ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মিসরের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা

আমিনূল মোহায়মেন, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০১২
মিসরের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা

মিসরে কাটিয়েছি জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময়। উল্লেখযোগ্য শুধু বছরের হিসেবে নয়, বরং তার চেয়ে বেশি সময়টার কারণে।

সেটি ছিল জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান, সবচেয়ে মধুর, যা দেখি তাই ভালো লাগার সময়।

তারুন্যের ৭টি বছর - বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ বছর আর প্রথম চাকুরীর ২ বছর কাটিয়েছি মিসরে। কায়রোর রাস্তাঘাট, অলি-গলি যতটা চিনেছি, তার অর্ধেকও চিনতে পারিনি ঢাকাকে। সেই ২০ বছর আগের মিসর আমাদের কাছে ছিল শান্তি আর নিরাপত্তার প্রতীক। গ্রীস্মের দীর্ঘ ছুটিতে আমরা গভীর রাত পর্যন্ত নীল নদের ধারে বা কারো বাসায় আড্ডা দিতাম। তারপর রাত ২-৩টায় হোস্টেলে ফিরতাম। সেই রাতেও দেখতাম ছেলে-মেয়েরা হাত ধরাধারি করে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

মিসরীয়রা আলস্যপ্রিয়। কায়রোর গলিতে গলিতে দেখা যায় আয়েশ করে হুকা টানতে। ছোট শহর ও গ্রামগুলোতে তো আরো বেশী। মনে হবে যেন চিন্তাহীন, তাড়াহীন একটি নিরিবিলি শান্তির শহর।

চাকুরীকালে থাকতাম তাহরীর স্কয়ারের কাছেই।   প্রতিদিন অন্ততঃ দুইবার তাহরীর স্কয়ারের সাথে দেখা হতো। বছর দেড়েক আগে সেই তাহরীর স্কয়ারে যখন বিক্ষোভ শুরু হলো, রক্তপাত শুরু হলো - তখন এই প্রিয় দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। মনে হয়েছিল, তাহলে কি মিসর আরেকটি ইরাক বা লিবিয়া হতে যাচ্ছে?

মিসরের একটি অগ্নিগর্ভে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই ছিল, এবং এখনও রয়ে গেছে। দেশটির রয়েছে ইসরাইলের সাথে অনেক বড় সীমানা। মিসরই ইসরাইলের সাথে যুদ্ধ করেছিল দুইবার। দেশটির রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী। অর্থাৎ মিসরের উপর ইসরাইলের অস্তিত্ব অনেকাংশেই নির্ভর করছে।

তাহরীর স্কয়ারের বিপ্লবের পরবর্তী দেড় বছর কেটেছে নানা টানাপড়েনে। অবশেষে মুসলিম ব্রাদারহুড প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণার ফলে উত্তেজনা কিছুটা কমেছে। আপাত: সংঘাত এড়ানো গেছে। কিন্তু, মিসরের রাজনীতি, সমাজ, সেনাবাহিনী, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ইত্যাদি বিবেচনা করলে একটি সংঘাতময় ভবিষ্যতের আশঙ্কা থেকেই যায়। যেমন-

১. মিসরীয়রা ধর্মীয় শাসনের জন্য তৈরী নয়:

মিসরীয়দেরকে কেউ কেউ আপাতদৃষ্টিতে ধার্মিক (এবং সে কারণে ধর্মীয় আইনের সমর্থক) মনে করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। এ প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কোন এক ছুটিতে একজন মিসরীয় সহপাঠীর সাথে তার বাড়ীতে গিয়েছিলাম বেড়াতে। শহরটির নাম মনুফেইয়া। সে রাতে সিনেমা দেখাতে নিয়ে গেলো। তখনও মিসরীয় সিনেমার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল ব্যালে ড্যান্স। নাচের একটি ক্লাইমেক্স মুহূর্তে একজন জোরে চিৎকার করে উঠলো `আল্লাহু আকবর` বলে। আমি অবাক হয়ে বন্ধুটির কাছে কারণ জানতে চাইলে সে জানালো কোন মনোমুগ্ধকর বা আশ্চর্য কিছু দেখলে বা শুনলে মিসরীয়রা `আল্লাহু আকবর` বলে। মিসরে আমার চাকরি জীবনের অধিকাংশ নারী সহকর্মী ছিল যথেষ্ঠ আধুনিকা। তারা বারে যেতো, বয় ফ্রেন্ডকে নিয়ে ছুটিতে চলে যেতো ফ্রান্স বা ইতালি। আবার তারা রমজানে রোজা রাখতো। মাঝে মাঝে নামাজও পড়তো। কায়রোর রাস্তায় যতটা হিজাব পরিহিতা নারী দেখা যায় তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি মিনি স্কার্ট পরা নারীরা চলাচল করে। আমার মনে হয় না দেশটি এখনো ধর্মীয় শাসনকে মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছে।

২. হোসনি মোবারক এখনও জনপ্রিয়:

হোসনি মোবারক তার ত্রিশ বছরের শাসনকালের প্রথম ১৪-১৫ বছর যথেষ্ঠ জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত দেখেছি সাধারণ মিসরীয়রা তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেছে, কিন্তু, স্বীকার করেছে যে, তিনি দেশটা খারাপ চালাচ্ছেন না। সেই সময় মিসরের অর্থনীতি স্থিতিশীল ছিল, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো ছিল, আরব বিশ্ব এবং পাশ্চাত্যের সাথে মিসরের লাভজনক কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিল। সে সময় মিসর মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্ব দিয়েছে। পরবর্তীতে অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা খারাপ হতে থাকে। কিন্তু মোবারকের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা সম্ভবত খুব বেশি কমেনি। জুনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মোবারক সমর্থিত প্রার্থীর ৪৮% ভোট পাওয়া তারই প্রমাণ দেয়।

৩. সামরিক বাহিনীর প্রভাব:

সমস্যা তৈরি হয় যখন মোবারক তার ছেলে গামালকে উত্তরসূরি নির্ধারণ করেন এবং তার অসুস্থতার সুযোগে পরিবারের সদস্যরা রাষ্ট্রের সবখানে খবরদারি শুরু করেন। তাতে সবচেয়ে বেশী রুষ্ট হয় সেনাবাহিনী। তাদের ধারণা ছিল, মোবারকের পর তাদের মধ্য থেকে কেউ একজন মিসরের হাল ধরবেন। স্বাধীনতার পর থেকে সেনাবাহিনীই দেশ চালাচ্ছে। মোবারক পরিবারের সাথে তাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে তাহরীর স্কয়ারের অভ্যূত্থান ঘটে। এ অভ্যূত্থানের পিছনের শক্তি ছিল সেনাবাহিনী। মিসরে সাধারণ জনগণের উপর সেনাবাহিনীর একটি শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। দেশটিতে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক সক্ষম পুরুষের জন্য এক বা দুই বছর (বিভিন্ন বিষয়ের উপর নির্ভর করে) সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। এর ফলে প্রতিটি নাগরিকেরই রয়েছে সেনাবাহিনীর প্রতি এক ধরণের মনস্তাত্বিক আনুগত্য। তাছাড়া বিগত ৫০ বছর ধরে রাষ্ট্র পরিচালনার কারণে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উপরও রয়েছে তাদের নিয়ন্ত্রণ। বলা যায় ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সমাজের উঁচু তলাতে এখনো জেনারেলদের প্রচুর প্রভাব রয়েছে। বিভিন্ন কারণে সামরিক বাহিনী মুসলিম ব্রাদারহুডকে ক্ষমতায় রাখতে চাইবে না। একদিকে যেমন তারা এই ধর্মীয় দলটির উপর গত অর্ধ শতক ধরে নির্যাতন করে এসেছে এবং তার প্রতিশোধের ভয় তাদের থাকতে পারে, তেমনি মিসরীয় সেনাবাহিনী অনেকটাই আমেরিকার কাছে আর্থিকভাবে জিম্মি। আমেরিকার বৈদেশিক সাহায্যের এক-তৃতীয়াংশ যায় ইসরাইল ও মিসরে। ইসরাইল পেয়ে থাকে ৩.২ বিলিয়ন এবং মিসর পায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার (এর মধ্যে ১.২ বিলিয়ন যায় সেনাবাহিনীতে)। মিসরীয় সেনাবাহিনী এই অর্থ দিয়ে শুধু যে অস্ত্র কেনে তাই নয়, এই অর্থের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যায় জেনারেলদের পকেটে, অস্ত্র কেনার কমিশন হিসাবে।

৪. ইসরাইলের প্রভাব:

মিসরে রয়েছে ইসরাইলের দূতাবাস, রয়েছে ইসরাইলের সাথে দীর্ঘ সীমান্ত। মিসরের বিগত দুটি প্রেসিডেন্টের (হোসনি মোবারক এবং আনোয়ার সাদাত) স্ত্রী ছিলেন বৃটিশ বংশোদ্ভুত। মিসরে এই ধরণের ধারণা প্রচলিত ছিল যে তারা দুইজনেই (স্ত্রীরা) ছিলেন ইহুদী । ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে মিসরের পরাজয়ের পিছনে অনেকেই দেশটির শীর্ষ সেনা অফিসারদের    রহস্যময় পদক্ষেপকে দায়ী করেন। মোদ্দাকথা, মিসরীয় সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য সকল অঙ্গনে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থার প্রভাব সকলেই স্বীকার করেন। এমনকি স্বাভাবিকভাবেই সেখানকার ধর্মীয় দলগুলোও এর বাইরে নয়।

৫. মুসলিম ব্রাদারহুডের সীমিত জনপ্রিয়তা:

মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড একটি শক্তিশালী সংগঠন হিসাবে থাকলেও সাধারণ জনগণের ব্যপক সমর্থন আগে কখনো পায়নি। দলটি কখনোই নির্বাচনে ২০% এর বেশি আসন পায়নি। তাছাড়া তাহরীর স্কয়ারের বিপ্লবেরর পর পরই যে নির্বাচন হয় তাতে দলটি (২২ দলীয় জোট) পেয়েছিল ৩৭.৫% ভোট।

৬. ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের থেকে আশঙ্কা:

মিসরের পার্লামেন্ট নির্বাচনে কট্টরপন্থী জোট আল-নূর পেয়েছিল ২৭.৮%। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তারা ড. মুরসীকে সমর্থন দেয়।

মিসরে ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের বিষয়টি আমার কাছে সব সময়েই আশঙ্কাজনক মনে হয়। এই কট্টরপন্থীদের কারণে মিসরে সেনা শাসন দীর্ঘায়িত হয়েছে। এরা যেমন অন্য দলগুলোতে রয়েছে, তেমনি রয়েছে মুসলিম ব্রাদারহুডেও। তারাই হত্যা করেছিল আনোয়ার সাদাতকে। আবার বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা, এমনকি অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থাও এদের মুখোশ পরে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাতে পারে।

মিসরের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের প্রথম কয়েকদিনের বক্তৃতা ও কর্মকান্ডে মনে হচ্ছে তিনি সকলকে সাথে নিয়েই কাজ করতে চেষ্টা করছেন। তিনি একজন খ্রীষ্টান ও একজন মহিলাকে তার ভাইস-প্রেসিডেন্ট করার ঘোষণা দিয়েছেন। এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। মোবারক অনেকটা এই পথে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন। তবে ড. মুরসী ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের মন রক্ষা করারও চেষ্টা করছেন, তার ফল কতটুকু ভালো হবে তা জানার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে তিনি যদি ইরানের মত আক্রমনাত্মক পররাষ্ট্রনীতি না গ্রহণ করেন এবং ধর্মীয় আইন প্রচলনের চেয়ে জনগণের জীবনমান উন্নয়নের দিয়ে জোর দেন, তাহলে হয়তো মিসর সত্যিকার গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারবে।

বাংলাদেশ সময় ১১৪৪ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০১২
এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।