ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

দুজন ব্রিটিশ মন্ত্রী, গণমাধ্যম এবং বাংলাদেশ

ফারুক যোশী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩১, ২০১২
দুজন ব্রিটিশ মন্ত্রী, গণমাধ্যম এবং বাংলাদেশ

ব্রিটিশ সরকারের চিফ হুইপ অ্যান্ড্রু মিশেল  ক‘দিন আগে এক সন্ধ্যায় সাইকেল চালাচ্ছিলেন। এসময় চিফ হুইপ তার বাইক চালাতে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের একটি গেইট খুলে দিতে বলেন নিরাপত্তা-পুলিশকে।

১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটের প্রধান ফটক খুলে দিতে আইনি বাধা থাকায় পুলিশ এ ফটক খুলে দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মিশেল একপর্যায়ে নিরাপত্তা রক্ষিকে গালি দেন। ব্রিটিশ জনগণের চার অক্ষরের একধরনের একটি খিস্তি শব্দ ব্যবহার করার পাশাপাশি তাকে প্লেবস বা নিম্নশ্রেণির লোক হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। পরদিন এ দেশের বহুল প্রচারিত সান পত্রিকায় এ নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। চিফ হুইপ তো বটেই, সরকারও পড়ে যায় গ্যাঁড়াকলে। মেট্রোপলিটান পুলিশের চেয়ারম্যান জন টুলি প্রকাশ্যে এর সমালোচনা করেন। ডেভিড ক্যামেরন ডেকে পাঠান অ্যান্ড্রু মিশেলকে। মিশেল ক্ষমা চান। কিন্তু দমে নেই পুলিশ বিভাগ। চেয়ারম্যান জন টুলি বলছেন, অ্যান্ড্রুর এরকম ব্যবহারের পর তিনি একজন মন্ত্রীর মর্যাদায় থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন। তাকে পদত্যাগ করতে হবে। কারণ একজন নিরাপত্তা-পুলিশ তার কর্তব্যে অবহেলা করেননি, তিনি অ্যান্ড্রুকে এই বিখ্যাত ফটকটি খুলে দেন নি। এটাই একজন রাষ্ট্রের কর্মচারীর দায়িত্ব। অ্যান্ড্রু যা করেছেন, তা একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে তার দায়িত্ব পালনে বাধা দান। এর মধ্য দিয়ে তিনি প্রকারান্তরে আইন অমান্য করেছেন। অতএব রাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা হিসেবে তার কার্যক্রম ঐদিন ছিলো নিম্নমানের।

২) ব্রিটিশ চ্যান্সেলর জর্জ অসবর্ন গত মাসের ১৯ তারিখ হঠাৎ করে ট্রেন স্টেশনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। তিনি জানতেনই না কিজন্যে সাংবাদিকরা ঘিরে ধরেছে তাকে। যখন জানলেন তখন আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা।
দুনিয়াতে মশহুর হয়ে গেছে তিনি ট্রেনে বসে তার মহিলা এইডের (পিএ)সাথে ভিডিও গেম দেখছেন, হাসছেন। এমন সময় টিকেট চেকার এসে তাকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। স্ট্যান্ডার্ড ক্লাসের টিকেট কেটে তিনি এবং তার এইড প্রথম শ্রেণিতে গিয়ে বসেন। নিয়ম অনুযায়ী স্ট্যান্ডার্ড ক্লাসের যাত্রী ঐ আসনেই বসবেন। কিন্তু তিনি বসেছিলেন প্রথম শ্রেণির কামরায়। টিকেট চেকার তাকে স্ট্যান্ডার্ড ক্লাসে যাবার অনুরোধ করলে তার এইড বলে ওঠেন, চ্যান্সেলরের সাধারণ মানুষের সাথে ট্রেন জার্নি করা কি উচিৎ হবে? কিন্তু টিকেট চেকার মানতে নারাজ। তিনি তাকে স্ট্যান্ডার্ড ক্লাসে ফিরে যেতে চাপ দিতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত এখানে বসেই তাকে ১৬৯ পাউন্ড দিয়ে তাদের টিকেট আপগ্রেড করতে হয। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার হয়ে গেছে। কারণ ট্রেনে এই নাটক যখন চলছিলো, তখন ঐ কামরায়ই বসেছিলেন আইটিভি গ্রানাডার সাংবাদিক রেইচেল টাউনল্যান্ড। তিনি নাটকের কথোপকথনগুলো টুইট করছিলেন টুইটারে। নিমিষেই ছড়িয়ে যায় সারা ব্রিটেনে, এমনকি বিশ্বে।  

আইন অনুযায়ী একজন যাত্রী তার টিকেট আপগ্রেড করতে পারেন, কিন্তু তার স্ট্যান্ডার্ড ক্লাস আসনে বসেই এটা করা আইনের কাজ।

জর্জ অসবর্ন শুধু নন, এমনকি সরকার এ নিয়ে বিব্রত-সমালোচিত। বিরোধী দল ছেঁকে ধরেছে। ক্ষমা চেয়ে শেষ রক্ষা পেলেই এখন বাঁচে ডেভিড ক্যামেরন সরকার।

৩)  বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিতে একজন মন্ত্রী লাখো মানুষের সামনে গালি দিতে পারেন। চোখ তুলে আনার দম্ভোক্তি করতে পারেন তিনি অবলীলায়। টিভির বিখ্যাত টকশোগুলোতে মানুষের প্রত্যাশা কি থাকে? মন্ত্রীর গালি শোনা (!) ঈদে মানুষের নিরাপদ বাড়ি যাবার জন্যে যে টকশো, যে টকশোতে মানুষ নিরাপদ বাড়ি যাবার আশ্বাস পাবে, সেখানে লাখ লাখ মানুষ শুনলো কিভাবে একজন মন্ত্রীর রোষানলের কাছে একজন বিরোধী নেতাও নিরাপত্তাহীন। সভ্যতার সব শব্দ ভুলে গিয়ে কিভাবে হারিয়ে গিয়ে রাষ্ট্রের কর্ণধারদের একজন এভাবে বেসামাল হয়ে যান, তা আমাদের প্রশ্নের মুখোমুখি করে ফেলে। এতদিন পর প্রধানমন্ত্রীই বা কি করলেন এ নিয়ে। না-কি বিরোধী দলীয় নেতা মওদুদ আহমদের কথার রেশ ধরেই বলতে হয়, "ওয়েল ডান মিস্টার মিনিস্টার"। আসলে মন্ত্রী আরেকজন ব্যারিস্টারকে শাসিয়ে দিয়ে সতর্কীকরণ বার্তা পাঠালেন জনগণের কাছে। কোনো সমালোচনা নয়, কোনো তর্ক নয়, এ সতর্কীকরণ বার্তায় আছে চুপ থাকার নির্দেশ। কথা না বলার তর্জনী উত্তোলন, এটা যেন জাতিরই প্রতি।

৪) একটা গণতান্ত্রিক দেশে কথা বলার অধিকার আছে সকলের। গণতান্ত্রিক জোট গঠনের অধিকার আছে বড় দলগুলোর। যেমন আওয়ামীলীগের আছে মহাজোট। বিরোধীদলেরও আছে ঐক্যজোট। জোট গঠনের অধিকার থাকতেই পারে সকলের। ভারতেও হয় জোট গঠন। কংগ্রেস করে, বিজেপি জোট গঠন করে। এমনকি জোটের মাঝে থাকে মার্কসবাদী দলগুলোও। এমনকি ব্রিটেনেও এবার সরকার চালাচ্ছে কনজারভেটিভ আর লিবারেল পার্টির সম্মিলিত জোট। আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্য নিয়ে কিংবা সরকার আরও সুসংগঠিতভাবে পরিচালনার জন্যে জোট গঠিত হয় পৃথিবীর দেশে দেশেই। আর সেই হিসেবে  নতুন কোনো জোট গঠন করে একটা সম্মিলিত শক্তি সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা এখন কি অস্বীকার করা যাবে বাংলাদেশে? অধিকার আদায়ে জোট একটা সহায়ক শক্তি। এই সহায়ক শক্তি হিসেবেই হয়ত স্বনামধন্য আইনজীবী রাজনীতিবিদ ড: কামাল হোসেন কিংবা বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট বদরুদ্ধোজা চৌধুরী জোট গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। দেশে যেখানে মন্ত্রী টকশোতে হম্বিতম্বি করেন, তখন এদেশে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা যে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তা বলতেই হয়। এই সময়ে বর্ষীয়ান রাজনীতিকদের এ জোট গঠন কনোন ইতিবাচক ধারা আনতেই পারে রাজনীতির অঙ্গনে। কিন্তু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফ এই জোট গঠন নিয়ে যখন প্রশ্ন তোলেন, বলেন প্রয়োজনে এদের প্রতিহত করা হবে, তখন তো এরকম জোট গঠনের প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়ে যায়। কারণ গণতান্ত্রিক ধারা মূলত ব্যাহত হলেই এরকম কথাবার্তা বেরিয়ে আসে মন্ত্রীদের কাছ থেকে।

৫) পৃথিবীর সব দেশেই মিডিয়া সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে কথা বলে। মিডিয়ার একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকতেই পারে। এই দৃষ্টিভঙ্গি সবসময় সরকারের পক্ষে কথা বলে না। গঠনমুলক সমালোচনা করে, তাই স্বাভাবিকভাবেই কোনো কোনো সময় সরকারের বিপক্ষে যায়। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের একটা বড় অংশই আওয়ামীলীগ সরকারকে ক্ষমতায় আনার পক্ষে কাজ করেছে বলে মানুষের ধারণা। অথচ এ সরকারের শেষ সময়ে এসে বেসরকারী টিভি চ্যানেলগুলোকে বয়কট করার ঘোষণা দিলেন প্রধানমন্ত্রী। সমালোচনার ভার যেন বইতে পারছে না সরকার।

মন্ত্রীর গালাগাল, জোট গঠন করা হলে তা প্রতিহত করার ঘোষণা, টিভি চ্যানেল বর্জন, শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক কিংবা সুশীল সমাজের মানুষগুলোর প্রতি প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের গুরত্বপূর্ণ মানুষগুলোর অবাঞ্ছিত উক্তি আমাদের ভাবিয়ে তোলে। জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার কথা যেন বার বার প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে তাদের এসকল কথাবার্তায়। মহাজোটের নৌকা নিয়ে তরুণরা হাল ধরেছিলো গত নির্বাচনে। বদলে দেবার একটা অঙ্গীকার ছিলোকিন্তু কি সেই বদলে যাওয়া? সময় বদলে যাচ্ছে, নৌকার গতি শ্লথ হয়ে যাচ্ছে এখন।

জনগণের মাঝে গতি ফিরিয়ে আনতে অনেক কিছুই করা সম্ভব। মিডিয়া বয়কট করলেই সমস্যার সমাধান হয় না। সমাধানের অনেক পথ আছে। ভারতেও মাত্র ঐ সপ্তাহেই হয়েছে মন্ত্রিসভায় বড় রদবদল। জনগণের দায়বদ্ধতার কাছে গলাবাজ মন্ত্রীরা যে বড় নন, তা-তো মিডিয়াই জানান দেয় বার বার। ভেবে দেখার এখনও সময় আছে।

Faruk.joshi@gmail.com
ফারুক যোশী: যুক্তরাজ্যে অভিবাসী সাংবাদিক ও কলাম
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর  jewel_mazhar@yahoo.com 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।