ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সহমর্মিতা নয়, ওদের দরকার সহযোগিতা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪, ২০১৩
সহমর্মিতা নয়, ওদের দরকার সহযোগিতা

ziniaসন্তানপ্রত্যাশী প্রতিটি পিতামাতাই ছেলে বা মেয়ে যাই হোক না কেন সবার আগে প্রত্যাশা করে সুস্থ ও স্বাভাবিক শিশু। সুস্থ শিশু একটি পরিবারে যেমন আনন্দের বন্যা বইয়ে দেয়, অন্যদিকে শারীরিক ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী শিশু একটি পরিবারে বয়ে আনে দুঃখের কালো মেঘ।

অধিকাংশ সময়েই সেই কালো মেঘ থেকে অশ্রু ঝরে পিতামাতার চোখ বেয়ে। আত্মীয়-স্বজন, এমনকি পাড়া প্রতিবেশীর কাছ থেকেও কটু কথা শুনতে হয় সেই ভাগ্যবঞ্চিত শিশুটির পিতামাতাকে।
 
শক্ত মনোবল সম্পন্ন পিতামাতা তাদের প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্য সামাজিক অনেক কিছুই ত্যাগ করেন। নিজেদের সাধ্যের মধ্যে যতখানি সম্ভব শিশুটিকে তার ধারণক্ষমতার মধ্যে মানুষ করে তোলার চেষ্টা করে থাকেন।

 এ তো গেল পিতামাতার কথা। আমাদের দেশে প্রতিবন্ধী একটি শিশু রাষ্ট্রীয়-সামাজিক প্রায় সব ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হয়ে থাকে।

 প্রথমেই বলা যায় শিক্ষার কথা। শহরভিত্তিক প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য রয়েছে আলাদা শিক্ষা ব্যবস্থা, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাও আবার এই শিক্ষা ব্যবস্থা উচ্চ ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা দরিদ্র পরিবারের অসংখ্য প্রতিবন্ধী শিশু প্রাথমিক শিক্ষার দ্বার পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে না।

 শুধু জেলা শহরগুলোতে সীমিত সংখ্যক শিক্ষকে পরিচালিত এসব স্কুল হাজারও সমস্যায় জর্জরিত। প্রচলিত স্কুলগুলোতে প্রতিবন্ধী অনেক শিশু যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পড়াশুনা করার সুযোগ পায় না। প্রকৃতিপ্রদত্ত সীমাবদ্ধতার কারণে পদে পদে তারা বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে।

 প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিতকরণে দরকার সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা। অর্থের অভাবে প্রতিবন্ধী শিশুটি শিক্ষা থেকে যাতে বঞ্চিত না হয়, তাই অন্যান্য শিক্ষার্থীর তুলনায় প্রতিবন্ধী শিশুটির জন্য উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়ানো যেতে পারে। প্রতিবন্ধীদের জন্য উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বাড়ানো প্রয়োজন।  

 কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের দেশে প্রতিবন্ধীদের কথা চিন্তা করে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস আদালত, শিল্প-প্রতিষ্ঠান কিছুই তৈরি করা হয়নি। কোনো বিল্ডিং এ হুইল চেয়ার নিয়ে ওঠার মত কোনো ব্যবস্থা নেই।

দোতলা-তেতালা অনেক ভবনে লিফট নেই, কারণ শারীরিক সীমাবদ্ধতাহীন একজন ব্যক্তি লিফট এর সাহায্য ছাড়াই দোতলা বা তেতালা পর্যন্ত অনায়াসে উঠতে সক্ষম হয়ে থাকেন। অথচ হুইল চেয়ারে আসীন একজন ব্যক্তিরও যে সেই বিল্ডিং এ ক্লাস, কিংবা দাপ্তরিক কিংবা অন্যান্য অনেক প্রয়োজনীয় কাজে যাবার দরকার পড়তে পারে সে কথা যেন কেউ চিন্তাও করে না।

 দেশের প্রত্যেকটি বাণিজ্যিক বিল্ডিং ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধীবান্ধব করে তৈরি করার জন্য আইন পাশ করার দাবি আমাদের সবারই জানানো উচিত। শুধু যার ঘরে প্রতিবন্ধী শিশু আছে, তারাই প্রতিবন্ধীবান্ধব পরিবেশের জন্য লড়ে যাবে তা নয়, আমাদেরকেও তাদের অধিকার রক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।

প্রতিবন্ধীবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। বাসগুলোতে নারীদের জন্য আলাদা সিটের দরকার নেই। সক্ষম নারীরা যদি পুরুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সব কাজে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেন, তবে বাসের হ্যান্ডেল ধরে বাদুর ঝোলা হয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানেও যেতে পারবেন।

বিশ্বের আর সব উন্নত দেশের মত আমাদেরও প্রতিবন্ধী, সন্তানসম্ভবা মাতা ও বৃদ্ধদের জন্য বাসে, ট্রেনে সব যানে সংরক্ষিত আসন ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। সব বাসে করা সম্ভব না হলেও অন্তত নির্দিষ্ট সময়ের কিছু কিছু বাসে অবশ্যই এই আসন কোটা চালু করা যেতেই পারে।    

চাকরি ক্ষেত্রে প্রত্যেকটা সরকারি-বেসরকারি অফিসে প্রতিবন্ধীদের যোগ্যতা ও শারীরিক-মানসিক সীমাবদ্ধতার উপর ভিত্তি করে বাধ্যতামূলক চাকরির কোটা নির্ধারণ করতে হবে। কানে হয়ত একজন ব্যক্তি শুনতে পারেন না, কিংবা কথা বলতে পারেন না, কিন্তু তিনি তো বাংলানিউজের মত স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটারের সামনে বসে প্রুফ রিডিং এর কাজ করতে পারেন। স্বল্প শিক্ষিত কিংবা শিক্ষার আলোহীন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিটি আর কিছু না পারুক অফিসের টেবিল চেয়ার গুলোতো ধুলোমুক্ত রাখতে পারেন, পারেন না কি? এভাবেই কি আমরা সব প্রতিষ্ঠানে দু-তিনজন করে হলেও তাদের চাকরির সুযোগ করে দিতে পারি না?   

পৃথিবীর সব দেশের মতো এদেশেও প্রতিবন্ধী কন্যা শিশুর অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। আপাতদৃষ্টিতে শারীরিকভাবে সুস্থ দেখতে কিছু নরপশুর কবলে অনেক নারী প্রতিবন্ধী নীরবে যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মত শারীরিক ও মানসিক কোনো বোধ না থাকায় অনেক সময়ই অনেক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। অসহায় ভাগ্যাহত এসব নারী প্রায় সময়ই চরম মূল্য দিয়ে থাকেন। প্রতিবন্ধী নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাই কঠোর আইন হওয়া দরকার। অপরাধীদের বিরুদ্ধে দরকার ত্বড়িৎ শাস্তির ব্যবস্থা।
 
প্রতিবন্ধীদের প্রতি সহমর্মিতা কিংবা করুণা নয়, তাদের দরকার সার্বিক সহযোগিতা। শিক্ষা, যোগাযোগ, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা সর্বক্ষেত্রে দেশের সব নাগরিকের মতো তাদের অধিকার সমান নিশ্চিত করতে হবে।

 তারা সমাজের বোঝা নয়, একটু সহযোগিতায় তারাও হয়ে হয়ে উঠতে পারে আমাদের সম্পদ।

বাংলাদেশ সময়: ০৬১৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৩

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।