নগর, নগরায়ণের চরিত্র, আমাদের নগরমুখিতা, এর বিস্তার, পরিকল্পনা, নগর বিস্তারে বিনিয়োগ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এই বিশেষ রচনা
কিস্তি ৩ পড়তে ক্লিক করুন
শেষ কিস্তি
প্রকট যানজট নগরের সড়কগুলোর জন্য তৈরি করেছে আরেকটি সমস্যা। গণপরিবহণের সংখ্যা খুবই কম থাকায় ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থায় ব্যাপক অবনতি ঘটছে।
বিগত কয়েক দশকে দ্রুত নগরায়নের কারণে বিপুল সংখ্যক মটরযান আমদানি হয়েছে দেশে। সার্বিকভাবে রাস্তা বড় করা হয়নি অথচ যানবাহনের চাপ বেড়ে যাবার কারণে ভয়ানক অবনতি ঘটেছে নাগরিক পরিবেশের।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, নগরবাসীরা আবাসন সেবা পাচ্ছে না। ব্যাপকভাবে নগরের অর্থনীতিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ভূমির সংকট বড় ধরনের বাধা হয়ে উঠছে। অপরদিকে আবাসন বাণিজ্যের সরাসরি প্রভাব পড়ছে নগর পরিবেশের ওপর। যথাযথ ভূমি উন্নয়ন না হওয়া, আবাসন ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার নীতিগত সংকট এবং নগরের অবকাঠামো ও সেবার ধীর গতিপ্রকৃতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নগর জীবন। এর ফলে নগর এলাকায় অপরিকল্পিত কিংবা খণ্ডিত ভূমি উন্নয়ন গড়ে উঠছে।
পরিস্থিতি খারাপ হবার আরেকটি কারণ হল জমির দাম বেড়ে যাওয়া। ১৯৯১ সালে শহরে আবাসন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ১০ লাখের নিচে। ২০০১ সালেই তা চলে গেছে ১১ লাখের ওপরে। ঘরহারা মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে শহরে। বাড়ি যেগুলো আছে সেগুলোর অবকাঠামো মজবুত নয়, গ্যাস পানি বিদ্যুতের অভাব। যথাযথ পরিকল্পনা ছাড়াই বেড়ে উঠছে এসব। ২০০৭ সালের জরিপে ২০০৫ সালে নগর এলাকায় ২৫ শতাংশ বাড়ি তৈরি হয়েছে ইট ও সিমেন্ট দিয়ে। এ সময়ে প্রায় ৭২ ভাগ বাড়ি তৈরি হয়েছে সিআই শিট আর কাঠ দিয়ে এবং ৫ শতাংশ বাড়ি উঠেছে ছন-খড় ও বাঁশ দিয়ে।
নগরে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি এবং এর ফলে ভূমি ও আবাসন চাহিদা বৃদ্ধি নগরের পরিস্থিতিকে আরো মারাত্মক করে তুলেছে। বিশেষ করে বড় বড় শহরগুলোতে এ ঘটনা ঘটছে। খুব কম বাড়ির মালিকই আবাসন সুবিধা ও আবাসন ঋণ সুবিধা পায়। সবচেয় খারাপ অবস্থা হল কম আয়ের মানুষদের। আর গরিব মানুষদের অবস্থা একেবারেই খারাপ। তারা সাধারণত শহরের প্রান্তে বসতি গড়ে বসবাস করছে। অপরদিকে স্বল্প মেয়াদের কারণে গরিব মানুষ তাদের আবাসন ঋণ যথাসময়ে পরিশোধ করার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। এতে ঋণ সুবিধা নিতে না পারার কারণে আবাসন নির্মাণের ক্ষমতার পুরোপুরি বাইরে চলে যাচ্ছে স্বল্প আয়ের গরিব জনগোষ্ঠী। এতে করে একদিকে নিম্ন মানের আবাসন গড়ে উঠছে অপরদিকে বস্তিরও বিস্তার ঘটছে।
৮.২. পাঠ ও শিক্ষা
ভারত অথবা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে যেটি ঘটেনি, বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার সংস্কার পদক্ষেপের কেন্দ্রবিন্দুটাই ছিল গ্রাম সরকার। সেবা প্রদান বা অন্যান্য কার্যক্রমের আলোকে সিটি করপোরেশন আর পৌরসভার মধ্যে পার্থক্য নেই বললেই চলে। স্বাভাবিকভাবেই, স্যানিটেশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সড়ক, সড়কবাতি, যান নিয়ন্ত্রণ, নাগরিক দারিদ্র্য ও বস্তি উন্নয়ন এসবই সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভার দায়িত্ব। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মতো বড় শহরে পানি সরবরাহ আর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার কাজ করে ওয়াসা। ঢাকায় ঢাকা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, রাজউক, এবং চট্টগ্রামে আছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা সিডিএ। যেমন দিল্লীতেও এসব কাজ করে দিল্লী উন্নয়ন সংস্থা বা ডিডিএ। রাজস্বের উৎস হচ্ছে সম্পত্তির ওপর কর, জনসেবাখাতে আদায়কৃত কর, জরিমানা, ভাড়া বাবদ আয়, সরকারি মঞ্জুরি আর তহবিল। নগর এলাকায় স্থানীয় বিনিয়োগের একটা বড় অংশ পূরণ করে থাকে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো।
২০০৫ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্টে বলা হয়, ২০০১-০২ সালে ঢাকা সিটি কাউন্সিলের আয়ের প্রধান উৎস ছিল ট্যাক্স (৪৮%) এবং ভাড়া বাবদ (২১%) আয়। আর এসব আয়ের বিপরীতে ব্যয়ের সবচেয়ে বড় অংশটাই গেছে (৪৪%) কর্মীদের বেতনের পেছনে।
আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে আরও ঘাটতি আছে সমন্বয়ের। অতিরিক্ত দায়িত্ব ও কাজের ফলে এসব সমন্বয়হীনতা মারাত্মক আকার ধারণ করে। দক্ষিণ এশিয়ার বহু শহরের মতই দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে নগরের স্থানীয় বিভাগগুলোকে জবাবদিহীর আওতায় আনা দরকার। তবে এর জন্য প্রচলিত সমাধানগুলো বাস্তবায়নেরও বহু সুযোগ রয়েছে। যেমন কর নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানো। বিশেষত সম্পত্তির কর, সেবা কর, সেবার মূল্য পরিপূরণ করাসহ ব্যয়ের মানগত উন্নতি সাধন করা।
বাংলাদেশে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে গত দু দশক ধরে এসটিআইডিপি-১ ও ১১-এমএসপির নগর অবকাঠামোগত উদ্যোগ চলছে। তবে ২০০৩ সাল থেকে ইউজিআইআইপি-১ চলমান রয়েছে। এমএসপি ও এর পরবর্তী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মিউনিসিপার ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (বিএমডিএফ) স্থানীয় সরকারের বিকেন্দ্রীকরণে সহায়ক মডেল তুলে ধরতে পেরেছে। অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে অবকাঠামোগত তহবিল গড়ে তুলতে বিএমডিএফ কাজ করে।
তবে ইউজিআইআইপি-১ বড় ধরনের পার্থক্য ঘটাতে সক্ষম হয়। যেটি বিভিন্ন সময়ে অবকাঠামোগত তহবিল গঠনে সরকারের অগ্রগতিতে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর কাজের সাথে সম্পর্কিত সাম্প্রতিক উদ্যোগ।
নগরের অবকাঠামোগত উন্নয়নের ভিত্তিতে সুশাসনের অগ্রগতি ও কৃতিত্ব খুবই সফলভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ১. অর্থনৈতিক জবাবদিহিতা ও উন্নত প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় সেবার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পক্ষ ও গ্রুপের সমৃদ্ধ অংশগ্রহণের বিষয়গুলো একইসময়ে ঘটাতে পেরেছে ইউজিআইআইপি-১। ২. সুশাসনগত সংস্কারের অগ্রগতিতে স্থানীয় সরকারগুলো পূর্ণ অধিকারের বিষয়টি উপলব্ধি করে। এতে তাদের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ঘাটতি কাটিয়ে তোলার সুযোগ তৈরি হয়। ৩. সুশাসনের জন্য বড় ধরনের অগ্রগতি জরুরি। এবং সময়মত এর সক্ষমতা গড়ে তোলাও জরুরি।
আগের প্রকল্পগুলোর পর্যালোচনার ভিত্তিতে সুশাসনের অগ্রগতির উপর জোর দেয়া জরুরি। যেমন ১. কৌশলগুলো নিশ্চিত করা, যেগুলো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনকে প্রাধান্য দিয়ে অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা নিশ্চিত করবে। ২. মানসম্পন্ন অর্জনে কর্ম পরিকল্পনার অগ্রগতিতে সুশাসনের সংশোধন করা। ৩. অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে আন্তরিকতার চর্চা করা। ৪. সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর জবাবদিহিতা এবং নাগরিকের কাছে যাওয়ার বিষয়গুলো শক্তিশালী করা। ৫. বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় প্রশাসনগুলোর সক্ষমতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যাপক গুরুত্বারোপ করা। ৬. সেইসাথে অগ্রগতি ও ব্যবস্থাপনায় বিশেষভাবে নজর দেয়া।
সুশাসনের উন্নয়ন সম্ভব হলে সমস্যা সমাধানের পথ খুলে যাবে আমাদের সামনে। পৌরসভাগুলোকে আরও কার্যকর করে তোলার লক্ষ্যে সংসদে পাশ করা হয়েছে পৌরসভা বিল ২০০৯ এবং সিটি করপোরেশন বিল ২০০৯। আরবান লোকাল গভর্নমেন্টের কাজ সুষ্ঠুভাবে করার পথে প্রধান বাধা চাহিদার বিপরীতে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে অপ্রতুল সুযোগ। এর সমাধানে যা করা যায় তা হচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ে সরকার নির্ভর সেবা প্রদানের দায়িত্ব কমিয়ে আনা, স্থানীয় রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ বাড়ানো এবং সেবা প্রদান কার্যক্রমে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব তৈরি করা।
৯. এগিয়ে যাওয়ার পথ
অর্থনৈতিক প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর স্থানীয় সরকারের নির্ভরতা কমাতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে আদায় বাড়াতে হবে। এটি করার সুন্দর একটি পথ স্থানীয় ভিত্তিতে একটি লোকাল গভর্নমেন্ট ফাইনান্স কমিশন (এলজিএফসি) গঠন করা। এদের কাজের মধ্যে থাকতে পারে, স্থানীয় সরকার সংস্থার বিভিন্ন উৎস কাজে লাগানোর পথ খুঁজে বের করা; কর, খাজনা ইত্যাদির উৎস খুঁজে বের করা ও তা আদায়ে সক্রিয় হওয়া, সম্পত্তির মূল্যায়ন কাজে সহায়তা প্রদান; কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ এবং মঞ্জুরি নিশ্চিত করা, কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া, কেন্দ্রের সাথে আর্থিক বিরোধের প্রশ্নে তা মীমাংসা করা, স্থানীয় সরকারের করা ব্যয়ের খতিয়ান তৈরি করা; আর্থিক কাঠামো তৈরি করে দেয়া। কমিশনের চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য সদস্য বাছাই করা হবে সতর্কতার সাথে এবং পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন দিতে হবে তাকে। এটি কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাখা যাবে না বা সংসদে জবাবদিহিতা থাকবে না এর।
- স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে উৎসগুলো সচল রাখার জন্য উপযুক্ত নীতি ও প্রক্রিয়া গঠন করা।
- কর, খাজনা, টোল, ফি’র সমূহ খাত ও উৎস এবং আদায়ের সুবিধা বা উপায় চিহ্নিত করা।
- সম্পত্তি, আয় এবং করারোপের অন্যান্য সম্পত্তির পর্যালোচনায় সহায়তা করা।
- কেন্দ্রীয় সরকার থেকে স্থানীয় সরকার পর্যন্ত সরকারি মঞ্জুরি ও হস্তান্তরের বিষয়গুলো নির্ধারণ করা।
- কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেট থেকে স্থানীয় সরকারগুলোর বিভিন্ন বিভাগের জন্য তহবিল বরাদ্ধ করা।
- স্থানীয় সরকারগুলোর বিভিন্ন স্তরের রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা। সেইসাথে সরকার থেকে মঞ্জুরি ঠিক করতে সুপারিশনামা তৈরি করা।
- স্থানীয় সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে উদ্ভূত যেকোনো অর্থনতিক বিষয়ে দ্বন্দ্ব সংঘাত নিরসন করা।
- স্থানীয় সরকারের আয়-ব্যয় পর্যবেক্ষণ ও অর্থনেতিক তত্ত্বাবধান করা।
- স্থানীয় সরকারের বিভাগগুলোর অর্থনিতিক নীতিমালা গঠন করা।
তহবিল গঠনের লক্ষ্যে পৌরসভা বণ্ড ইস্যু করার কথাও ভাবতে পারে সিটি করপোরেশনগুলো। তবে প্রক্রিয়াটি অল্প জটিল নয়। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন সবাইকে খতিয়ে দেখতে হবে বিষয়টি। তার আগে কর্মদক্ষতা বাড়াতে হবে করপোরেশনগুলোর। বিশ্বখ্যাত মুডি এবং এসঅ্যান্ডপি এর নিকট থেকে ইতোমধ্যেই সভারেন ক্রেডিট রেটিং অর্জন করেছে বাংলাদেশ। অতএব এখনই উচিত হবে কাজে নেমে পড়া। ২০০২ সালে ড্যানিয়েল আর বিজয়কুমারের এক গবেষণায় দেখা যায়, বিশ শতকের শেষ দশকে যুক্তরাষ্ট্র বাদে ২ টি দেশের ৪০০ স্থানীয় সরকার কেবল পৌরসভা বণ্ড ইস্যু করার মাধ্যমেই আদায় করে প্রায় ২৭ হাজার কোটি ডলার।
লেখক : সাবেক গর্ভনর, বাংলাদেশ ব্যাংক
অনুবাদ: শাহাদাৎ তৈয়ব
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৩ ঘণ্টা, আগস্ট ৪, ২০১৪