ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

দূতদের যত অদ্ভুত কাণ্ড

অজয় দাশগুপ্ত,অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৪
দূতদের যত অদ্ভুত কাণ্ড

দূতিয়ালি পৃথিবীতে নতুন কিছু নয়। পৌরাণিক কাহিনীতেও আমরা দূতদের ভূমিকা দেখতে পাই।

রাজন্যবর্গের চিঠিপত্র বা বিশেষ বার্তাবাহক দূতদের মধ্যে কেউ ছিলেন নন্দিত, কারো ভূমিকা ছিল মীরজাফরের।

‘পালা কীর্তন’ নামে এক ধরনের গান চালু ছিল আমাদের সমাজে। যখন আমরা প্রতি কথায় প্রতি বাক্যে ধর্মের ব্যবহার আর এস্তেমাল করতাম না, সেই প্রকৃত ধর্মাচরণের কালে পালা কীর্তন শুনতেন সবাই।

সে জাতীয় একটি পালা গানে এমনি এক দূতের উদ্ভাস শুনেছিলাম। রূঢ কঠোর প্রতিশোধপরায়ণ এক নৃপতি তার সুবোধ ন্যায়পরায়ণ পুত্রকে নিধনের জন্য  একটি পত্র লিখে পাঠান। পত্রবাহক দূত সেটি জানতেন। ন্যায়ধর্ম ও সততার প্রতি বিশ্বস্ত দূত না পারছিলেন চিঠিটি ছিঁড়ে ফেলতে, না তার ভার বহন করতে। শেষমেষ বেচারী পত্র খুলে পড়তে পড়তে চোখের জলে কয়েকটি অক্ষর ধুয়ে মমার্থ পাল্টে দিয়েছিলেন। যে কারণে পুত্রটি বেঁচে যায়।

পৌরাণিক কাহিনীতেও আমরা এমন অনেক দূতের সন্ধান পাই। বাস্তবে ইউরোপে যুদ্ধ ও গৃহবিবাদের কালে দূতদের ভূমিকা ছিল অতুলনী্য়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও বিদেশি দূতদের সদর্থক ভূমিকা আর সমর্থনের কাহিনী লেখা আছে।

কালক্রমে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও তার দোসররা সে ভূমিকায় আঘাত হানে। বিশেষত স্নায়ুযুদ্ধ নামে পরিচিত আমেরিকা বনাম সোভিয়েতের লড়াইকালে দূতরা হয়ে ওঠে ক্রীড়নক। তাদের বহিষ্কার ও অবাঞ্ছিত ঘোষণার ভেতর দিয়ে শুরু হয় কলংকের নতুন অধ্যায়।

আমেরিকার এ এক বিরাট সমস্যা। নিজের দেশে গণতন্ত্রী আপন সমাজে উদার ও সর্বত্রগামী হলেও অন্যের বেলায় তার ভূমিকা ঠিক উল্টো। বিভিন্ন দেশ ও সমাজের মেধায় নির্মিত আমেরিকা এক নাম্বার দেশ হবার উন্মাদ আনন্দে নিজের আকারকে নিজেই দৈত্য বানিয়ে ফেলেছে।

লিংকন-রুজভেল্ট-ওয়াশিংটন-মার্টিন লুথার কিং বা কেনেডির দেশটি অনেক আগেই তার সর্বজনীন চারিত্র্ হারিয়ে একরোখা আর যুদ্ধংদেহী হয়ে উঠেছে। মজার ব্যাপার, এই স্ববিরোধী আমেরিকার মুসলিম নির্যাতন ও বিশ্বব্যাপী মুসলমান নিপীড়নের ব্যাপারে সোচ্চার মানুষই ছোট ছোট স্বার্থ আর আঞ্চলিক বা দেশীয় বিবাদে তার ভূমিকার একনিষ্ঠ ভক্ত। কারণ, এদের কাছে জাতি সমষ্টি বা দেশের চেয়ে নিজের ভালো মন্দের দিকটাই জরুরি।

আজ আমরা তার প্রমাণ দেখছি বাংলাদেশে। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান হামলার পর তৈরি পোশাক ছেড়ে সফেদ কাপড়ে আবৃত বুদ্ধিজীবী আমেরিকান বা বৃটিশ রাজদূতের কথা শেষ হবার আগেই বলছেন ‘ঠিক ঠিক ঠিক’।

রাজদূতদের কথায় আসার আগে এ জাতীয় বুদ্ধিজীবীদের কথা বলে নিই। আমরা সবাই মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান আগ্রাসনবিরোধী। ব্যক্তিগতভাবে সে ঘটনার পর থেকে বিশ্বখ্যাত একটি বিশেষ কোমল পানীয় পানেও আগ্রহ নেই আমার। যে টাকায় ইসরাইলিদের যুদ্ধ সরঞ্জাম ও অস্ত্র কেনা হয় তাতে বিন্দু পরিমাণ হিসসা বা যোগান না দেয়ার ব্রতে আমার এই অণু পরিমাণ কাজের কথা আমি তাঁর মত ফলাও করে বলিনি, বা বাহ্যিকভাবে প্রদর্শন করে বুদ্ধিজীবী সাজারও চেষ্টা করি নি।

আরেকটা বিষয় বলা প্রয়োজন। মানবতা বা যে কোনো ন্যায়যুদ্ধে ধর্ম সম্প্রদায় বা জতিগত পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে তার ভেতরে উদারতা থাকে না। এবং তা মানবিক বলে বিবেচিত হতে পারে না। পৃথিবীর যে অঞ্চলে আমেরিকার আগ্রাসন বা যুদ্ধ তাদের সঙ্গে আমার ধর্মীয় বা সম্প্রদায়গত কোনো মিল নেই। তারপরও আমি বা আমার মত অনেকেই শিশুহত্যা, নারী নির্যাতন বা অমানবিক যে কোনো  কাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার।   ‘কাফনে মোড়ানো’ তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা জাফনার গণহত্যায় শিহরিত হন না, আমেরিকান স্কুল শ্যুটিংয়ে বিচলিত নন, এমনকি দেশে যখন হিন্দুদের ওপর অমানবিক নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, আগুন লাগানো চলে তখনো নির্বিকার।

এর একটা কারণ অবশ্য বোঝা যায়। এরপর তো পোশাক ছেড়ে দিগম্বর হবার বিকল্প নেই। সে কারণেই হয়তো মুখে কুলুপ, কানে তালা। সঙ্গত কারণে এরাই আমাদের দেশের দূতদের ভজনায় ব্যস্ত। ফরহাদ মজহার ও  তার মত অনেকেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সরব থাকলেও এখন কট্টর মৌলবাদী। স্বয়ং ঈশ্বরও এদের পরিবর্তনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাচ্ছেন। বোঝার ওপর শাকের আঁটির মত এদের সঙ্গে যোগ হয়েছে আমাদের দেশে বসবাসরত দু’একটি দেশের রাজদূত।

রাষ্ট্রদূতদের কথায় কোনো দেশ চলে না। চলার কথাও নয়। তারা তা জেনেও এসব কথা বলে চলেছেন। কেন বলছেন বা কি জন্যে বলছেন তা আমাদের কারোরই অজানা নয়। আমি বরং অনুরোধ করি ইতিহাসের দিকে দেখুন। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে আমাদের যারা সবদিক থেকে কোনঠাসা করে হারিয়ে দিতে চেয়েছিল তারাই আবার মাঠে নেমেছে। তবে এবারের লড়াইটা ভিন্ন এজেন্ডার।

তারা এটা বুঝে গেছেন, বাংলাদেশের তলা এখন অনেক মজবুত। বরং তাদের সূর্যই অস্ত যাবার পথে। বিশ্বায়নের এই যুগে কিছুই  অজানা বা দূরগম্য নেই। বিলেতের অবস্হা নানা দিক থেকে নাজুক। আমেরিকা এখনো অতীতের পায়ে ভর করে ‘রাজত্ব’ চালাচ্ছে।   তাদের খবরদারি বা চোখ রাঙানির দিনও শেষ।

একদা আমাদের মত দেশগুলোর সম্পদের ওপর ভর দিয়ে নিজেদের আখের গোছানো শেষ হয়েছে বলে এখন কংকাল বেরিয়ে আসছে। তারপরও আমাদের দুর্বল রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর কারণেই তারা নসিহত করতে পারছেন।  

আমরা অবাক হচ্ছি তাদের স্ববিরোধী কথাবার্তা ও ভূমিকায়। তাদের দেশের সরকার ও পার্লামেন্টে জামায়াত নিষিদ্ধ করার কথা বললেও তারা নাকি এ দলকে মডারেট ধর্মীয় দল মনে করেন। এটা কোন ধরনের হিপোক্রেসি?  জনাব মজীনা বা যে কোনো দূতের মর্যাদা ও সম্মানের ভিত্তি তাদের পদবী। অর্থাৎ দেশটি ও তার সরকারের প্রতি, জনগণের প্রতি সম্মান আর শ্রদ্ধাবোধ। এখন তারা যদি সেদেশের সরকার বা নীতির বাইরে গিয়ে কথা বলেন- বুঝে নিতে হবে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। জামায়াতী অর্থ লবিং বা তাদের নিজস্ব বোধ যেটাই কাজ করুক না কেন এটা সৌজন্যবোধের আওতাবর্হিভূত।   বিশেষ বিশেষ কারণ বা সত্যিকার অর্থে ক্রাইসিস পিরিয়ড বাদে সব ব্যাপারে কথা বলাটা যেমন অযৌক্তিক, তেমনি অনৈতিক। তাছাড়া সারাবিশ্বে মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার বলে পরিচিতরা আমাদের দেশে জঙ্গিবাদের ব্যাপারে নমনীয় ও সরব এটাই বা কেমন কথা?

আওয়ামী লীগ-বিএনপি দ্বন্দ্ব আগে ছিল, এখনো আছে। ভবিষ্যতে কি রূপ ধারণ করবে বা কিভাবে সমঝোতা হবে তার বিচার সময়ের হাতে। কিন্তু দূতদের এমনধারা নির্লজ্জ আচরণ আগে দেখা যায় নি। তারা কখনো নির্দেশ দিচ্ছেন, কখনো উপদেশ দিচ্ছেন, কখনো বা মুখপাত্রের মত  কথা বলছেন।

রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে মন্তব্য করা আর জড়িত হয়ে কথা বলা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। এ বিষয়ে আত্মমর্যাদা নিয়ে চলার সময় এসেছে। আওয়ামী লীগ যদি মধ্যবর্তী নির্বাচনে যায়ও তার ফয়সালা হবে উভয় দলের আলাপের ভিত্তিতে। বিএনপির জয়-পরাজয়ও মূলত জনগণেরই হাতে। নানা জাতীয় সংকটের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার ভেতর দিয়েই উন্নয়নশীল নামে পরিচিত দেশগুলোর উত্তরণ ঘটে। এই সংকটও বেশিদিন স্থায়ী হবে না। লাভের লাভ বিদেশি দূতদের বকাবকি যে অসার সেটাই এবার প্রমাণিত হবে। আর এটা একবার প্রমাণ করতে পারলে এদের অবাঞ্ছিত উপদেশ ও উপদ্রব থেকেও রেহাই মিলবে। আমরা সেদিনের আশায় দিন গুণছি।

অজয় দাশগুপ্ত: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১০৪২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।