আমি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কিংবা রাজনীতি বিশ্লেষক নই। স্থানীয় কিংবা জাতীয় কোনো রাজনীতির সাথেও জড়িত নই।
রাজ+নীতি অর্থাৎ রাজনীতির সাথে নীতির সম্পর্ক আছে এবং এই সম্পর্ক খুব গভীর। নীতির বিচারে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সৎ, পরিশ্রমী, নির্লোভ, নিরাহংকার, সদালাপী, সংযমী, দেশপ্রেমিক এবং জনদরদী হবেন---এমনটাই কাম্য। তিনি জনগণের বন্ধু, সেবক, অভিভাবক, সুখ-দুঃখের সাথী হবেন। তিনি কখনও জনগণের নেতা/নেত্রী বনে যেতে পারেন না। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্রদ্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমান একজন প্রকৃত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি জনগণের নেতাই শুধু ছিলেন না, পাশাপাশি জনগণ তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ অর্থাৎ বন্ধু এবং জাতির পিতা অর্থাৎ অভিভাবক মানতেন। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শকে মানুষ আজো শ্রদ্ধা ও সম্মান করেন। সেদিক দিয়ে তিনি দলমতের ঊর্ধ্বে স্থান পাওয়ার যোগ্য।
জনগণের নির্বাচিত রাজনৈতিক দলই সরকার গঠন করে। সেই সরকারের একটি কেবিনেট বা মন্ত্রী পরিষদ থাকে। মন্ত্রী পরিষদের প্রধান হন প্রধানমন্ত্রী।
সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন বলে অর্থাৎ যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন লাভ করবেন মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে তিনি যেভাবে চান সেইভাবে অন্যসব মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপ-মন্ত্রী মনোনীত হয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে সংবিধানের ৫৬(২) ধারায় উল্লেখ্য আছে: ‘তবে শর্ত থাকে যে, তাঁহাদের সংখ্যার অন্যুন নয়-দশমাংশ সংসদ-সদস্যগণের মধ্য হইতে নিযুক্ত হইবেন এবং অনধিক এক-দশমাংশ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হইবার যোগ্য ব্যক্তিগণের মধ্য হইতে মনোনীত হইতে পারিবেন। ’
সংবিধানমতে পুরো মন্ত্রিসভা মহান জাতীয় সংসদের নিকট যৌথভাবে দায়ী থাকবেন। একথা দিবালোকের মত সত্য যে, অযোগ্য ব্যক্তিকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং উপ-মন্ত্রীর মত মর্যাদা ও গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হলে ঘুরেফিরে বড় ক্ষতিটা মন্ত্রিসভা এবং সরকারি দলেরই হয়ে থাকে।
আমাদের দেশে প্রতি পাঁচ বছর পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিধান আছে। অর্থাৎ প্রতি পাঁচ বছর পরপর ক্ষমতার পালাবদলের সুযোগ আছে। দলীয় সরকার পরিবর্তন হবার সুযোগ থাকে। আমাদের দেশের সংস্কৃতি হল প্রধানত রাজনৈতিক দলগুলোই সরকার গঠন করে থাকে। রাজনীতির মাঠে রাজনীতিকদের অংশগ্রহণে একটি প্রতিযোগিতা থাকা খুবই প্রাসঙ্গিক। না হলে নির্বাচনের প্রয়োজন হতো না। ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে ভাল পারফর্ম্যান্স করার মানসিকতা লোপ পেয়ে যেত। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে মহান সংসদে সমানে সমান বিরোধী দল থাকা মানে রাষ্ট্র এবং জনগণের মঙ্গল। তবে বিরোধী দল মানেই কিন্তু সবকিছুতেই ঢালাও বিরোধিতা করা নয়। ভাল কিছু হলে তাকে সমর্থন দেওয়া এবং ক্ষতিকর কিছু হলে জনগণকে সাথে নিয়ে তা সংশোধন করার চেষ্টাই হল বিরোধী দলের কাজ। আসলে ‘বিরোধী’ শব্দটিকে কেন যেন অসমঞ্জস বা বেমানান শব্দ বলে মনে হয়। যে দলে যত বেশি দক্ষ, নিস্বার্থ ও যোগ্য রাজনীতিক থাকবেন সে দল তত বেশি ভাল করবে, ক্ষমতায় যাবে এবং দেশ ও দশের কল্যাণ করার সুযোগ পাবে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বাংলাদেশে কোনো বিভাগ আছে বলে মনে হয় না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এক সময় অনেকটাই রাজনীতির প্রভাবমুক্ত ছিল। সময়ের আবর্তনে এখন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও সেই ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। আমার ধারণা, এমন একটা সময় আসবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে কে কে থাকবেন আর কে কে থাকবেন না সেটাও রাজনীতিনির্ভর হয়ে যেতে পারে। যদিও সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে, রাজনীতি এমন এক মূল্যবান সম্পদ যার প্রভাব রাষ্ট্রের সর্বত্র বিরাজমান।
এক মনীষী বলেছেন, ‘রাজনীতির মত বড় জুয়া খেলা আর নেই। ’ তিনি বোধহয় হার - জিৎ এর উপর বিবেচনা রেখেই উক্তিটি করেছেন। আর না হলে জুয়াড়ি আর রাজনীতিক এক কথা নয়। রাজনীতি করা আর জুয়া খেলা সমার্থক নয়। জুয়া খেলায় নিঃস্ব হলে তার কোনো মহানতা নেই কিন্তু রাজনীতি করে নিঃস্ব হলে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে উঠে যান। জুয়া কোনো সেবাধর্ম নয়। কিন্ত রাজনীতি সেবাধর্মও বটে। জুয়া খেলায় কোনো পূণ্য নেই। কিন্ত রাজনীতিতে পূণ্য অর্জনের সুযোগ আছে। একজন দক্ষ পেশাদার জুয়াড়ির সভ্য সমাজে কোনো সম্মান নেই। কিন্তু দক্ষ পেশাদার রাজনীতিককে সভ্য সমাজ সমাদর এবং সমীহ করে। রাষ্ট্র এবং জনগণের কাছে তাঁর মূল্য অনেক। তাই রাজনীতি একটি দেশের অনেক বড় সম্পদ। এই সম্পদের উপর নির্ভরশীল হয়ে আছে আমাদের অন্য সকল সম্পদ। এই সম্পদ যাতে নষ্টদের হাতে চলে না যায় সেদিকে যত্নশীল হতে হবে। সকল রাজনীতিক নিজেদের অবস্থা এবং অবস্থান পরিবর্তনের জন্য রাজনীতিকে ‘সোনার ডিমপাড়া হাঁস’ মনে করেন না। তবে রাজনীতির ক্ষেত্রটা যদি আগাছায় ঢেকে যায় তাহলে রাজনীতির সোনা ফলা উর্বর ক্ষেত্রটিকে মানুষেরা ভাগাড় ভাবা শুরু করবে। এই দুর্দিন যেন কখনও না আসে।
progyananda@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৫০৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০১৪