ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

আবিদ ভাই...এমনতো কথা ছিল না

শহিদুল ইসলাম মিন্টু, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৩
আবিদ ভাই...এমনতো কথা ছিল না

শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের বন্ধুদের খবর জানতেই গত কয়েকদিন ধরেই দফায় দফায় ফেসবুকে ঢুঁ মারছি। জানছি আপ-টু-ডেট সব খবর।

সোমবার খুব ভোরে উঠে ফেসবুক খুলতেই যেন দমবন্ধ হবার উপক্রম। নিউইয়র্ক থেকে মানিক রহমান ভাই স্ট্যাটাস দিয়েছেন। লিখেছেন-আবিদ ভাই আর নেই।

আবিদ ভাই মানে আবিদ রহমান। আমাদের প্রিয় অগ্রজ। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন নিবাসী। একাধারে কবি, সাংবাদিক, লেখক, সংগঠক। সম্প্রতি সম্পৃক্ত হয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার রাজনীতিতে। সেই আবিদ ভাই নেই। কোনো রকম নোটিশ না দিয়েই চলে গেলেন। প্রিয় অগ্রজ হলেই কি আগে চলে যতে হবে? এমনতো কথা ছিল না। স্ট্যাটাসটি পড়েই কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকি। টরন্টো সময় ভোর পাঁচটা। কাকে ফোন করবো? টরন্টোর আরেক প্রিয় অগ্রজ, সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী বোখারীকে ফোন দেই। পাইনা তাকে। ম্যাসেজ রাখি। কিছুক্ষণ পর বেশ কয়েকটি ইমেইল পাই। সেগুলো থেকে জানতে পারি বিস্তারিত। দুপুরের খাবার খেয়ে সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন আবিদ ভাই। হঠাৎ করেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। সাথে সাথেই অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। না ফেরার দেশে আমাদের প্রিয় আবিদ ভাই।

আবিদ ভাইয়ের সঙ্গে প্রায়ই ফোনে কথা হতো। প্রচণ্ডরকমের পজিটিভ মানুষ ছিলেন তিনি। প্রবাসের জনপ্রিয় অনলাইন পত্রিকা বেঙ্গলি টাইমস ছিল তাঁর পছন্দের তালিকায়। প্রচণ্ডরকমের উৎসাহ দিতেন আমাদের টিমকে। কথা হতো দেশ, সংবাদপত্র আর রাজনীতি নিয়ে। মধ্যরাতে ফোন করতেন। কখনো ঈদের শুভেচ্ছা। আবার কখনো জানাতেন ভালো খবর। এভাবেই তাঁর প্রতি ভালোলাগার শুরু। এই ভালোলাগা থেকেই তাঁর সঙ্গে সম্পর্কটি গভীর হতে শুরু করে। হঠাৎ একদিন বললেন, মিন্টু! বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা পড়ার সুযোগ পেয়েছি। এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় জনগণের ট্যাক্সের টাকায়। সেই দায় কি আমরা শোধ করেছি? বাংলাদেশ থেকে তো আমরা শুধু নিয়েই গেলাম, দিলাম নাতো কিছুই।

বুঝতে পারি আবিদ ভাই কী বলতে চান। দেশে ফেরার কথা বলেন। আমি কোনো উত্তর দেই না। ভাবতে থাকি। এভাবেই সময় চলে যায়। কিন্তু আবিদ ভাই বসেছিলেন না। মেলবোর্নে বসেই নানা রকমের পরিকল্পনা করতেন। দেশে কিছু একটা করবেন। করবেন মানে দৈনিক পত্রিকা, মিডিয়া হাউজ কিংবা টিভি চ্যানেল। এসব পরিকল্পনা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথাও বলতাম। এসব উদ্যোগে খুবই উৎসাহী ভূমিকায় থাকতেন আমাদের টরন্টোর মোহাম্মদ আলী বোখারী ভাই। ঢাকার বিভিন্ন মহলে আবিদ ভাইয়ের বেশ ক’জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তারাও সহযোগিতার কথা বলতেন। কিন্তু আবিদ ভাইয়ের কোনো পরিকল্পনাই আর আলোর মুখ দেখলো না। তার আগেইতো চলে গেলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম আর রাজনীতি ছিল আবিদ ভাইয়ের প্রিয় বিষয়। এসব প্রশ্নে কাউকে ছাড় দিতে চাইতেন না। অকপটে বলতেন। লিখতেন সাহস নিয়েই। গত বছর যখন ঢাকার দৈনিক আমাদের অর্থনীতিতে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে জয়েন করলেন তখন আমি ঢাকায়। প্রচণ্ড ব্যস্ততা তাঁর। তবুও থেমে থাকেনি আমাদের আড্ডা। ঢাকার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে কষ্ট হচ্ছে সেটাও বললেন কয়েকবার। সেই যাত্রায় ঢাকায় ছিলাম সাড়ে তিন মাস। আবিদ ভাই বললেন, থেকে যান। ...আমি আমতা আমতা করি। কিছু বলি না। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না সেটাও বললেন। ভাবি আর ছেলেকে খুব মিস করেন সেটা জানালেন একরাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হার্টে ব্লক ধরা পড়েছে, খুব আস্তে করে বললেন কথাটা। কিন্তু এসব কিছুই ‌‌তাঁকে দমাতে পারেনি। তারুণ্যের উদ্দামতা সবসময়ই ছিল তাঁর মধ্যে। ছিল অনুজদের প্রতি অসম্ভব ভালোবাসা। আমি নিজেই তাঁর ভালোবাসায় সিক্ত। আমার কাছে আবিদ ভাই যেন ক্ষণিকের অতিথি। এলেন। জয় করলেন। চলে গেলেন। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তিনি নেই। ভাবতে কষ্ট হয় সুদূর মেলবোর্ন থেকে ফোনে করে কেউ বলবে না, মিন্টু...আমি আবিদ ভাই...

আবিদ ভাই কি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি বেশিদিন বাঁচবেন না? গত বছরে ১৪ ফেব্রুয়ারি বোখারী ভাইয়ের কাছে ই-মেইল করে একটি লেখা পাঠিয়েছিলেন। বলেছিলেন গচ্ছিত রাখতে। আবিদ ভাই লিখেছিলেন, “মানুষের জীবন আসলে বারটেন্ডারের। সারাক্ষণ অন্যকে সুখী করার পরিবেশনা মাত্র। সেখানে নিজের জন্য কিছু থাকে না। মাতালদের মাতলামি দেখেই মদ্যপানের আনন্দ খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা। মাতাল হতে তীব্র ইচ্ছে হয়, কিন্তু বারটেন্ডারের যে মদ্যপান বারণ। ...অনেক মানুষের কাছে ঋণী থেকে আমারো প্রস্থানের সময় এসেছে। যেকোনো সময়ে, যেকোনো মুহূর্তে পড়বে জীবনের যতিচিহ্ন। সব কিছু যখন থেমে যাবে, পরপারের চির বসন্ত বাগানের গাছে হেলান দেওয়া রুদ্র’র দিলখোলা হাসির পাশে দাঁড়িয়ে আহমেদ ফারুক হাসান স্বভাবসুলভ বিদ্রুপাত্নক হাসিতে বলবে, ‘এতো দেরী হইলো ক্যান মিনি ভাই’? আমি উত্তর দেয়ার আগে ক্যামেরা কাঁধে মিশুক মুনীরের ভরাট উচ্চারণ, ‘কাট’। জীবন কেটে আসা আমি হয়তো তখনই বুঝব জীবন কিংবা মুত্যুর যথার্থ মানে। ”

প্রিয় আবিদ ভাই! আপনাকে খুবই মিস করবো সবসময়। কিন্তু না ফেরার দেশে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসবেন না প্লিজ!

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩

 

শহীদুল ইসলাম: সম্পাদক, সাপ্তাহিক বেঙ্গলি টাইমস, টরন্টো, কানাডা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।