক পদ্ধতির সাহায্যে লেনিনের দেহ সংরক্ষণ করা হবে। ১৯২২ সালে হাজার বছরের দীর্ঘ ঘুম শেষে মিশরের ফারাও টুটানখামেন পিরামিডের বাইরে এসে মুক্ত বিশ্বের সামনে উপস্থিত হয়। তখনও বিশ্বজুড়ে খবরের কাগজে সে অবিশ্বাস্য মমি-কাহিনীর আলোচনা। সেখান থেকে আইডিয়াটি মাথায় এসে থাকবে রুশ নেতাদের। অথবা, কম্যুনিস্ট শাসনে যখন ধর্মাচরণ নিষিদ্ধ, তখন যাজকের আসনে রাজনৈতিক নেতাদের বসানোর কথা ভেবে থাকবেন বিপ্লবীরা। লেনিন যেন নতুন পোপ---বর্তমান ও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ধর্মে। তাই তার মরদেহ সংরক্ষণের আয়োজন।
লেনিনের স্ত্রীর আপত্তি প্রত্যাখ্যান করে লৌহকঠিন যোসেফ স্তালিনের নির্দেশে একদল বিজ্ঞানী চার মাস ধরে ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টায় শবদেহটিকে পচনের হাত থেকে বাঁচিয়ে সংরক্ষণের উপযোগী করে তোলেন। এজন্য নেতার নগ্নশরীর চুবিয়ে রাখা হয় পটাশিয়াম অ্যাসিটেট এবং গ্লিসারিন-এ। তারপর টাই-সমেত জামাকাপড় পরিয়ে সাজিয়ে রাখা হয় দর্শনার্থীদের জন্য। যাতে নববিবাহিত দম্পতি কিংবা নভোশ্চর---সবাই তাদের যাত্রা শুরুর আগে একবার সেলাম জানিয়ে যেতে পারে ওই শক্তিশালী মরদেহটিকে। কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব বিশ্বব্যাপী গর্ব করে বলতে শুরু করেন, ‘সব জীবিত মানুষের চেয়ে বেশি জীবন্ত হলেন লেনিন। ’
মহামতি লেনিনের মরদেহকে জাতীয় সম্পত্তি হিসাবে প্রদর্শনীতে সাজিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি ফন্দি মাথায় আসে যোসেফ স্তালিনের---লেনিনের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা। ১৯২৬ সালে মস্কোয় আমেরিকান এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিস দখল করে নিয়ে এজন্য প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ব্রেন ইনস্টিটিউট’। উদ্দেশ্য লেনিনের মাথার খুলি থেকে মগজ বের করে এনে সেটা পরীক্ষা করে নেতার বিপ্লবী প্রতিভার উৎস সন্ধান। এই কাজের জন্যই চাকরি দিয়ে আনা হয় জার্মান-ফরাসি ভোগট দম্পতিকে।
ফরম্যালডিহাইডে চোবানো লেনিনের মস্তিষ্ককে ওরা দু‘জনে বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে প্রায় কাগজের মত পাতলা ও অবিশ্বাস্য ৩১,০০০ টুকরোয় কেটে ফেলেন। এবং পরীক্ষা করতে থাকেন লেনিনের মগজের নানা দিক ও বৈশিষ্ট্য। তিন বছর গবেষণার পর ১৯২৯ সালে ভোগট দম্পতি ঘোষণা করেন, তারা সন্ধান পেয়েছেন লেনিনের প্রতিভার ঠিকানা। কি সেই বিশেষত্ব? বলশেভিক নেতার মস্তিষ্কে নাকি পিরামিড আকৃতির বিশেষ স্নায়ুকোষের পরিমাণ ছিল মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে বেশি। তার ফলে নাকি ব্রেন-এর আপাত-দূরবর্তী অংশের মধ্যে যোগাযোগ রচিত হত ব্যাপকভাবে। লেনিনের চিন্তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য, দ্রুত অনুধাবন ক্ষমতা এবং বিরাট অনুমানশক্তি তাই স্বাভাবিক ব্যাপার। ভোগট দম্পতির পাকা সিদ্ধান্ত: মহান নেতার জিনিয়াসের উৎস খুঁজে পাওয়া গেছে। লেনিনের মস্তিষ্কের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের রিপোর্ট গ্রথিত হয় চামড়ায় বাঁধানো চোদ্দো খণ্ডের বিশাল দলিলে! স্টেট সিক্রেট হিসাবে যা তালাবদ্ধ করে রাখা হয় ব্রেন ইনস্টিটিউটের আলমারিতে।
এত সেবার পরেও অবশ্য স্তালিনের নির্দেশে ১৯৩০ সালে মস্কো থেকে গলাধাক্কা খেতে হয় ভোগট দম্পতিকে। কেন? ওদের গবেষণার গতি-প্রকৃতি দেখে প্রমাদ গোনেন কমিউনিস্ট-স্বৈরশাসক স্তালিন। মানুষে-মানুষে জন্মগত পার্থক্য---ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়ই রাজা বা প্রজা হয়ে জন্মানো--- তো কম্যুনিস্ট মতবাদের পরিপন্থি। মস্তিস্ক গবেষণা স্তালিন বন্ধ করে দিতে চাইলেও তাঁর মৃত্যুর পর আবার শুরু হয় তা। ব্রেন ইনস্টিটিউটে এখন রাখা আছে অনেক খ্যাতনামা রুশ নেতার মস্তিষ্ক। স্তালিনের নিজের তো বটেই, এমন কি, বিক্ষুব্ধ বিজ্ঞানী আন্দ্রেই শাখারভেরও।
রুশ থেকে ইতালিতে ফিরে আসা যাক। গ্যালিলিও-এর পর মুসোলিনি। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আসন্ন পরাজয়কালে ফ্যাসিবিরোধীদের গুলিতে নিহত হন ইতালির ফাসিস্ট-স্বৈরাচারী বেনিতো মুসোলিনি। উত্তেজিত জনতা থুতু ছেটায় আর লাথি মারে তার মৃতদেহে। তারপর ঘৃণাভরে মিলান শহরের এক পার্কে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখে সেই শব। পাশে তেমনি করে ঝোলানো থাকে তার প্রেমিকার নিথর দেহ। মিত্রবাহিনীর অগ্রবর্তী অংশ হিসাবে মার্কিন সেনারা এসে যখন উদ্ধার করে মুসোলিনির দেহ, তখন থেতলে গেছে তার মাথার খুলি। তবু বহু কসরৎ করে তা থেকে তার ঘিলু বের করে সেনাবাহিনী পাঠায় বিজ্ঞানীদের কাছে। তাদের বলতে হবে, জিনিয়াস, পাগল না সিফিলিসের রুগী---এর কোনটা ছিলেন এই অত্যাচারী-যুদ্ধবাজ-স্বৈরশাসক।
যদি চেষ্টা চলে মুসোলিনির মাথার মধ্যে যুদ্ধোন্মাদনার বীজ খোঁজার, তাহলে যে বিজ্ঞানী মাত্র পাঁচটি চিহ্নের (ঊ=সপ২) একটি ফর্মুলা আবিষ্কার করে শেষ ঘণ্টা বাজিয়ে দিলেন সেই যুদ্ধোন্মাদনা কিংবা পৃথিবীকে টেনে নিলেন পারমাণবিক বিপদের ঘোরকৃষ্ণ-আতঙ্কের জগতে, তাঁর মস্তিষ্ক-পরীক্ষা তো লোভনীয় হতেই পারে!
১৯৫৫ সালের ১৭ এপ্রিল রাত ১টা ১৫ মিনিটে আমেরিকার প্রিন্সটন হাসপাতালে সেই বিখ্যাত আইনস্টাইনের মৃত্যু হলো। মৃত্যুর পরের ঘটনা রীতিমত বিস্ময়ের। মাত্র ৬ ঘণ্টা পরেই, ১৮ এপ্রিল সকাল বেলা প্রিন্সটন হাসপাতালে ঘটে গেল এক বিচিত্র ঘটনা। বেশ কিছুটা গোপনে। হাসপাতালের লবিতে ভিড় করে দাঁড়ানো রিপোর্টার, ক্যামেরাম্যান কিংবা আইনস্টাইনের অগণিত পরিচিতিজনের কেউ যার খবর পেলেন না। কী ঘটল সকলের অজান্তে! আইনস্টাইনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হল অটোপসি বা পোস্টমর্টেমের জন্য।
যে দেহ কাটাছেঁড়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন আইনস্টাইন এবং এজন্য নিষেধাজ্ঞা দিয়ে উইল পর্যন্ত করেছিলেন যিনি, তাঁর দেহের ওপর গোপনে এবার ছুরি চালালেন হাসপাতালের চিফ প্যাথলচিস্ট ডা. টমাস স্টোল্টৎজ হারভে। টেবিলের ওপর রাখা মহাবিজ্ঞানীর নগ্নদেহের ঘাড় আর গালের দিক থেকে মাথাটাকে কেটে দু‘ ভাগ করে ফেললেন তিনি। ধারালো ডাক্তারি অস্ত্র দিয়ে ছিন্ন করে দিলেন অনেকগুলো তন্ত্রী। তারপর নিখুঁতভাবে বের করে আনলেন আইনস্টাইনের মস্তিষ্কটা। কেন করলেন সেটা না-বললেও চলে।
যে বিজ্ঞানী তাঁর আবিষ্কারের এক ধাক্কায় পাল্টে দিয়েছেন পৃথিবীর সব হিসাব-পত্র, নতুন করে লিখেছেন বিজ্ঞানের নিয়ম-কানুন, তিনি নিজে যে মাথাটাকে বলতেন ‘চলন্ত ল্যাবরেটরি’, সে ব্রেন কতটুকু রহস্যপূর্ণ আর বৈশিষ্ট্যেভরা, সেটা না-দেখে তো চলে না! প্রতিভার কত ক্লু না-জানি লুকিয়ে আছে জেলির মতো থকথকে ১ কিলোগ্রাম ২৩০ গ্রাম ওজনের সেই বিশেষ পর্দার্থের মধ্যে---মগজ নামের আড়ালে।
অটোপসি রুমে ডা. হারভের পর ঢুকলেন চক্ষুবিশেষজ্ঞ ডা. হেনরি অ্যাব্রামস। সামান্য ছুরি চালিয়ে, আর তারপর আঙুল ঢুকিয়ে, তিনি তুলে ফেললেন আইনস্টাইনের উজ্জ্বল চোখ দুখানি। সেই চোখ, যাদের সম্পর্কে ফরাসি পত্রিকা ‘লা হিউম্যানি’ একদা লিখেছিল: ‘ওহ! সেই দুটি চোখ! যারা একবার দেখেছে তারা ভুলবে না কখনও। কী গভীরতা তাদের মধ্যে। মহাবিশ্বের রহস্য নিরন্তর খুঁজে বেড়ানোর অমলিন চিহ্ন রয়ে গেছে ওদের মধ্যে। ’
তারপরের ঘটনা আরও চাঞ্চল্যকর; আরও রহস্যাবৃত্ত। না, প্রিন্সটন হাসপাতালের দখলে থাকে নি আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক আর চোখ। ওগুলো ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে যায় দুই চিকিৎসক ডা. হারভে আর ডা. অ্যাব্রামস-এর। ডা. অ্যাব্রামস খ্যাতনামা চোখ দুখানি রাখেন নিউ জার্সির এক ব্যাঙ্কের সেফ ডিপোসিট লকারে। আর ব্রেন! আইনস্টাইনের শবদেহের খুলি থেকে বের করার পর যাতে তা নষ্ট না হয়ে যায় সেজন্য ডা. হারভে সেটাকে ডুবিয়ে রাখেন ফরমালিন-এর মধ্যে। আর তারপর নিয়ে আসেন নিজের বাড়িতে; একটি কার্ডবোর্ডের বাক্সে বন্ধ করে রেখে দেন তার গ্যারাজে। বছরের পর বছর ধরে গ্যারাজটিই হয়ে থাকে আইনস্টাইনের এককালের ‘চলন্ত ল্যাবরেটরি’র ঠিকানা।
এদিকে পাল্টাতে থাকে ডা. হারভের ঠিকানাও। প্রিন্সটন হাসপাতালের এক নার্সের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের জেরে সেখান থেকে বরখাস্ত হন তিনি। তারপর এক একজন স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে নতুন করে সংসার পাতার চেষ্টা চালিয়ে যান তিনি মার্কিন মুলুকের নতুন নতুন শহরে। সব জায়গাতেই নিভৃতে সঙ্গে থাকে তার ওই মহামূল্যবান সংগ্রহটি। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের এবং মিডিয়ার প্রায়-বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে থাকেন ডা. হারভে। কেবল মাঝে মাঝে কোনও কোনও অত্যুৎসাহী গবেষক তার পিছু ধাওয়া করে ঘটনার সঙ্গে তাকে জড়িয়ে ফেলতে চেষ্টা করেন। কখনও আইনস্টাইনের মগজ আর ডা. হারভের ব্যক্তিগত জীবনের বিচিত্র বিষয়াবলী নাড়া দেয় উৎসাহী পাঠককে।
জানা যায়, ডা. হারভে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের ২৪০টি টুকরো করেছেন। একেকটা স্যুগার কিউব সাইজের। সেগুলোর বেশ কিছু ডুবিয়ে রাখা আছে রাসায়নিক সেলোয়ডিন-এ। মগজের কিছু অংশ কাটা হয়েছে কাগজের মতন পাতলা করে। যাতে সেগুলো মাইক্রোস্কোপের তলায় রেখে ভালো করে পরীক্ষা করা যায়। কিন্তু সেই পরীক্ষার ফলাফল বলতে কিছুই জানা যায় না। ডা. হারভে নিরস কণ্ঠে যান্ত্রিকভাবে শুধু উচ্চারণ করেন: ‘শীঘ্রই পাঠাব গবেষণার জন্য’, ‘কথা হয়েছে অনেকের সঙ্গে, তবে ঠিক কাকে দেবো দু-একটা টুকরো, তা ঠিক করিনি এখনও’। এভাবে চলতে থাকে বছরের পর বছর, এমন কী, দশকের পর দশক!
মাঝখানে ডা. হারভের বিলম্ব, অজ্ঞাতবাস, রহস্যময়তার সুযোগে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের বিচিত্র নিরালম্ব অবস্থা নিয়ে লেখা হয়ে যায় চমৎকার দু‘টি বই। ‘আউটসাইড’ ম্যাগাজিনের প্রাক্তন সম্পাদক মাইকেল প্যাপারনিটির লিখেন ‘ড্রাইভিং মিস্টার আলবার্ট’ আর টরেন্টো থেকে প্রকাশিত ‘দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেল’ পত্রিকার মেডিক্যাল রিপোর্টার ক্যারোলাইন অ্যাব্রাহাম রচনা করেন ‘পজেসিং জিনিয়াস’।
নানা ভাবে নানা ব্যক্তি পৃথিবীর নানা স্থান থেকে প্রশ্ন তুলতে থাকেন, ডা. হারভে কি তবে চুরি করতে চেয়েছিলেন আইনস্টাইনের ব্রেন! নানা পরীক্ষার পর সবারই উত্তর: ‘মোটেই নয়’। পালিয়ে তিনি বেড়াচ্ছিলেন ঠিকই। তবে তার হেফাজতে থাকা মূল্যবান জিনিসটি চুরি করার অভিপ্রায় ও প্রচেষ্টা তার ছিল না। তা যদি থাকত তাহলে তিনি এতদিনের সঞ্চয়কে ক্রিস্টি বা সাদবি-এর নিলামে স্যুভেনির হিসাবে উচ্চমূল্যে বিকিয়ে দিতে পারতেন। বরং ৪৩ বছর নিজের কাছে আগলে রাখার পর ১৯৯৮ সালে ডা. হারভে তার মূল্যবান সংগ্রহটি ফিরিয়ে দিলেন সেখানেই, যেখান থেকে এর শুরু---প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টার-এর প্যাথলজিস্ট ডা. এলিয়ট ক্লাউস-এর কাছে। এই মুহূর্তে আইনস্টাইনের ব্রেন-এর ঠিকানা ওই চিকিৎসা কেন্দ্র, যেখানে প্রতিনিয়ত চলছে সেই মহার্ঘ্য বস্তুটিকে নিয়ে গবেষণা।
কী পাওয়া গেল ওইসব গবেষণায়!
বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখলেন, আইনস্টাইনের ব্রেন-এর চারটি অংশে নিউরন আর গ্লিয়া কোষের পরিমাণ। নিউরন হল স্নায়ুকোষ। আর গ্লিয়া হল আরেক ধরনের কোষ।
দেখা গেল, মহাবিজ্ঞানীর মস্তিষ্কের গ্লিয়া কোষের সংখ্যা সাধারণ মানুষের তুলনায় রীতিমত অনেক বেশি। ফলে আইনস্টাইনের চিন্তাশক্তি এবং একটু এগিয়ে ভাবার ক্ষমতা, অন্যদের চেয়ে বহুগুণ বেশি হতে বাধ্য। দেখা গেল, আইনস্টাইনের সেরিব্রাল করটেক্স-এ নিউরন-এর ঘনত্ব বেশি। তাঁর মস্তিষ্কের ওই অংশে এক ঘন সেন্টিমিটার আয়তনে অন্যদের তুলনায় বেশি সংখ্যায় নিউরন উপস্থিত। অতএব, আইনস্টাইনের বেশি ব্রিলিয়ান্ট হওয়া ভবিতব্য ছিল।
এটারও প্রমাণ পাওয়া গেল যে, আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের ওজন সাধারণ মস্তিষ্কের চেয়ে কম! সাধারণের বেলায় ওটার ওজন ১,৪০০ গ্রাম হলেও আইনস্টাইনের বেলায় তা ১,২৩০ গ্রাম। কম ওজনদার হলেও আইনস্টাইনের ব্রেন এক জায়গায় অন্যদের চেয়ে এগিয়ে। যেমন, মস্তিষ্কের দু‘টো অংশ---পেরিয়েটাল ওপারকুলাম আর ইনফিরিয়র পেরিয়েটাল লোব। কিন্তু আইনস্টাইনের বেলায় দেখা গেল, ওই পেরিয়েটাল ওপারকুলাম অংশটা অনুপস্থিত! আর ইনফিরিয়র পেরিয়েটাল লোব অন্যান্য মানুষের তুলনায় ১৫ শতাংশ বড়। এটা অবশ্যই বেশ অ্যাবনর্মাল ব্যাপার। ফলে আইনস্টাইনের ব্রেন-এ স্নায়ুকোষ বেশি ঘনভাবে সন্নিবিষ্ট। স্নায়ুকোষের বেশি ঠাসাঠাসি অবস্থান মানে তাদের মধ্যে বেশি যোগাযোগ। বেশি করে সঙ্কেতের আদান-প্রদান, যা মস্তিষ্কের দ্রুততা ও গতিশীলতার বহিঃপ্রকাশ।
বিশ্ববিখ্যাত তত্ত্ব ‘স্পেশাল রিলেটিভিটি’র আসল আবিষ্কারক আলবার্ট আইনস্টাইন। কিন্তু এ আবিষ্কারের লক্ষ্যের দিকে বহু দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন আরও চার জন বিজ্ঞানী। কিন্তু সবাইকে পিছনে ফেলে হঠাৎ বিজয়ের দৌড়ে ফিতে ছুঁলেন আরেকজন---আইনস্টাইন। স্পেশাল রিলেটিভিটি আবিষ্কারে তাঁর কৃতিত্ব অভাবনীয় এই কারণেই যে, অপরাপর বিজ্ঞানী ও প্রতিদ্বন্দী মিংকোস্কি, হিলবার্ট, লাঁজভা কিংবা পঁকারে-এর মত তিনি নন। তিনি যুক্ত ছিলেন না কোনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেমন ছিলেন অন্য চারজন। গবেষণার জগৎ থেকে দূরের এক সরকারি অফিসে বসে আইনস্টাইন কিন্তু টেক্কা দিলেন ওদের সবাইকে। এমন মানুষ জিনিয়াস তো বটেই।
তাই আইনস্টাইন এবং তাঁর মতো অন্যান্য ক্ষেত্রে জিনিয়াস-প্রতিভার ক্লু খুঁজে পাওয়ার জন্য বিজ্ঞান-গবেষকদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় মূল শিকড়ের সন্ধানে অনাদী কাল ধরে চলছে খ্যাতিমানদের মরদেহকে কেন্দ্র করে অন্য এক ধারার ‘দেহ ব্যবসা’!
ড. মাহফুজ পারভেজ: কবি ও লেখক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনারত,
mahfuzparvez@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৫, ২০১৭
জেডএম/