ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

সাদাসিধে কথা

একটি অসাধারণ আত্মজীবনী

মুহম্মদ জাফর ইকবাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০২২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৪
একটি অসাধারণ আত্মজীবনী

মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমাদের কতো বড় সৌভাগ্য যে, বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মানুষের জন্ম হয়েছিল। ঠিক যেই সময়টিতে দরকার হয়েছিল, তখন যদি তার মতো একজন মানুষের জন্ম না হতো তাহলে কী হতো? তাহলে কী বাঙালিরা নিজের একটা দেশের স্বপ্ন দেখতে পারতো?

সেই দেশের জন্যে যুদ্ধ করতে পারতো? অকাতরে প্রাণ দিতে পারতো? যদি আমরা নিজের একটি দেশ না পেতাম, এখনো পাকিস্তান নামে সেই বিদঘুটে দেশটির অংশ হিসেবে থাকতাম, তাহলে আমাদের কী হতো, সেই কথা চিন্তা করে আমি আতঙ্কে শিউরে উঠি।



এই মানুষটিকে পঁচাত্তরে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। পৃথিবীর অনেক দেশেই অনেক মহামানবকে নিজের দেশ কিংবা দেশের মানুষের জন্যে প্রাণ দিতে হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বিষয়টি ছিল অবিশ্বাস্য।

তাকে সপরিবারে হত্যা করেই হত্যাকারীরা দায়িত্ব শেষ করেনি, এই দেশের ইতিহাস থেকে তার চিহ্ন মুছে দেওয়ার জন্যে একুশটি বছর এমন কোনো কাজ নেই যেটি করা হয়নি। যে মানুষটির কারণে আমরা আমাদের দেশটি পেয়েছি, সেই দেশের রেডিও টেলিভিশনে কোনো দিন তার নাম পর্যন্ত উচ্চারিত হয়নি।

আমার মনে আছে, প্রথমবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমি আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম,‌ ‘চলো আমরা একটা টেলিভিশন কিনে আনি, এখন নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুকে টেলিভিশনে দেখাবে!’ শুধুমাত্র তাকে দেখার জন্য আমরা একটা টেলিভিশন কিনে এনেছিলাম!

আমরা আমাদের চোখের সামনে বাংলাদেশকে জন্ম নিতে দেখেছি। আমরা এ দেশের ইতিহাসের সাক্ষী, ইতিহাসের অংশ। আমাদের চোখের সামনে বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। শৈশব-কৈশোরে তার সব কিছুর গুরুত্ব সব সময় বুঝতে পারিনি। এখন বড় হয়ে যখন পেছনে ফিরে তাকাই, তখন বিস্মিত হই, কখনো রোমাঞ্চিত হই, হতচকিত হয়ে যাই।

কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে একজন মানুষ হিসেবে অনুভব করার অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটেছে ২০১২ সালে, যখন তার নিজের হাতের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি হাতে পেয়েছি। আমি যখন নেলসন ম্যান্ডেলার আত্মজীবনী পড়ছিলাম, তখন আমার বারবার মনে হয়েছিল, বছরের হিসেবে আমাদের বঙ্গবন্ধু তো নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে খুব একটা কম সময় জেলে ছিলেন না, অবদান হিসেবে তার অবদানতো নেলসন ম্যান্ডেলার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তাহলে তিনি কেন তার মতো করে নিজের আত্মজীবনীটা লিখে ফেললেন না- আমরা কেন সেটি পড়ে রোমাঞ্চত হওয়ার সুযোগ পেলাম না। তাই শেষ পর্যন্ত যখন বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতের লেখা আবিষ্কৃত হল, সেটি প্রকাশিত হল, আমার আনন্দের সীমা ছিল না।

শিশু-কিশোররা যেভাবে রুদ্ধশ্বাসে ডিটেকটিভ বই পড়ে, আমি ঠিক সেভাবে রুদ্ধশ্বাসে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীটি পড়েছি। আমি মনে করি, এই বইটি আমাদের দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বই। যারা দেশকে ভালোবাসে, তাদের সবাইকে এই বইটি পড়তে হবে। যারা দেশের ইতিহাস জানতে চায়, তাদেরকে এই বই পড়তে হবে। যারা দেশ শাসন করে, তাদেরকে এই বই পড়তে হবে। যারা দেশ শাসন করতে চায়, তাদেরকেও এই বই পড়তে হবে। এই বইটি পড়লেই শুধুমাত্র একজন মানুষ বুঝতে পারবে কীভাবে একজন মানুষ একটি জাতি হয়ে ওঠে, একটি জাতি কীভাবে দেশ হয়ে ওঠে।

২.
বইটিতে অসংখ্য বিষয় আছে। যেমন ধরা যাক, বাঙালিদের কথা। তিনি বাঙালিদের কীভাবে দেখেছেন? বইয়ের অনেক জায়গায় তাদের কথা লেখা আছে। আমার পছন্দের একটা অংশ যখন তাদেরকে পাকিস্তানিদের সাথে তুলনা করেছেন (পৃষ্ঠা ২১৪): ‘প্রকৃতির সাথে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মত উড়ে বেড়ায়। আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন ঐ রকমই নরম, ঐ রকমই সবুজ। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, সৌন্দর্যই আমরা ভালবাসি’।

বাঙালির চরিত্রের নিখুঁত ব্যাখ্যাও করেছেন অন্য জায়গায় (পৃষ্ঠা ৪৭): ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল ‘আমরা মুসলমান, আর একটা হল আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোন ভাষাতেই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’ পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষাতেই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু  কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। নিজেকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না’।

বাঙালিদের নিয়ে এর চেয়ে খাটি মূল্যায়ন আমার চোখে আর কখনো পড়েনি।

এই বাঙালিদের জন্যে তার বুকে ছিল গভীর ভালোবাসা। নির্বাচনের সময় একবার হেঁটে হেঁটে প্রচারণার কাজ চালাচ্ছেন। তখন এক হতদরিদ্র বৃদ্ধা মহিলার সাথে দেখা। বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্যে কয়েক ঘণ্টা থেকে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে ধরে নিজের কুঁড়েঘরে এক বাটি দুধ, একটা পান আর চার আনা পয়সা দিয়েছে, বলেছে, ‘খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছু নেই’। বঙ্গবন্ধু সেই পয়সা না নিয়ে উল্টো তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন, লাভ হয়নি।

সেই হতদরিদ্র মহিলার বাড়ি থেকে বের হবার পর, বঙ্গবন্ধু লিখছেন (পৃষ্ঠা ২৫৬): ‘নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেইদিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, মানুষরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না’।

আমরা সবাই জানি, বঙ্গবন্ধু তার এই জীবনে প্রতিজ্ঞা কখনো ভঙ্গ করেননি।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এই পুরো বইটার একটা বড় অংশ হচ্ছে কীভাবে বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগের গুণ্ডা আর পুলিশের নির্যাতন সহ্য করেছেন, জেল খাটছেন। পাকিস্তানের জন্যে আন্দোলন করেছেন। কিন্তু দেশ বিভাজনের পরপরই খুবই দ্রুত মুসলিম লীগের ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছেন। আর এই মুসলিম লীগ সরকার তার ওপর নির্যাতন করছে, বিনা বিচারে দিনের পর দিন জেলখানায় আটকে রাখছে।

এক জায়গায় বর্ণনা আছে,  মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে শোভাযাত্রা করছেন তখন পুলিশ আক্রমণ করেছে। বঙ্গবন্ধু লিখছেন (পৃষ্ঠা ১৩২): ‘আমার উপরও অনেক আঘাত পড়ল। এক সময় প্রায় বেহুঁশ হয়ে এক পাশের নর্দমায় পড়ে গেলাম। আমার পা দিয়ে খুব রক্ত পড়ছিল। কেউ বলে গুলি লেগেছে, কেউ বলে গ্যাসের ডাইরেক্ট আঘাত, কেউ বলে কেটে গেছে পড়ে যেয়ে’। তারপর কীভাবে ধরাধরি করে পার্টির অফিসে নিয়ে যাওয়া হল তার বর্ণনা আছে। সেখানে একটু চিকিৎসা করে বেদনায় কষ্ট পাচ্ছিলেন বলে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হল। কিন্তু গভীর রাতে পুলিশ এলো তাদের গ্রেফতার করতে।

মাওলানা ভাসানী খবর দিয়েছিলেন যেন কোনোভাবে গ্রেফতার না হন। তাই লিখছেন, ‘আমার শরীরে ভীষন বেদনা, জ্বর ওঠেছে, নড়তে পারছি না। কি করি, তবুও উঠতে হল এবং কি করে ভাগব তাই ভাবছিলাম। তিন তলায় আমরা থাকি, পাশেই একটা দোতলা বাড়ি ছিল। তিন তলা থেকে দোতলায় লাফিয়ে পড়তে হবে। দুই দালানের ভিতর ফারাকও আছে। নিচে পড়লে শেষ হয়ে যাব। তবুও লাফ দিয়ে পড়লাম’।

আমরা হলিউডের ছবিতে এরকম দৃশ্য দেখে অবিশ্বাসের হাসি হেসে থাকি। কিন্তু এটা হলিউডের ছবি নয়; বঙ্গবন্ধুর নিজের জীবনের ঘটনা, নিজের হাতে লেখা।

একবার পাকিস্তান থেকে দিল্লি হয়ে বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলায় ফিরে আসছেন। তিনি জানেন তাকে গ্রেফতার করা হবে। তিনিও প্রস্তুত আছেন, তার ভাষায় (পৃষ্ঠা ১৪৫): ‘আমিও প্রস্তুত আছি। তবে ধরা পড়ার পূর্বে একবার বাবা-মা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়েদের সাথে দেখা করতে চাই। কারণ (পৃষ্ঠা ১৪৬), কয়েক মাস পূর্বে আমার বড় ছেলে কামালের জন্ম হয়েছে, ভাল করে দেখতেও পারি নাই ওকে। হাচিনা তো আমাকে পেলে ছাড়তেই চায় না’ (এই বইয়ে শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু সবসময় হাচিনা লিখেছেন)।

এরপর পুলিশের চোখে ধূলা দেওয়ার জন্যে ট্রেনে স্টেশনে কী করছেন তার চমকপ্রদ বর্ণনা আছে। সবচেয়ে বিচিত্র্য বর্ণনা হচ্ছে জাহাজে ওঠার অংশটুকু। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় (পৃষ্ঠা ১৪৬): ‘সকল যাত্রী নেমে যাওয়ার পরে আমার  পাঞ্জাবী খুলে বিছানার মধ্যে দিয়ে দিলাম। লুঙ্গি পরা ছিল, লুঙ্গিটা একটু উপরে উঠিয়ে বেধে নিলাম। বিছানাটা ঘাড়ে, আর সুটকেসটা হাতে নিয়ে নেমে পড়লাম। কুলিদের মত ছুটতে লাগলাম, জাহাজ ঘাটের দিকে। গোয়েন্দা বিভাগের লোক তো আছেই। চিনতে পারল না’।

বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার এড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বাড়ি পৌঁছাতে পেরেছিলেন, অল্প কিছুদিন স্ত্রী পুত্র কন্যার কন্যার সাথে কাটাতে পেরেছিলেন। যখন যাবার সময় হয়েছে তখন লিখছেন (পৃষ্ঠা ১৬৪): ‘ছেলেমেয়েদের জন্য যেন একটু বেশি মায়া হয়ে উঠেছিল। ওদের ছেড়ে যেতে মন চায় না, তবুও তো যেতে হবে। দেশ সেবায় নেমেছি, দয়া মায়া করে লাভ কি? দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে’।
বঙ্গবন্ধু যখন এই বাক্যটি লিখেছিলেন তখন কী তিনি জানতেন, তার জন্যে একদিন এটি কত বড় একটি সত্য হয়ে দাঁড়াবে?

জেলখানায় থাকতে থাকতে তার ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে একবার ছাড়া পেয়ে বাড়ি এসে সকাল বেলা বিছানায় বসে স্ত্রীর সাথে গল্প করছেন। তার ছেলে মেয়ে নিচে বসে খেলছে। বঙ্গবন্ধু লিখছেন (পৃষ্ঠা ২০৯): ‘হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’ ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। এক সময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি’। বঙ্গবন্ধু তখন বিছানা থেকে নেমে ছেলেকে কোলে নিয়ে বললেন, ‘আমি তো তোমারও আব্বা’। তার ছেলে তাকে চেনে না তাই কাছে আসতে চাইত না, এই প্রথমবার বাবার গলা ধরে পড়ে রইল।

লেখক-সাহিত্যিকেরা বানিয়ে বানিয়ে কতো কী লিখে পাঠকদের মন দুর্বল করে ফেলেন। কিন্তু এরকম সত্যি ঘটনা কী তারা লিখতে পারবেন?

ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু জেলে, দুই বছরের থেকে বেশি সময় বিনা বিচারে জেলে আটকা পড়ে আছেন, তখন ঠিক করলেন মুক্তির জন্য আমরন অনশন করবেন। খবর পেয়ে কর্তৃপক্ষ তাকে এবং তার রাজনৈতিক সহকর্মীকে ফরিদপুর জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে।

অনশন শুরু হওয়ার দুই দিনের ভেতর খুব শরীর খারাপ হলে তাদের হাপসপাতালে পাঠানো হলো। বঙ্গবন্ধুর নাকে ঘা হয়ে গেছে, রক্ত আসে, যন্ত্রণায় ছটফট করেন। যখন বুঝতে পারলেন আর বেশিদিন বাঁচবেন না, গোপনে কয়েক টুকরা কাগজ আনিয়ে তার বাবা, স্ত্রী এবং দুই রাজনৈতিক নেতা সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানীকে চিঠি লিখলেন। কারণ, তখন বুঝে গেছেন কয়েকদিন পর তার লেখার শক্তি থাকবে না।

বঙ্গবন্ধু অনশনে কিভাবে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। চিঠি চারটি ঠিকভাবে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছেন। লিখেছেন (পৃষ্ঠা ২০৪): ‘আমাদের অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পরেছে যে কোনো মূহুর্তে মৃত্যুর শান্তি ছায়ায় চিরদিনের জন্য স্থান পেতে পারি। সিভিল সার্জন সাহেব দিনের মধ্যে পাঁচ সাতবার আমাদের দেখতে আসেন। ২৫ তারিখ সকালে যখন আমাকে তিনি পরীক্ষা করছিলেন হঠাৎ দেখি তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেছে। তিনি কোনো কথা না বলে মুখ কালো করে বেরিয়ে গেলেন। আমি বুঝলাম, আমার দিন ফুরিয়ে গেছে। ...ডেপুটি জেলর সাহেব বললেন, ‘কাউকে খবর দিতে হবে কিনা? আপনার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী কোথায়? আপনার আব্বার কাছে কোন টেলিগ্রাফ করবেন’? বললাম, ‘দরকার নাই। আর তাদের কষ্ট দিতে চাই না। আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি, হাত পা অবশ হয়ে আসছিল’।

এভাবে আরো দুদিন কেটে গিয়েছে। বঙ্গবন্ধু লিখছেন (পৃষ্ঠা ২০৫): ‘২৭ তারিখ রাত আটটার সময় আমরা দুইজন চুপচাপ শুয়ে আছি। কারো সাথে কথা বলার ইচ্ছাও নাই, শক্তিও নাই। দুজনেই শুয়ে শুয়ে কয়েদির সাহায্যে ওজু করে খোদার কাছে মাপ চেয়ে নিয়েছি’।

বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর জন্য পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনশনে তাকে মৃত্যুবরণ করেতে হয়নি। তাদের এই জীবন বাজি ধরা আন্দোলনের কাছে সরকার মাথা নত করে তাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল।

পুরো বইটিতে অন্যরকম অসংখ্য ঘটনার বর্ণনা আছে। কীভাবে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তুলেছেন তার নিখুঁত বর্ণনা আছে। ষড়যন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, বাধাবিপত্তি, ভয়ঙ্কর অর্থকষ্ট, পুলিশের নির্যাতন, বিশ্বাসঘাতকতা সবকিছুকে সামাল দিয়ে কীভাবে একটা রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে হয়, সেটি এর চাইতে সুন্দর করে আর কোনো বইতে লেখা আছে বলে আমার জানা নাই।

মাঝে মাঝে যে হাস্যরস বা কৌতুক নেই তা নয়। রাতের বেলা নৌকা করে যাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধু ঘুমিয়ে আছেন তখন ডাকাত পড়েছে। এলাকার সবাই বঙ্গবন্ধুকে চেনেন, তাকে ভালোবাসে। ডাকাতরা যখন জানতে পারলো নৌকায় বঙ্গবন্ধু শুয়ে আছেন, তখন ডাকাতি না করেই মাঝিকে এক ঘাঁ দিয়ে বললো, ‘শালা আগে বলতে পারো নাই, শেখ সাহেব নৌকায়’।
ঘুম থেকে ওয়ে বঙ্গবন্ধু ঘটনা শুনে বললেন, (পৃষ্ঠা ১২৫): ‘বোধহয় ডাকাতরা আমাকে ওদের দলের একজন বলে ধরে নিয়েছে’।

আরেকবার জনসভায় মওলানা ভাসানীকে নিয়ে বক্তৃতা করতে গিয়েছেন, পুলিশ তখন ১৪৪ ধারা জারি করে দিয়েছে, কেউ আর বক্তৃতা করতে পারবে না। বঙ্গবন্ধু তেজস্বী মানুষ, বললেন (পৃষ্ঠা ১২৮): ‘মানি না ১৪৪ ধারা, আমি বক্তৃতা করবো’। মাওলানা সাহেব দাঁড়িয়ে বললেন, ‘১৪৪ ধারা জারি হয়েছে আমাদের সভা করতে দেবে না।   আমি বক্তৃতা করতে চাই না। তবে আসুন আপনারা মোনাজাত করুন, আল্লাহ আমিন’। মাওলানা সাহেব মোনাজাত শুরু করলেন। মাইক্রোফোন সামনেই আছে। আধ ঘণ্টা চিৎকার করে মোনাজাত করলেন, কিছুই বাকি রাখলেন না, যা বলার সবই বলে ফেললেন। পুলিশ অফিসার সেপাইরা হাত তুলে মোনাজাত করতে লাগলেন। আধা ঘণ্টা মোনাজাত পুরো বক্তৃতা করে মাওলানা সাহেব সভা শেষ করলেন। পুলিশ ও মুসলিম লীগ ওয়ালারা বেয়াকুফ হয়ে গেলো! পুরো দৃশ্যটা কল্পনা করে এতোদিন পরে আমরা হেসে কুটি কুটি হই।

৩.
এই অসাধারণ বইটি সম্পর্কে লিখে শেষ করার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও আমি বই থেকে নানা বিষয় বঙ্গবন্ধুর কিছু কথা তুলে দেই। যেহেতু তিনি আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ, তাই তার রাজনীতি নিয়ে কথাগুলো সবচেয়ে সুন্দর। রাজনীতি কখনো দলবাজি হিসেবে দেখেননি। লিখেছেন, (পৃষ্ঠা ২৩৯): ‘ম্যানিফোস্টা বা ঘোষণাপত্র না থাকলে কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। আমলাতন্ত্র দুই চোখে দেখতে পারতেন না’।

আবার একই সাথে অযোগ্য রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে এভাবে সতর্ক করেছেন, (পৃষ্ঠা ২৭৩): অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই’। বামপন্থি রাজনীতি সম্পর্কে বলেছেন, (পৃষ্ঠা ২৩৪): ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই।   তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না’।

আমাদের দেশে বামপন্থী রাজনীতি কেন কখনো বেশি সুবিধা করতে পারেনি, বঙ্গবন্ধু সেটি অর্ধশত বছরের আগে বিশ্লেষণ করেছে। তার বামপন্থী বন্ধুদের উল্লেখ করে বলেছেন, (পৃষ্ঠা ১০৯): ‘জনসাধারণ চলছে পায়ে হেঁটে, আর আপনারা আদর্শ নিয়ে উড়োজাহাজে চলছেন। জনসাধারণ আপনাদের কথা বুঝতেও পারবে না, আর সাথেও চলবে না। যতটুকু হজম করতে পারে ততটুকু জনসাধারণের কাছে পেশ করা উচিৎ’।
 
অতি প্রগতিবাদীদের সম্পর্কেও তার কথাটা তখনো সত্যি ছিলো এখনো সত্যি, (পৃষ্ঠা ২৪৫): ‘অতি প্রগতিবাদীদের কথা আলাদা। তারা মুখে  চায় ঐক্য। কিন্তু দেশের জাতীয় নেতাদের জনগণের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করতে এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি যাতে জণগণের আস্থা হারিয়ে ফেলে , চেষ্টা করে সেজন্যে!’

তবে বঙ্গবন্ধুর কাছে রাজনীতির বিষয়টি ছিল খুবই স্পষ্ট এবং সেটি ছিল খুবই মহৎ কাজ। বার বার বলেছেন, (পৃষ্ঠা ১২৮) ‘যেকোনো মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা জীবনে ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়, তারা জীবনে কোনো ভাল কাজ করতে পারে নাই’। রাজনীতি করে তার জীবনে এক প্রকার পূর্ণতা এসেছিল। কারণ, নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পুরোপুরি ধরাশায়ী করে লিখেছেন, (পৃষ্ঠা ২৫৭): ‘আমার ধারণা হয়েছিল, মানুষকে ভালবাসলে মানুষও ভালবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে’।

বঙ্গবন্ধু মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলেন। একবার নয়, বার বার।

৪.
এই লেখার শুরুতে আমি বলেছিলাম, ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি সবার পড়া উচিৎ- যারা দেশ চালাচ্ছে তাদেরও। আমার কেন জানি মনে হয়, যারা দেশ চালাচ্ছ্নে, তাদের সবাই এই বইটি পড়েননি- কিংবা তার চাইতেও দুঃখের বিষয় হয়তো বইটি পড়েছেন কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো বিশ্বাস করেননি।

আমার এ রকম মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে, এই বইয়ে সবচেয়ে বেশি যে কথাটি লেখা হয়েছে সেটি হচ্ছে (পৃষ্ঠা ১২৬): ‘শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না’ কিংবা (পৃষ্ঠা ১২০): ‘বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কতন্ত্র চলবে’।

শক্তিশালী বিরোধী দল দূরে থাকুক আমরা কী এই দেশে কোনো বিরোধী দল দেখতে পাচ্ছি?  দেশে আসলে কোনো বিরোধী দল নেই, একটা গৃহপালিত বিরোধী দল আছে। তাদের থাকা না থাকায় কিছু আসে যায় না।

জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে রাজনীতি করে এবং বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করে বলে আমি মনে করি, এই দেশে বিএনপির রাজনীতি করার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। এখন বাকি আছে সংবাদ মাধ্যম। যতোই দিন যাচ্ছে আমার দেখছি সংবাদ মাধ্যমগুলোকে কেমন জানি গলাটিপে ধরা হচ্ছে। মন্ত্রীরা কারণে-অকারণে আজকাল সাংবাদিকদের গালাগাল করেন, ভয়-ভীতি দেখান। গণজাগরণ মঞ্চ যখন আওয়ামী লীগের সমালোচনা করল, তখন তাদেরকেও দুই টুকরো করে দেওয়া হলো। পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বলে আমি যখন চেচামেচি করছিলাম, তখন আমাকে নানাভাবে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, আমি যেন সরকারকে বিপদে না ফেলি।

বঙ্গবন্ধু বার বার বলেছেন, সরকারকে ঠিক রাখতে হলে একটা শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার। আমি এই দেশে তাই একটা বিরোধী দল খুঁজে বেড়াই। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের একটা বিরোধী দল।

সেটি কোথায়?

বাংলাদেশ সময়: ০০১৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।