ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ধর্ষণের সংবাদ প্রচার এবং প্রভাব-প্রতিক্রিয়া

সঞ্জীব রায়, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৩
ধর্ষণের সংবাদ প্রচার এবং প্রভাব-প্রতিক্রিয়া

নয়াদিল্লীতে চলন্ত বাসে ধর্ষণের ঘটনার ক’দিন পর নৃবিজ্ঞানের একজন শিক্ষকের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিলো। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিলো বিষয়টিকে খুব ফলাও করে প্রচার এবং কভারেজ দেওয়া।



এ প্রসঙ্গে নানা আঙ্গিক, বিষয়, দিক এবং প্রভাব ইত্যাদি নিয়ে কথা হতে হতে তিনি বলছিলেন, এই প্রচারণা অনেককেই শিখিয়ে দিলো চলন্ত বাসে রেপ করা যায়। অতএব, যারা অপরাধপ্রবণ তাদের কাছে এই প্রচারণা নতুন অপরাধের কৌশল শেখানোর মাধ্যম হলো।

সেই আলোচনার একমাস না পেরুতেই বাংলাদেশে একদম হুবহু ঘটনা ঘটলো। আমার এক গার্মেন্টসকর্মী বোন মানিকগঞ্জের পথে চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হলো ২৪ জানুয়ারি, নয়াদিল্লীর চলন্ত বাসে ধর্ষণ ঘটনার এক মাস এক সপ্তাহ পরে।

নয়াদিল্লীর ঘটনা প্রচার-প্রচারণায় আসার পর ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশিমাত্রায় সংবাদ পাওয়া যাচ্ছিলো। আবার একই সঙ্গে নারীর প্রতি যৌন হয়রারি এবং তার প্রতিবাদমূলক ঘটনার সংবাদগুলোও উঠে আসছিলো সম্প্রচার মাধ্যমে। যার সুবাদে সীমানার বেড়াজাল পেরিয়ে আমাদের প্রচার মাধ্যমেও ভারতের সব সংবাদ প্রচারিত হয়েছে।

ভারতের ঘটনাকে বাদ দিয়ে যদি এবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন ধর্ষণ এবং শ্লীলতাহানির ঘটনাগুলোকে বিবেচনায় আনি, তাহলে কী দেখতে পাই?

২০১২ সালের মধ্য নভেম্বর থেকে মধ্য ডিসেম্বর- এই একমাসের সঙ্গে ২০১২ সালের মধ্য ডিসেম্বর থেকে ২০১৩ সালের মধ্য জানুয়ারি পর্যন্ত একমাসকে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করি। ধর্ষণ-নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনা সংবাদ আকারে পত্র-পত্রিকা-ম্যাগাজিনে পূর্ববর্তী এক মাসের চেয়ে দ্বিগুণ আকারে এসেছে। আর সম্প্রচার মাধ্যমে এসেছে তিনগুণ বেশি।

এক মাসের সংবাদ বিশ্লেষণ বলছে, দেশের অভ্যন্তরে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে যেখানে যা ঘটেছে তার বেশিরভাগই প্রচারিত-প্রকাশিত হয়েছে।

তবে কি হঠাৎ করেই দেশে তিনগুণ বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে শুরু করলো? এক কথায় এর জবাব দিচ্ছি- না, মোটেও তা নয়। ধর্ষণ অপকর্ম পূর্ববর্তী মাসেও এর চেয়ে কোন অংশে কম ঘটেনি। বরং প্রচারে আসেনি এতো ব্যাপকভাবে। তাহলে প্রশ্ন আসবে, এভাবে প্রচারের পেছনে কী উদ্দেশ্য, কী দুরভিসন্ধি? উত্তরে বলবো, কোন দুরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্য থেকে হঠাৎ করেই এভাবে প্রচারে সংবাদমাধ্যম কোমর বেঁধে নামেনি।

দামিনী ধর্ষণের ঘটনা গোট‍া উপমহাদেশ থেকে শুরু করে দুনিয়ার বিবেককে যেভাবে নাড়া দিয়েছে, তারই বাজার ধরেছে আমাদের মিডিয়া। বুঝেছে, এই সংবাদ বিক্রি করলে দাম ভালো পাওয়া যাবে। মানুষ এখন এই সংবাদই জানতে চায়। এটা মূলত ভারতের সংবাদমাধ্যমই করেছে। আর আমরা বুঝে না বুঝে তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, খুটি-নাটি তুলে ধরেছি আমাদের নাগরিকদের কাছে। বুঝতে চেষ্টা করিনি, কতোটুকু তথ্যের কতোটা প্রভাব।
নয়াদিল্লীর ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশের আনাচে কানাচে ধর্ষণের সংবাদগুলোকে কভারেজে আনতে শুরু করে দেশীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। পত্রিকা শুরু থেকেই রগড়ানো ভাষায় ধর্ষণের ইতিবৃত্ত লিখতে পছন্দ করতো। সেটা জারি রইলো চলতি মাসেও। আর সম্প্রচার মাধ্যমগুলোতে ধর্ষণের সংবাদ যথাসম্ভব এড়িয়ে যাবার প্রবণতা থাকলেও সর্বশেষ মাসে তা পরিবর্তন হলো।

টেলিভিশনগুলোতে শুধু সংবাদেই নয়, শিরোনামেও উঠে এলো ধর্ষণের ঘটনা। বিষয়টি ঘটেছে দু’দিক থেকেই। ধর্ষণের ঘটনা লুকিয়ে যাওয়ার, চেপে যাওয়ার অথবা গোপন করার যে প্রবণতা ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ছিলো, সেখানটাতেও এসেছে কিছু পরিবর্তন।

একজন দামিনীর জন্য যদি বিশ্ববিবেক রুখে দাঁড়ায় তাহলে কেনো ময়মনসিংহ-আশুলিয়া বা কুমিল্লার রহিমা, নাসিমা, বিলকিস(ছদ্মনাম) এর পরিবার মুখ লুকিয়ে রাখবে। এবার তাই তারাও সোচ্চার হয়েছে। থানা-পুলিশ-হাসপাতাল থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। বিচার চেয়েছে, সোচ্চার হয়েছে নিপীড়নের বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধে মুখর হয়েছে রাজপথ, শিক্ষাঙ্গন। কিন্তু প্রচারণার ধরন-ধারণ ঠিক আছে তো? সেই প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।

এই এক মাসে ধর্ষণের সংবাদ প্রচার করতে গিয়ে সম্প্রচার মাধ্যমগুলো কোন সুনির্দিষ্ট ধারা অনুসরণ করতে পারেনি। যদিও অনুমোদিত কোন ধারা আছে কি না সেটাই প্রশ্ন। টেলিভিশনগুলোও অনেক ক্ষেত্রে ত্রিশ সেকেন্ড থেকে এক মিনিটের সংবাদেও বর্ণনা দেওয়ার নজির রেখেছে। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষিতার পরিবারের সদস্যদের চেহারা তুলে ধরেছে।

কী কারণে ধর্ষণ? কীভাবে ধর্ষণ? কার সহায়তায় ধর্ষণ? এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দর্শকের মনের চাহিদা মিটিয়েছে। আর পত্রিকার কলাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে বিস্তৃত বর্ণনা।

কী খাওয়ালে দ্রুত অজ্ঞান করা যায়? কার সহায়তায় বাড়ি থেকে বের করে আনা যায়? কী অজুহাতে ধর্ষণের জন্য হাতের নাগালে পাওয়া যায়? দিনরাতের কোন সময়টাতে ধর্ষণ উপযোগী মুহূর্ত পাওয়া যায়? ধর্ষণের জন্য নির্ঞ্ঝজাট জায়গা কোনটি? এসব প্রশ্নের পুঙ্খানুপুঙ্খ উত্তর পাওয়া যাবে পত্র-পত্রিকার পাতায়। সুরতাং, কিনুন তিন টাকার পত্রিকা জানুন ধর্ষণ করার উপায়। দেখুন বিচার-বিচেনাহীন সংবাদ, শিখুন ধর্ষণের নয়াকৌশল।

তাহলে এখন একটিই প্রশ্ন থাকছে। সেটি হলো, ধর্ষণের সংবাদ প্রচার-প্রকাশ কি তাহলে ধর্ষণের ঘটনা বাড়াচ্ছে? সোজাসাপ্টা যদি ‘না’ বলা হয় তাহলে ভুল হবে। গভীর এবং অনুসন্ধানী গবেষণা প্রমাণ করতে পারে, চলমান প্রচারণার কারণে ঠিক কয়টি ধর্ষণের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণহীন প্রচারণা যে কোন অপরাধকর্ম সংঘটনে কতোটা ভূমিকা রাখে সেটা বহুবার-বহুভাবে প্রমাণিত।

তবে, দামিনীর ঘটনার আগে যেমন দিল্লী কিংবা ভারতে অন্যান্য শহরে চলন্ত বাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তেমনি আমাদের দেশেও ঘটেছে এবং ঘটছে এমন ঘটনা। তবে হ্যা এটা সত্য যে, চলন্ত বাসে ধর্ষণ করা যায়, ধর্ষণপ্রবণ কোন অপরাধীর কাছে এই তথ্যটি অজানা থাকলে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে তার চিন্তার মধ্যে ঢুকে যেতে পারে। এবং সেটি সম্পাদনেও সে উদ্যোগী হতে পারে। এই মুহূর্তে প্রমাণ করার সুযোগ নেই- মানিকগঞ্জে চলন্ত বাসে আমার গার্মেন্টসকর্মী বোনকে ধর্ষণকারীদের মাথায় কোত্থেকে এসেছে অপচিন্তাটি।

প্রচারের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলাপ হয়তো দীর্ঘতর হবে। কিন্তু যে কারণে আলাপ সেটার দিকে গিয়ে আলোচনার সমাপ্তি টানতে চাই।

যেভাবে আমাদের পত্র-পত্রিকা এবং টেলিভিশনে ধর্ষণের সংবাদ প্রকাশ-প্রচার হচ্ছে তা কতোটা দায়িত্বশীলতার সঙ্গে ঘটছে? দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক সংবাদপত্র, সামাজিক আন্দোলনে যে পত্রিকাটি নিজেদের সর্বাধিক দায়-দায়িত্বের কৃতিত্ব দাবি করে, সেই পত্রিকাটির সংবাদে মানিকগঞ্জের ধর্ষণের ঘটনা যেভাবে উঠে এসেছে, তার দিকে চোখ রাখি।

সেখানে বাসচালক কখন ধর্ষণ করলো, হেলপার কখন করলো, কে আগে এবং কে পরে করলো, বাসের গতিবেগ কেমন ছিলো, ধস্তাধস্তি কেমন হলো, বাসের দরজা-জানালা কি অবস্থায় ছিলো, একজন ধর্ষণের পর গাড়ি চালানো শুরু করলে আর একজন কিভাবে ধর্ষণে লিপ্ত হলো- এসব দিয়ে সাজানো হয়েছে।

আর একটি সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল। মানিকগঞ্জে চলন্ত বাসে তরুণী র্ধষণ শীর্ষক একটি আলাদা অনুষ্ঠানই তৈরি করেছে। সেখানে শুভযাত্রা বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে ব্যাখ্যা-বর্ণনা করেছেন প্রতিবেদক। একই সঙ্গে জনসচেতনতা তৈরি করতে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া নেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিক্রিয়ায় আমরা দেখি সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ-ঘৃণা উঠে আসে ধর্ষণকারীর প্রতি। এটা খুব বড় একটা শক্তি। তাই প্রচার-প্রচারণায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের সংবাদগুলো তুলে আনা। সাধারণের মধ্যে ধর্ষণ-নিপীড়ন বিরোধী সচেতনতা তৈরি।

কিন্তু ঘটনাস্থল, পরিবারের সদস্য, ক্ষতিগ্রস্ত নারী-শিশু বা ধর্ষিতাদের দৃশ্যায়ন-চিত্রায়ণ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিৎ। বাসের আসন চিনিয়ে দিয়ে -‘এই আসনেই হয়েছে তরুণীর ধর্ষণ’ ধরনের প্রচারণা মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে দর্শকের মাঝে।

একই সঙ্গে উল্লেখ করা দরকার, ভারতের দিল্লীর বাসে ধর্ষণের ঘটনার পর বাংলাদেশের সম্প্রচারমাধ্যমগুলো মুম্বাই, কলকাতায় বাসে ধর্ষণের ঘটনা প্রচার করেছে অতি উৎসাহী হয়ে। বিহার, পাঞ্জাব, উড়িষ্যা, হরিয়ানার ধর্ষণের ঘটনাও বাদ পড়েনি বাংলাদেশের প্রচারমাধ্যম থেকে।

এসব ঘটনা এর আগেও ভারতের ঐসব রাজ্যে ঘটেছে। কিন্তু প্রচারে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো এতোটা উৎসাহ দেখায়নি।

সংবাদ বিক্রির মানসিকতা থেকে যদি এই বেপরোয়া প্রচারণা হয়ে থাকে, তাহলে এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ আমরা কতোটা প্রচার-প্রকাশ করবো, কীভাবে করবো, কোন দিকগুলো তুলে ধরবো আর কোনগুলো দেখাবো না বা বলবো না।

কারণ, দর্শক বা পাঠকের মনে অনেক প্রশ্ন থাকবে, অনেক কিছু জানতে চাইবেন তারা। কিন্তু দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যম হিসেবে সব বিষয়ের সব তথ্যের বিস্তারিত দর্শককে বা পাঠককে জানানো দায়িত্বশীলতা নয়। সংবাদের প্রভাব এবং প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় নিয়ে তথ্য প্রচারই সংবাদমাধ্যমের সামাজিক দায়বদ্ধতা। ধর্ষণের সংবাদ প্রচার এবং প্রকাশে আমরা সে বিষয়টির দিকে মনোযোগ দিতে পারবো সেই আশা করি।

সঞ্জীব রায়: সংবাদমাধ্যমকর্মী, royratan.sanjib@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৭, ২০১৩
জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।