সঠিকভাবে বললে ন্যানো হলো দৈর্ঘ্যের একটা মাপ, এক মিটারের একশো কোটি ভাগের এক ভাগকে এক ন্যানোমিটার বলা হয়। এভাবে ব্যাখ্যা করা হলে ন্যানোর আংশিক চিত্র পাওয়া গেলেও প্রকৃত চেহারাটা স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে না।
অনেক উপাদান রয়েছে, যা ন্যানোর মাপের বাইরে থাকে এবং অত ক্ষুদ্র এককে পরিমাপযোগ্য নয়। যেমন, ফুলের পরাগরেণু, বালির কণা, এমনকি, মানুষের শরীরের বিভিন্ন রকমের কোষও মাইক্রোর মাপের মধ্যে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, লোহিত রক্ত কণিকার ব্যাস ২.৫ মাইক্রোমিটার বা মাইক্রো; মানুষের চুলের ব্যাস ৫০-৬০ মাইক্রো। খালি চোখে মোটামুটি দশ মাইক্রো পর্যন্ত দেখা যায়।
এবার আসা যাক তারচেয়েও ছোট মাপের ন্যানোর প্রসঙ্গে। ১০০০ ন্যানোমিটারে এক মাইক্রোমিটার। সুতরাং ন্যানো এতো ক্ষুদ্র যে মানুষের দৃষ্টি ক্ষমতার অনেক অনেক নিচে এই ন্যানো-মাপের বস্তুদের জগৎ। এক ন্যানোমিটারের নিচে নামলে বলতে গেলে অণু-পরমাণুদের জগতের কাছাকাছি পৌঁছা সম্ভব। যেমন, সর্বক্ষুদ্র হাইড্রোজেন পরমাণুর দশটিকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিলে এক ন্যানোমিটার হয়ে যাবে। এক থেকে একশ ন্যানো মাপের যাবতীয় বস্তুর প্রকৃতি, তাদের আচার-আচরণ খুঁটিয়ে দেখা, নিয়ন্ত্রণ করা আর অবশেষে তাকে ব্যবহারিক জীবনে কাজে লাগানোÑ এসবই ন্যানোবিজ্ঞানের কাজ।
ন্যানোর জগৎ কিংবা আরও বিস্তারিতভাবে ন্যানোবিজ্ঞানের কাজ-কারবারই বিচিত্র ও রহস্যপূর্ণ। একশো ন্যানোর নিচে গেলে পদার্থের আচার-আচরণ অদ্ভুত রকমভাবে বদলে যায়। যেমন ধরা যাক, স্বর্ণ বা সোনার কথাই। এমন যে ঝকঝকে ধাতু সোনা, এর কণিকাকে ছোট থেকে আরও ছোট মাপে নিয়ে যেতে থাকলে এক সময় এর এই সোনালি রঙ বদলে গিয়ে লাল, নীল, সবুজ-নানা রকমের রঙ দেখা যায়। তখন সোনার কণার মাপ বা ব্যাস ছোট বড় করে বা তার আকার বদলে দিয়ে তার রঙ এবং আরও কিছু বৈশিষ্ট্যকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবে পুরো খেলাটাই চলবে ন্যানোমিটার সীমার মধ্যে। একশো ন্যানোমিটারের ওপর গেলে আর এইসব বৈশিষ্ট্য কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। তখন সোনা আবার পূর্ব-ধর্মে ফিরে আসে।
সোনার এই পরিবর্তমান ধর্ম কিন্তু নতুন নয়। মধ্যযুগে কাচ কিংবা চিনামাটির পাত্রে যেসব ছবি আঁকা হয়েছে, তাতে সোনার এই নানা রকম অন্তর্নিহিত রঙ ব্যবহৃত হয়েছে। তখন হয়তো কারণটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানা যায়নি। তবে প্রমাণিত হলো যে, মূল বস্তু অতিশয় ক্ষুদ্র স্তরে চলে গেলে মূল বৈশিষ্ট্য ক্ষুণœ হয়। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও পদ্ধতি আবি®কৃত হওয়ায় ন্যানোবিজ্ঞানের সাহায্যে এখন ইচ্ছা মতো মাপে সোনার কণিকাকে তৈরি করা যাচ্ছে আর তার বৈশিষ্ট্যগুলোকে নানাভাবে অদল-বদল করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যাচ্ছে। এই হলো ন্যানোপ্রযুক্তির অবদান। অর্থাৎ একটি বস্তু শুধু ছোট করা হলেই হবে না, ততোটুকুই ছোট করতে হবে, যাতে তার মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যা বড় আকারের বস্তুটির মধ্যে দেখা তো দূরের কথা, কল্পনাও করা যায় না। এই ধরনের রূপান্তরিত বস্তুকেই ন্যানোমেটিরিয়াল বলা যাবে।
শুধু সোনা নয়, ন্যানোমেটিরিয়ালে রূপান্তরিত হলে অনেক বস্তুরই রূপ-চারিত্র্যের বিপুল তারতম্য ঘটে। সোনার কণিকার রঙ বদলের মতোই তামা হয়ে যায় স্বচ্ছ, কুপরিবাহী সিলিকন তড়িৎ পরিবহন করে আর নিষ্ক্রিয় ধাতু প্ল্যাটিনাম অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে অনুঘটকের কাজ করে। এ কারণেই মজা করে বলা হয়, ন্যানোবিজ্ঞান মানে হলো পদার্থের ধর্ম সম্পর্কে যা জানেন তা ভুলে গিয়ে নতুন করে শেখা; নতুন বস্তুজগতের গহীন রহস্যের সীমানায় পৌঁছে যাওয়া। এইক্ষেত্রে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে: কোনও বস্তুর আকার সাধারণ অবস্থা থেকে কমতে কমতে ‘মাইক্রোমিটার’ সীমা পর্যন্ত চলে গেলেও কিন্তু পরিবর্তন তেমন বোঝা যায় না। বস্তুর আয়তন, সঠিকভাবে বললে তিনটি মাত্রার (থ্রি-ডাইমেনশন) অন্তত যেকোনো একটি মাত্রায় কমে ১০০ ন্যানোমিটারের (০.১ মাইক্রোমিটার) নিচে নেমে গেলে তবেই এই বিশেষ পরিবর্তন অনুভব করা যায়। এজন্যই ন্যানোমেটিরিয়ালের সংজ্ঞায় ১০০ ন্যানোমিটারের সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, আয়তন বা মাত্রা একশো ন্যানোমিটারের নিচে নেমে গেলে বস্তুর মধ্যে এমন আশ্চর্যজনক পরিবর্তন ও আচরণ দেখা যায় কেন? সহজ উত্তর হলো: এই ক্ষুদ্রতম মাত্রায় পৌঁছুলে পদার্থের আচরণে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বড় মাপের পদার্থের ধর্ম, বৈশিষ্ট্য ও আচরণ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠিত-নিত্যদিনের উপলব্ধির ভিত্তিতে অণু-পরমাণু মাপের জগতের কাণ্ড কারখানা বিচার-বিবেচনা করা এক কথায় অসম্ভব। অন্যভাবে বললে, সূক্ষ্ম পদার্থের জগৎ মানুষের দৃশ্যমান এবং অভিজ্ঞতালব্ধ জগৎ ও ধারণার সঙ্গে কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। যেমন, ন্যানোতত্ত্বের প্রথম ধাপেই মনে করা হয় যে, বস্তুর কিছুটা তরঙ্গ-ধর্ম বা কম্পন-প্রবণতা রয়েছে। বাস্তবে যেটা একেবারেই ভাবা যায় না। একটা ক্রিকেট বই, কোনো পত্রিকা বা বই, অথবা আপনি নিজে ঢেউয়ের আকারে বিরাজমানÑ এটা মেনে নেওয়া আসলেই বেশ কষ্টকর এবং দুঃসাধ্যও বটে। কিন্তু একটা ইলেক্টনের বেলায় ব্যাপারটা স্পষ্ট।
সাধারণ বিজ্ঞানের লজিক বলছে, আপনি যতোটুকু লাফাতে পারেন, তার চেয়ে উঁচু একটা দেয়ালের ধারে যদি দাঁড়িয়ে থাকেন, তবে বাস্তবে আপনার পক্ষে দেওয়াল পেরিয়ে ওপাশে যাওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। কিন্তু কোয়ান্টাম জগতের নিয়মানুসারে আপনাকে দেয়ালের ওদিকেও যাওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা রয়ে গেছে- এই ঘটনাকে বলা হয় ‘ট্যানেলিং এফেক্ট’। এই রকমের বহু অদ্ভুত ধারণা আর নিয়মকানুন নিয়ে কোয়ন্টাম মেকানিক্সের রহস্যময় জগৎ। এর তাত্ত্বিক কাঠামো মানুষের রোজকার জীবনের চোখে দেখা-কানে শোনা অভিজ্ঞতার ঘোরতর বিরোধিতা করে। কিন্তু বস্তু ছোট হতে হতে অণু-পরমাণু-প্রোটন-ইলেকট্রনের জগতে প্রবেশ করলে মানুষের অদেখা-অজানা ধ্যান-ধারণা-তত্ত্ব-আচরণ-বৈশিষ্ট্য সেখানে অবলীলায় এবং স্বাভাবিকভাবেই কাজ করে। ন্যানোমিটার মাপের বস্তুরা হলো সেই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জগতে পৌঁছুবার প্রথম দরোজা-যেখান থেকে পরিবর্তন বা রূপান্তরের আঁচটুকু মানুষের ইন্দ্রিয় ও অনুভূতিতে এসে লাগতে থাকে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, কেন এতো ছোট-সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জিনিসপত্রের দরকার হলো? বাস্তব জীবনে আমরা তো চোখের দেখা আর হাতের ধরার মধ্যকার জিনিস দিয়েই নিত্যকার কাজ-কারবার দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছি। তাহলে আবার ন্যানোর অতি ক্ষুদ্র জগতে প্রবেশের প্রয়োজন হলো কেন? এক কথায় এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। খানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দরকার আছে বৈকি। উদাহরণস্বরূপ রোজকার ব্যবহারের জিনিসপত্র দিয়েই শুরু করা যাক। এক সময় কম্পিউটার বলতে ঘরময় অনেকগুলো বড়মাপের যন্ত্রসমষ্টিকেই কল্পনা করা হতো। একইভাবে ছবি তোলার ক্যামেরার কথাও ধরা যায়। একদা ছবি তোলা মানে ছিল ইয়াবড় এক ক্যামেরাকে তে-পায়ার উপর দাঁড় করিয়ে কালো কাপড়ে ঢেকে এক হই-হই ব্যাপার। বিরাট বড় থালার মতো লং প্লেয়িং রেকর্ডের দুই দিকে মাত্র দু’টো গান শোনা যেতো- এখন একটি ছোট্ট ডিভিডিতে হাজার খানেক গান অনায়াসে শোনা যায়। এখন ছোট্ট কম্পু মানুষের কোলে বসে হাজার রকমের কাজ করে দিচ্ছে। টেলিফোন ছোট হতে হতে হাতের আঙুলের প্রতিবেশী হয়ে গেছে। এমনকি, ক্যামেরা, ভিডিও পর্যন্ত ঢুকে গেছে ওই মুঠোফোনে- কলমের খাপ কী চাবির রিং-এর মধ্যে। সিগারেটের বাক্সের মাপের আইপডে-এমপি প্লেয়ারে শত শত গান-ছবি ধরে যাচ্ছে। আকারে ছোট হওয়ার পাশাপাশি এই সব যন্ত্রের কার্যকারিতাও যে বেড়েছে অনেকভাবে আর দামও যে কমেছে অনেকখানি, সে কথা এখন আর কাউকে বলে দিতে হয় না। এই সবকিছুর পেছনে রয়েছে সিলিকন মাইক্রোচিপ নামক বস্তুটির আগমন এবং তার উত্তরোত্তর উন্নতি। অর্থাৎ একটি মাইক্রোচিপের মধ্যে কতোগুলো ট্রানজিস্টরকে ধরানো যায়, সেই সংখ্যাটির উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়া। নামকরা প্রস্তুতকারক ইনটেল কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার গর্ডন মুর এই বিষয়ে একটি মজার সূত্র দিয়েছেন। তার মতে, মাইক্রোচিপের মধ্যে ট্রানজিস্টারের সংখ্যা গড়ে প্রতি দেড় বছরে দ্বিগুণ হয়ে যায়। অর্থাৎ গবেষকদের কঠোর পরিশ্রমে পনেরো বছরে এই সংখ্যাটি এক হাজার গুণ বাড়ছে। এটা যদিও প্রকৃত অর্থে ঠিক বৈজ্ঞানিক সূত্র নয়, পর্যবেক্ষণভিত্তিক একটি ভবিষ্যদ্বাণী মাত্র, তথাপি এই সূত্রটা চমৎকারভাবে কাজ করছে অনেক দিন ধরেই- বলা ভালো বিজ্ঞানীরা আর বড়সড় কোম্পানির প্রযুক্তিবিদরা এই সূত্রকেই তাদের লক্ষ্যমাত্রা করে ফেলেছেন। তাই প্রথম মাইক্রোচিপে যেখানে বাইশশো ট্রানজিস্টার ছিলো, সেখানে এখন থাকে কোটিখানেক! বিগত বছরগুলোকে কম্পিউটার, টেলিভিশন, ক্যামেরা বা টেলিফোন-যাবতীয় বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির যে বিপুল উন্নতি ঘটেছে, তার মূলে আসলে রয়েছে এই ক্ষুদ্রতর সিলিকন চিপ-এর বৈপ্লবিক অবদান।
বাংলাদেশ সময়: ০৫৩৭ ঘণ্টা, মে ০২, ২০১৭
এসএনএস