ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

গণতন্ত্রের অগ্নিপুরুষ এক মহানায়ক

এরশাদুল আলম প্রিন্স, আইন ও মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৮ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৩
গণতন্ত্রের অগ্নিপুরুষ এক মহানায়ক

আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো: জিল্লুর রহমান আর আমাদের মাঝে নেই। আমাদের জন্য রেখে গেছেন তার জীবনের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস।

তার মৃত্যুতে লাখো জনতার স্বত:স্ফূর্ত শোক আবারো প্রমান করলো যে এ দেশে আদর্শ রাজনীতি চর্চ্চার পথ এখনো রুদ্ধ হয়ে যায়নি। তার জন্য লাখো জনতার অশ্ত্রু বিসর্জন সে কথাই জানান দিচ্ছে।

বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ইতিহাস আলোচনা করলে অন্তত চল্লিশের দশক থেকে তা শুরু করতে হবে।

মধ্যরাতে ভারত বিভক্তির পূর্বের ইতিহাসে না গেলেও অন্তত তার পর থেকে অবিভক্ত ভারতের বদলে আমরা যে অবিভক্ত পাকিস্তান পেলাম সেখানেও অবিভক্ত ভারতের ভূত আমাদের পিছু ছাড়লো না।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও অসহিষ্ঞুতার অবশ্যম্ভাবি ফলস্বরুপ যে পাকিস্তান ভোট ও রক্ত দিয়ে আমরা অর্জন করলাম সেখানেও কালভুজঙ্গের ছোবল মারলো সাম্প্রদায়িকতা।

ব্রিটিশরা আমাদের শাসন করেছিল কার্তুজে শুকর ও গরুর মাংস মিশিয়ে অর্থাৱ ডিভাইড এন্ড রুল নীতি অনুসরন করে। পাকিস্তানেও পাক্কা-মুসলমান ও ভেজাল মুসলমানের ধুয়া তুলে শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীকে অবদমিত করে রাখতে চাইলো।

ধর্ম দিয়ে যে বিভক্তি টানা হলো (ভারত বিভক্তি) ধর্ম সেই বিভক্তিকে ঐক্যে পরিণত করতে পারলো না।
চল্লিশের দশকের সেই ভূরাজনৈতিক ইতিহাসের হাতেগোনা যে কয়েকজন রাজনৈতিক- সাক্ষি স্বাধীন বাংলাদেশে আজ অবধি রাজনীতি করতেন তাদের মধ্যে জিল্লুর রহমান প্রথম সারির। আর-দুএকজন থাকলেও থাকতে পারে।

শুধু তাই নয়, জিল্লুর রহমান চল্লিশের দশকের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যে আদর্শিক রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত হতেন তিনি তা আমৃত্যু ধরে রেখেছিলেন।

রাজনৈতিক শিষ্ঠাচার ও আদর্শিক রাজনীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত মো: জিল্লুর রহমান।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহন করেন এই বর্ষিয়ান নেতা। শুধু তাই নয় ৫২ থেকে ৬৯ সালে দেশের সব সামাজিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তি এই প্রচারবিমুখ মানুষটি।

’৪০ থেকে ’৭০ দশকের সেই ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলেই ৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। শাসকগোষ্ঠী সেই নির্বাচন মেনে নেয়নি।

স্বাধীনতা আন্দোলনের অকুতোভয় এ সেনানি মুজিবনগর প্রবাসী সরকারের কার্যক্রমে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। যদিও তিনি সে সরকারের কোনো সদস্য ছিলেন না। কিন্তু সরকারের সদস্য না হয়েও যে কাজ করা যায় জিল্লুর রহমান তার সাক্ষর রেখেছেন স্বাধীনতার পূর্বেই। যদিও স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের তার সেই আদর্শের অনুসারী তেমন আর কাউকে খুজে পাওয়া যায়নি। সবাই স্বার্থ ও ক্ষমতার রাজনীতিতে আত্মসমর্পন করেন। তারপরও জিল্লুর রহমান সেই আদর্শ থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি।

বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সহচর জিল্লুর রহমান। বঙ্গবন্ধুও তাকে চিনতে ভুল করেন নি। যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের হাল ধরতে বললেন জিল্লুর রহমানকে। দায়িত্ব দিলেন সাধারণ সম্পাদকের। দেশে ও দলে যখন পুরো বিশৃঙ্খলা সেই কঠিন সময়ে তিনি শক্ত হাতে আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন। দলে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও জিল্লুর রহমানের সাংগঠনিক দক্ষতায় আওয়ামী লীগ আবার সংগঠিত হলো। ৭৩ এর নির্বাচনেও তিনি আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেন।

৭৫ এর ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ ২১ বছর দেশে যে বিরাজনীতিকরণ হয়েছে ও রাজনীতিতে যে অগণতান্ত্রিক শক্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে সেই কঠিন সময়েও তিনি কারো কাছে মাথা নত করেন নি। নীতি ও আদর্শে ছিলেন অবিচল। অশুভ শক্তির বিশালত্ব তাকে কখনো বিচলিত করতে পারে নি। তার প্রমান জিল্লুর রহমান বার বার রেখেছেন। জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পরও তিনি বন্দুকের নলের কাছে আত্মসমর্পন করেন নি। ফলে, সামরিক জান্তা তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করলেন। সেখানে কাটালেন চারটি বছর।

পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে জননেত্রি শেখ হাসিনাও দলের ক্রান্তি লগ্নে তাকেই বেছে নিলেন দলের হাল ধরার জন্য। তারই সুযোগ্য নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতায় আওয়ামী লীগ ৯৬-এর নির্বাচনে আবার ক্ষমতায় আসে।

কর্মময় ও বর্ণাঢ্য সংগ্রামী জীবনের অধিকারী এই মহান নেতা মন্ত্রীত্ব বা ক্ষমতার জন্য কখনো রাজনীতি করেন নি। একই সাথে তিনি দলের নেতৃত্বও দিতেন ও দলের প্রতি অনুগতও থাকতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে।

গণতন্ত্রের জন্য তিনি আবার বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করলেন ১/১১ পরবর্তী সময়ে। তথাকথিত মাইনাস-টু ফর্মুলার বেড়াজালে আটকে অনেক বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা হঠাৱ সংস্কারবাদী বনে গেলেন। যদিও তারা জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন ও আদর্শের কাছে মাথা নত করেছেন। কিন্তু জিল্লুর রহমান মাথা নত করেন নি। তিনি সুদৃঢ়ভাবে দলের হাল ধরেছেন। তথাকথিত সংস্কারবাদীরা ছিটকে পড়েছে তার নেতৃত্বের কাছে।

কিন্তু তার সবচেয়ে বড় মূল্যায়ন এটা নয় যে তিনি আওয়ামী লীগের হাল ধরেছেন, আবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছে। তার সবচেয়ে বড় অবদান তিনি ১/১১-এর কালো হাত থেকে দেশের গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করেছেন। কাজেই দেশের গণতন্ত্র তার কাছে চির ঋণী। দেশের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ তার এ ঋণ কোনদিনই ভুলে যাবে না। আবার প্রমাণ করলেন তিনি গণতন্ত্রের অগ্নিপুরুষ।

তিনি তার ব্যক্তিগত জীবনে মানবীয় আচরণের চর্চ্চা করেছেন। রাজনৈতিক জীবনেও তার ব্যাত্যয় ঘটেনি। সংসদে বা সংসদের বাইরে কখনোই তিনি অপরকে হেয় প্রতিপন্ন করেন নি। যা আমাদের রাজনীতিতে আজ আর নেই।

আমরা পশ্চিমা গণতন্ত্রের কথা বলি। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক কার্যক্রমে তার কোনো প্রতিফলন নেই। দাত-মুখ খিচিয়ে অপরকে উচ্চস্বরে গালি দিতে পারলেই এখন বড় নেতা হওয়া যায়। অপরের চরিত্র হনন করেই দলের ভেতরে ও বাইরে এমনকি সংসদেও নিজের আসন পোক্ত করা যায়, নেত্রীর অনুরাগভাজন হওয়া যায়। জিল্লুর রহমান ছিলেন সম্পূর্ণ তার ব্যতিক্রম। কিন্তু আদর্শে অবিচল।

এ জাতির গণতন্ত্র ও উন্নয়ন চর্চ্চায় তার জীবন থেকে বার বার আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। তিনি তার তার পরিবারের পুরো জীবন উৱসর্গ করেছেন দেশের জন্য। আইভীকে হারিয়েও তিনি পিছু হটেন নি তার চিরন্তন আদর্শ থেকে।

সকলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও বিনয়ী এ মহানায়কের মহাযাত্রায় আওয়ামী লীগ হারালো এক সুযোগ্য নেতা, জাতি হারালো এক অভিভাবক, জনগণ হারালো গণতন্ত্রের এক অগ্নিপুরুষ।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।