ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

চন্দনের বন্ধনে . . .

পলাশ মাহবুব | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১৪
চন্দনের বন্ধনে . . . ওবায়দুল গণি চন্দন

ঢাকা: সম্পর্ক ১৫ বছরের। আমি যখন লেখালেখির ‘ডিম’ তিনি তখন ডিম পাড়া মুরগি।

মুগ্ধ হয়ে তার অসাধারণ সব ছড়া পড়তাম। খ্যাতিমান ছড়াকার ওবায়দুল গণি চন্দনের সাথে প্রথম পরিচয়ের কথা এখনও মনে করতে পারি।

২০০০ সালের শুরুর দিকে। তখন খুলনা থেকে লেখালেখি করি। চন্দন ভাই তখন মাসিক কিশোর তারকালোক পত্রিকার সহকারী সম্পাদক। ইমদাদুল হক মিলন সম্পাদক।   ঢাকা এসে খুঁজতে খুঁজতে গেলাম কিশোর তারকালোক অফিসে।

আমাকে দেখেই বললেন, পলাশ মাহবুব। ‘খালিশপুর, খুলনা?’

আমি মাথা নাড়ি। মুখ দিয়ে কথা বের হয় না। মফস্বলের এক পুঁচকে খুচরা লেখকের কাছে ওবায়দুল গণি চন্দন মানে বিশাল ব্যাপার।

‘তুমি দুইটা লেখা পাঠাইছিলা। মনে আছে। একটা নেক্সট সংখ্যায় যাবে। আরেকটা ঈদসংখ্যায় দিব। যাও এবার দৌড়ের ওপর থাকো। ’

সেই থেকে দৌড় শুরু। এরপর পত্রিকার পাতায় কত শত লেখা ওবায়দুল গণি চন্দনের পাশে ছাপা হয়েছে হিসাব নেই। কত কত দিন আড্ডায় কেটেছে সেটাও হিসাবহীন। বড় ভাই হয়েও তিনি ছিলেন বন্ধুর মতো। চন্দন ভাইয়ের সাথে সবকিছু শেয়ার করা যেত। করা যেত তর্ক এমনকি ঝগড়াও।

একসময় প্রচুর ছড়া লিখতেন তিনি। পত্রিকার ফান ম্যাগাজিন আর ছোটদের পাতা মানেই ওবায়দুল গণি চন্দন। সে সময় তিনি নিয়মিত পড়তেন মোবাইল প্যান্ট। কারণ মোবাইল প্যান্টে লেখা রাখতে সুবিধা। একেক পকেটে একেক পত্রিকার লেখা থাকতো। ডানে ইত্তেফাক, বামে মানবজমিন, পেছনে আজকের কাগজ, হাঁটুর কাছে ভোরের কাগজ। এভাবে একেক পকেটে একেক পত্রিকার লেখা নিয়ে সকালে বের হতেন। বাসায় ফিরতেন রাতে।

কোথায় লেখেননি তিনি? পত্রিকা-ম্যাগাজিন তো আছেই। ক্যালেন্ডারে তার ছড়া ছিল। ডায়েরিতে ছিল তার ছড়া। টেলিফোন ইনডেক্স এমনকি ভিউকার্ড, পোস্টারও হয়েছে ওবায়দুল গণি চন্দনের ছড়া দিয়ে।

বিটিভি’র এক সময়ের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান শুভেচ্ছার প্রতি পর্বে প্রচারিত হত তার লেখা দর্শকনন্দিত ছড়া ‘আক্কেল আলী’। দু’বার পেয়েছেন ‘অগ্রণী ব্যাংক-শিশু সাহিত্য পুরস্কার’। ছড়া লিখে তারকা হওয়া সর্বশেষ নাম ওবায়দুল গণি চন্দন।

সাধারণত যারা ভালো লেখে তারা ভালো বক্তা হয় না। চন্দন ভাই ছিলেন ব্যতিক্রম। জানতেনও প্রচুর। আড্ডায় তার উপস্থিতি মানেই অন্য সবাই শ্রোতা। আড্ডাকে নিয়ে গিয়েছিলেন শিল্পের পর্যায়ে।

লেখালেখির সম্পর্কের বাইরে চন্দন ভাইকে সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলাম বৈশাখী টেলিভিশনে। দীর্ঘ সময় কাছাকাছি থেকে মেশার সুযোগ হয়েছে তখন। তখন আড্ডা হতো প্রতিদিন। টেলিভিশনের চাকরি লেখকদের জন্য বিপর্যয়কর। লেখালেখি বিনাশ করে। তার প্রভাব চন্দন ভাইয়ের ওপরও পড়েছিল।

একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘চন্দন ভাই, ফর্ম কি পড়ে গেল নাকি? লেখাটেখা খুব একটা দেখি না। ’
‘আরে মিয়া, লেখালেখিরে হরলিকসের ডিব্বা পাইছো নাকি যে এমনি এমনি খাইলাম। এখন আর আমি এমনি এমনি লেখি না। আর লিখলেও পত্রিকায় দেই না। নিজের লেখা নিজে পড়ি। নিজের তৃপ্তির জন্য লেখি। ’

সূক্ষ্ম অভিমানের বিষয়টি টের পাই। তবে ওইটুকুই। নিজের অভিমান খুব বেশি প্রকাশ করতে পারতেন না। শেষদিকে অবশ্য ফেসবুকে তার কিছু অভিমানী স্ট্যাটাস আমাদের চোখে পড়েছে। হয়তো সময় শেষ বলেই কিনা!

২.

শিশুর মতো চঞ্চল চন্দন ভাই সবসময়ই দুষ্টামির মধ্যে থাকতেন। আমাকে দেখলেই ক্ষেপাতেন- ‘পকেটে হাত দিয়া ঘুরো ক্যা? পকেটে হাত দিয়া হাঁটলেই স্মার্ট হওয়া যায় না। দেখি একটানে কও তো- ম্যাচাচুসেটস। ’ একটান দূরে থাক পুরোটা উচ্চারণ করতেই আটকে যেতাম।
 
‘শোনো, সকাল-বিকাল পিস কইরা লেবু কাইটা জিহ্বায় ডলবা। জিহ্বার ফ্যাট কমবো। তোমার জিহ্বায় জড়তা আছে। ’ 

এসব তিনি ফাজলামো করেই বলতেন। আসলে হাসি-ফাজলামির মাধ্যমে নিজের জীবনের জড়তা ঢেকে রাখতে চাইতেন।

কিন্তু, সবকিছু কি ঢেকে রাখা যায় চন্দন ভাই? এই যে, সাদা কাপড়ে আপনাকে ঢেকে দিল সবাই। তারপর একে একে তারওপরে পড়লো নানা রঙের ফুল। কিন্তু তারপরও আমি তো আপনাকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। মনে হয় এখনি স্বভাবসুলভ বাঁকা হাসিতে বলে উঠবেন, ‘পকেট থিকা হাত নামাও মিয়া . . .

পলাশ মাহবুব : সাহিত্যিক ও নাট্যকার। প্রোগ্রাম ম্যানেজার, বৈশাখী টেলিভিশন।

বাংলাদেশ সময়: ২২১৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৬, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।