ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

পর্ব চার

পুরুষালি বাঁধ ও তিস্তার অকাল গর্ভপাত

পাভেল পার্থ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫০ ঘণ্টা, মে ৮, ২০১৪
পুরুষালি বাঁধ ও তিস্তার অকাল গর্ভপাত ছবি: সংগৃহীত

পর্ব এক: লিংক
পর্ব দুই: লিংক
পর্ব তিন: লিংক

রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দল কি বাঁধ-বিরোধী?
না। তিস্তা নদীতে বাঁধ ও ব্যারেজ নির্মাণ বিষয়ে আওয়ামী-বিএনপি, ভারত-বাংলাদেশ সবাই এক।

কারণ এরা সকলেই বাঁধ কি ব্যারেজ বানিয়ে কোনো না কোনো অভিন্ন জলপ্রবাহ হত্যা করেছে বা করে চলেছে। এদের দলীয় প্রতীক ও রাষ্ট্রীয় পতাকা ভিন্ন হলেও নদীহত্যায় এরা এক ও অভিন্ন।   যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল রিভার্সের’ এক সমীক্ষায় দেখা যায়, হিমালয় অঞ্চলের চীন বাদে দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশে প্রায় ৫৫২টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প আছে২১ । অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৪ সনে আতিফ আনসার ও অন্যান্যরা ‘আমরা কি আরো বড় বাঁধ নির্মাণ করতে চাই? বৃহৎ জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পের সত্যিকারের হিসাব’২২ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রকাশ করেছেন। জলবিদ্যুৎ নিয়ে বৃহৎ পরিসরের এ সমীক্ষায় ৬৫টি দেশের ২৪৫টি বাঁধের অথনৈতিক বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে বৃহৎ বাঁধগুলো কোনোভাবেই অর্থনৈতিক দিক থেকে সায়শ্রী ও উন্নয়নবান্ধব নয়। কিন্তু তারপরও বাঁধ নির্মাণ আর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাহাদুরি থামবে না। নদী মাটি জঙ্গল জীবন সব উথালপাথাল রক্তময় করে এক একটা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করা হয়। তারপর এসব প্রকল্প একটির পর একটি হরহামেশাই দম হারাতে থাকে। বন্ধ হয়ে যায়। তবে তাতে রাষ্ট্র, এজেন্সি, রাজনৈতিক দল বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কোনো কিছুই যায় আসে না। কারণ এদের কারোই কোলে কাখে কলিজায় বেঁচেবর্তে থাকেনি কোনো নদী, কিংবা এরা কেউই কোনো নদীর ওম কি আওয়াজে জীবনমরণের পেখম মেলেনি।

প্রতিবেশী ভাটির বাংলাদেশের কোনো বিবেচনা কি অনুমতি ছাড়াই, ভারত উজানে তৈরি করে যাচ্ছে একটার পর একটা বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প। ফারাক্কা বাঁধের ক্ষত নিয়ে টিকে থাকা মুমূর্ষু বাংলাদেশ যখন টিপাইমুখ বাঁধসহ ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের জন্যও শংকিত ও ক্ষুব্ধ; তখনি বাংলাদেশের উজানে উত্তর-পূর্ব ভারতে গড়ে তোলা হচ্ছে প্রশ্নহীনসব উন্নয়ন বাঁধ। ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২ তারিখে ‘মন্তডু-লেসকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের’ প্রথম ইউনিটের বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মেঘালয় রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী ড. মুকুল সাংমা (সূত্র : শিলং টাইমস-০১/৩/১২ এবং হিল পোস্ট-২৯/২/১২)। মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ি জেলা জৈন্তিয়ার জোয়াই শহর থেকে ৪০ ক.মি. দূরে লেসকার ১০০ মিটার ভাটিতে মন্তডু, লামু ও উমসরিয়াং নদীর ত্রিমুখী সঙ্গমে পেডেকাংসাপ গ্রামের কাছে ‘মন্তডু-লেসকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’ বাস্তবায়িত হলে খণ্ড বিখণ্ড হয়ে পড়বে ভারত-বাংলাদেশের মন্তডু-সারী-সুরমার অভিন্ন জলপ্রবাহ। ‘মন্তডু-লেসকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’ উদ্বোধন হতে না হতেই ১৯/৯/২০১২ তারিখে ভারতের বিদ্যুৎমন্ত্রী ড. এম ভিরাপ্পা মইলী মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসি পাহাড়ের উমইয়্যু নদীতে নির্মিতব্য ‘মাওফু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প’ উদ্বোধন করেন (সূত্র : মেঘালয় টাইমস ১৭/৯/২০১২)। উমইয়্যু নদীতে বাঁধ দিয়ে উক্ত বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের সিলেটের ধলা নদীর প্রতিবেশীয় বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণত বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। উজান রাষ্ট্রে অভিন্ন নদীর উপর এরকম একটির পর একটি বাঁধ নির্মিত হলেও বাংলাদেশ কখনো কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে এসব বাঁধ-বাহাদুরি প্রশ্ন করেনি। তিস্তা বিষয়ে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল কর্মসূচি করলেও, উল্লিখিত একটি বাঁধ বিষয়েও বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলসমূহ কোনো রা করেনি। যেন মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ।

........................................................

নদী মাটি জঙ্গল জীবন সব উথালপাথাল রক্তময় করে এক একটা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করা হয়। তারপর এসব প্রকল্প একটির পর একটি হরহামেশাই দম হারাতে থাকে। বন্ধ হয়ে যায়। তবে তাতে রাষ্ট্র, এজেন্সি, রাজনৈতিক দল বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কোনো কিছুই যায় আসে না। কারণ এদের কারোই কোলে কাখে কলিজায় বেঁচেবর্তে থাকেনি কোনো নদী, কিংবা এরা কেউই কোনো নদীর ওম কি আওয়াজে জীবনমরণের পেখম মেলেনি

........................................................

টিপাইমুখের মতো বড় বাঁধই কেবল নয়, মন্তডু-লেসকা কি মাওফু জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো অপেক্ষাকৃত ছোট বাঁধগুলোও উজান-ভাটির এই পানিবিজ্ঞানের সূত্র ও সমীকরণগুলো ভেঙেচুরে তছনছ করে দিবে। উল্টেপাল্টে যাবে আমাদের জলের জীবন ও নদীসভ্যতা। বাংলাদেশকে দ্রুত মাওফু, মন্তডু-লেসকাসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রস্তাবিত সকল বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে ভারতের সাথে আন্ত:রাষ্ট্রিক সংলাপে বসা জরুরী। যৌথ নদী বৈঠক, সার্ক সম্মেলন কি ভারত-বাংলাদেশ সফরে বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা ও ফায়সালা করা জরুরী। কারণ এর সাথে বাংলাদেশের ভূগোল ও জনগণের টিকে থাকা না থাকার প্রশ্ন জড়িত।

প্রবাহিত জলধারাকে বাঁধ দিয়ে অন্যায় শাসনের মাধ্যমে কেবল রাষ্ট্রীয় রাজনীতির পুরুষালি বাহাদুরিকেই জাহির করা যায়। কোনোভাবেই তা প্রাণ ও প্রকৃতির বিরাজমান ন্যায়বিচারকে নিশ্চিত করে না। ভারতের দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি অঞ্চলে নির্মিত উপমহাদেশের প্রথম জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এক লাখ আদিবাসী জীবন উচ্ছেদ করে তৈরি হওয়া বাংলাদেশের কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটিও আর মাজা খাড়া করে দাঁড়াতে পারছে না। ফারাক্কা বাঁধের ক্ষত নিয়েই আমাদের জন্ম-মৃত্যুর আখ্যান বয়ে চলেছে। এককালে উত্তর-পূর্ব ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বনভূমি থাকলেও আজ তা বিলীন। অধিকাংশ পাহাড় করপোরেট চুনাপাথর ও কয়লা খনি প্রকল্পের জন্য ফাঁপা হয়ে গেছে। অল্প বৃষ্টিতে এসব পাহাড় ভেঙে পড়ছে বাংলাদেশের উপর। পাহাড়ি বালিতে বিধ্বস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলের কৃষিজমি ও বসতভূমি। ২০ জুলাই ২০০৮ তারিখে মেঘালয় পাহাড় ভেঙে বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার বিস্তীর্ণ সীমান্ত অঞ্চলের জনজীবনকে সম্পূর্ণত নিশ্চিহ্ন করে দেয়। ঝুঁকিপূর্ণ উজানের পাহাড়ে একটার পর একটা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ও বাঁধ নির্মাণ এই বিপর্যয় আরো বাড়িয়ে তুলতে বাধ্য।

........................................................

তিস্তা নিয়ে গণমাধ্যমের সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারে আরো নদীমুখী হওয়া জরুরি। গণমাধ্যম হরহামেশাই ‘নদী গর্ভে বিলীন’ কি ‘রাক্ষুসী নদী’, করাল গ্রাস এরকম অসংবেদনশীল প্রত্যয় ব্যবহার করে। যে নদীর গর্ভকে টেনে হিঁচড়ে খুন করা হয়েছে তার আবার গর্ভ থাকে কী করে? নদী কি কখনো করালগ্রাসী বা রাক্ষুসী হয়? অধিকাংশ সংবাদ পরিবেশনাই নদী নিয়ে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও দেনদরবারকে বিশ্লেষণ করতে পারে না বা করতে চায় না

........................................................

 

তিস্তাকে আগলে দাঁড়ান
তিস্তা নিয়ে জন ও নদীমুখী গবেষণা কাজের বড়ই অভাব। তিস্তা অববাহিকার রাজনৈতিক-অর্থনীতি শীর্ষক এক সমীক্ষায় এশিয়া ফাউন্ডেশন জানায়, তিস্তা নদীর পানির ন্যায্যতার জন্য ভারত ও বাংলাদেশকে এ অভিন্ন নদী সম্পর্কিত সকল তথ্য জনগণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে২৩। কিভাবে তিস্তাকে খুন করবেন শীর্ষক লেখায় ভারত ঝুনঝুনওয়ালা জানান, তিস্তা নদীর পানিবন্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশ এক চরম দরবারে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ চাইছে তিস্তার ৫০ ভাগ পানি, কিন্তু কলকাতা দিতে চাইছে ২৫ ভাগ। উভয়দেশের জনগণকে নিজ সামর্থ্যে তিস্তার পানিপ্রবাহের বর্তমান পরিস্থিতি জানা জরুরী। তিস্তা কতটুকু পানি উজান ও ভাটিতে সরবরাহ করতে পারবে তার জনসমীক্ষা হওয়া জরুরি। আর এ সমীক্ষাপত্র নিয়েই ভারত ও বাংলাদেশের জনগণকে রাষ্ট্রের সাথে দরবার করতে হবে২৪। তিস্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ জলধারা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা না হলেও আশ্চর্যরকম গবেষণার নজির উজান কি ভাটি উভয় অঞ্চলেই আছে। তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের ফলে জলবায়ুগত কী ধরণের পরিবর্তন ঘটেছে এ নিয়ে গবেষণা করেছেন ডিসি সরকার ও অন্যান্যরা। তারা দেখান, উক্ত প্রকল্পের ফলে তাপমাত্রায় তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, কিন্তু বৃষ্টিপাতে কিছু তারতম্য হয়েছে। আর্দ্রতার ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন না দেখা গেলেও বাষ্পীভবনে কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায়। তারা তিস্তার ব্যারেজের উপরিতলের পানি ব্যবহারকেই কৃষকদের জন্য সর্বোত্তম পরিবেশবান্ধব বলে মত দেন২৫ । জরুরি হলো তিস্তার উজান-ভাটির নদী ব্যাকরণকে জানা বোঝা, আর তা হওয়া জরুরি তিস্তাবাসী নিম্নবর্গের যাপিতজীবনের জায়গা থেকেই।

তিস্তা নিয়ে গণমাধ্যমের সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারে আরো নদীমুখী হওয়া জরুরি। গণমাধ্যম হরহামেশাই ‘নদী গর্ভে বিলীন’ কি ‘রাক্ষুসী নদী’, করাল গ্রাস এরকম অসংবেদনশীল প্রত্যয় ব্যবহার করে। যে নদীর গর্ভকে টেনে হিঁচড়ে খুন করা হয়েছে তার আবার গর্ভ থাকে কী করে? নদী কি কখনো করালগ্রাসী বা রাক্ষুসী হয়? অধিকাংশ সংবাদ পরিবেশনাই নদী নিয়ে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও দেনদরবারকে বিশ্লেষণ করতে পারে না বা করতে চায় না।

 

তিস্তা নিয়ে আলাপের এক প্রধান অনুষঙ্গ চুক্তি, আইন ও সনদ। পানিবিজ্ঞানী আইনুন নিশাত ও অন্যান্যরা মনে করেন, তিস্তাই হয়তো অভিন্ন নদীর পানির সমবন্টনের ক্ষেত্রে প্রথম রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, বাংলাদেশ ও ভারত যা ১৯৭৩ সনে এ প্রয়াস শুরু করেছিল। তখন তিস্তার দুই তীরের ভেতর সীমান্ত দিয়ে ভাগ দূরত্ব কমিয়ে আনার চিন্তা করা হয়েছিল২৬ । ১৯৭২ সালে গঠিত ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন অভিন্ন তিস্তা বিষয়ে এখনও পর্যন্ত তেমন কোনো নদী-জীবনবান্ধব রাজনৈতিক উদ্যোগ নেয়নি। ১৫-১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৬ তারিখের যৌথ নদী কমিশনের(জেআরসি) বৈঠকের পর বাংলাদেশে জেআরসির সচিব পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তা পানি বন্টন চুক্তিসহ অভিন্ন ৫৪টি নদী বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্তের কথা জানা যায়। ১৯৯৬ সালে নেপালের সাথে মহাকালী চুক্তি সইয়ের বছর ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফারাক্কা চুক্তিতে উভয়পক্ষের শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ, সমতাকেন্দ্রিক আন্ত:রাষ্ট্রিক নদী ব্যবহারের কথা উল্লেখ আছে। চুক্তিতে স্পষ্ট বলা আছে ... ÔGuided by the principles of equity, fairness and no harm to other party, both the governments agree to conclude water sharing treaties/agreements with regard to other common rivers (Article IX )’ । কিন্তু ফারাক্কা চুক্তি করার পরও অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুক্তির বিষয়গুলো নদী-অধিকারের জায়গা থেকে পালিত হয়নি। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনের বাংলাদেশ শাখা ভারতের অসন্তুষ্টি এড়ানোর জন্য গঙ্গা এবং ফারাক্কা বিষয়ে সাম্প্রতিক তথ্য ও উপাত্ত নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে নিরুৎসাহিত করে। ১৯৯৬-৯৭ সালের শুকনো মৌসুমের কথা বলা যায়, সর্বশেষ ফারাক্কা চুক্তি স্বাক্ষরের মাত্র কয়েক মাস পর সরকার বাংলাদেশে হার্ডিঞ্জ ব্রীজের নিকটস্থ পানি পরিমাপক কেন্দ্র থেকে নদীর প্রবাহের উপাত্ত প্রকাশ নিষেধ করে দেয়। সেই বছর গঙ্গার প্রবাহ ৬,০০০ কিউসেক নেমে আসে যা গঙ্গার পানি প্রবাহের এ যাবতকালের সর্বনিম্ন রেকর্ড।

..........................................................

জলপ্রবাহের গতিধারা বদলে যাওয়ায় তিস্তার জেলে ও মাঝিদের জীবন হয়েছে সবচে বিপন্ন। অধিকাংশের নির্মম অভিবাসন ঘটেছে শহরের গার্মেন্টস, রিকশা গ্যারেজ, ইটভাটা কিংবা দিনমজুরিতে। তিস্তার ফলে গ্রামজীবন থেকে উদ্বাস্তু এসব মানুষদের অনেকেই আহত ও নিহত হয়েছেন তাজরীন, স্পেকট্রাম কিংবা রানাপ্লাজার বিপর্যয়ে। এ যেন নদীর মতো জীবন, নিম্নবর্গ ও নদীর জীবন একই ধারায় সংগ্রামমুখর। উভয়েই তথাকথিত উন্নয়ন বলপ্রয়োগের চরম নিশানা। উন্নয়নের ক্ষত নিয়ে উভয়েই সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখবার সংগ্রাম করে চলেছে নিরন্তর

..........................................................

 

ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েই রামসার ঘোষণা ও আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ স্বাক্ষর করেছে। আন্তজার্তিক আইন ও নীতি লংঘন করে কোনো প্রবাহমান জলধারাকে একতরফাভাবে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উন্নয়নের বাহাদুরি করার এখতিয়ার কারোর নাই। রামসার সনদের (১৯৭২) ৫নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘চুক্তিবদ্ধ পক্ষ রাষ্ট্রসমূহ রামসার সম্মেলন থেকে উদ্ভূত দায়-দায়িত্ব বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পরস্পরের সাথে আলাপ আলোচনা করবে, বিশেষত এমনসব জলাভূমির ক্ষেত্রে যা এখাধিক রাষ্ট্রের ভৌগলিক এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এবং যেসকল জলপ্রণালী এক বা একাধিক রাষ্ট্র ব্যবহার করে। একইসাথে রাষ্ট্রগুলো জলাভূমি এবং জলাভূমির উদ্ভিদ ও প্রাণীক’লে সংরক্ষণের জন্য বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নীতিমালা ও বিধান বাস্তবায়ন করবে। ’ জাতিসংঘের আন্তজার্তিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ ১৯৯২ এর ১৪নং অনুচ্ছেদের ‘ঘ’ ধারায় স্পষ্ট করে উল্লেখ রয়েছে, ‘চুক্তিবদ্ধ পক্ষ রাষ্ট্রের আওতাধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় সৃষ্ট কোনো কারনে যদি অন্য কোনো রাষ্ট্রের প্রাণবৈচিত্র্যে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে তবে সম্ভাব্য ক্ষতির শিকার সেই রাষ্ট্রকে তা অবহিত করতে হবে এবং ক্ষতির পরিমান কমিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ’

শত সহস্র আইনি কাঠামো বা চুক্তির শর্ত থাকলেই কি এসব মান্য করা হয়? তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে তুলকালাম করে ফেলা বাংলাদেশ কি তার নিজ দেশের ভেতর নদীগুলোর ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে পেরেছে? পারেনি। কারণ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কি ভারত নদী বিষয়ক চিন্তা ও মতাদর্শে এক ও অভিন্ন। অভিন্ন নদীর ন্যায্য প্রবাহের জন্য প্রথম দরকার রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও স্পষ্ট নদীদর্শন। তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার জেলেদের কাছে নদীর দেবতা বুড়ারাই। বছরে মাছ ধরার শুরুতে বুড়ারাই কৃত্য পালিত হয় সামাজিকভাবে। নদীর ভেতরেই জলপ্রবাহে চিহ্নিত থাকে বুড়ারাই এর পবিত্র স্থল। তিস্তা অববাহিকায় রাজবংশী ও বাঙালি হিন্দুদের ভেতর হুদুমদেও, চুবুছনি, ধাড়িয়া, মাসান, খুঁটিপূজা তিস্তা অবববাহিকার সংস্কৃতি হিসেবেই পালিত হয়। তিস্তার ধারা ও প্রবাহ ক্ষত বিক্ষত ও মুমূর্ষু হয়ে পড়ায় এসব নদীকৃত্য এখন নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে। তিস্তার তীরে অষ্টমী ও মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীর পবিত্র স্নানও ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। তিস্তা অববাহিকায় নানান উৎসব পার্বণে আয়োজিত গ্রামীণ মেলাগুলোতেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে চলেছে। জলপ্রবাহের গতিধারা বদলে যাওয়ায় তিস্তার জেলে ও মাঝিদের জীবন হয়েছে সবচে বিপন্ন। অধিকাংশের নির্মম অভিবাসন ঘটেছে শহরের গার্মেন্টস, রিকশা গ্যারেজ, ইটভাটা কিংবা দিনমজুরিতে। তিস্তার ফলে গ্রামজীবন থেকে উদ্বাস্তু এসব মানুষদের অনেকেই আহত ও নিহত হয়েছেন তাজরীন, স্পেকট্রাম কিংবা রানাপ্লাজার বিপর্যয়ে। এ যেন নদীর মতো জীবন, নিম্নবর্গ ও নদীর জীবন একই ধারায় সংগ্রামমুখর। উভয়েই তথাকথিত উন্নয়ন বলপ্রয়োগের চরম নিশানা। উন্নয়নের ক্ষত নিয়ে উভয়েই সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখবার সংগ্রাম করে চলেছে নিরন্তর। তিস্তাকে বুঝতে হবে তিস্তার উজান-ভাটির ঐতিহাসিক প্রবহমানতার বিজ্ঞান দিয়েই। বৈরাল মাছের আহাজারি কি তিস্তাপাড়ের নিম্নবর্গের যাপিতজীবনের সংগ্রামই তিস্তাকে বাঁচানোর মূল রাজনৈতিক কায়দা। রাষ্ট্রকে নিম্নবর্গের তিস্তাজীবনের সাথে সামিল হতে হবে, আগলে নিতে হবে রক্তাক্ত তিস্তাধারা। ইতিহাস স্বাক্ষী, তিস্তার জয় অনিবার্য।

সমাপ্ত

............................................................................................................................

২৩ POLITICAL ECONOMY ANALYSIS OF THE TEESTA RIVER BASIN,  March 2013, Prepared by The Asia Foundation 465 California Street, 9th Floor San Francisco, CA 94104 USA

২৪ Bharat Jhunjhunwala, 2011, How to kill Teesta, Frontier, Vol. 44, No. 17, November 6-12, 2011

২৫ Sarker, D.C., Pramanik, B.K., Zerin, A.I. and Ara, I. 2011, Climatic Impact Assessment: A Case Study of Teesta Barrage Irrigation Project in Bangladesh, International Journal of Civil & Environmental Engineering IJCEE-IJENS Vol: 11 No: 01 75

২৬ Nishat, A., Faisal, I.M. (2000). An Assessment of the Institutional Mechanisms for WaterNegotiations in the Ganges-Brahmaputra-Meghna System.International Negotiation, 5: 289-310.


 

পাভেল পার্থ। গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ।
animistbangla@gmail.com

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।