ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

২১ আগস্ট ও বধিরতা চিকিৎসা

মুহম্মদ সবুর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৪
২১ আগস্ট ও বধিরতা চিকিৎসা ছবি: সংগৃহীত

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নির্মম ট্র্যাজেডির পর বাঙালি জাতির জীবনে দ্বিতীয় ট্র্যাজেডি ঘটে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামীলীগের সমাবেশে জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ জাতীয় নেতাদের হত্যার জন্য ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়।

হামলায় বহু মানুষ হতাহত হোন। বিকট শব্দে অনেকে বধির হয়ে পড়েছিলেন; ‘হঠাৎ বধিরতা’ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। শ্রবণেন্দ্রিয় হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলে, বিভীষিকা এসে তড়পায়। প্রকৃতির হাসি গান উল্লাস সবকিছু যেন স্তব্ধতার আড়ালে নিবিড় নিঃসম হয়ে যায়। বধিরতার অন্তরালে না শোনা জীবনের কতো করুণ ক্রন্দন মথিত হতে থাকে।

বিশিষ্ট দার্শনিক এবং ঔপন্যাসিক জাঁ জ্যাক রুশোর জীবনে বড় ট্রাজেডি ছিল তার বধিরত্ব। ১৭৭৩ সালে নিজের বধিরত্ব সম্পর্কে উপলব্ধি তুলে ধরেন— ‌‍‍‍‍ ‘‌শৈশব  থেকেই আমার শরীর দুর্বল আমি জানি। তবু চোখ এবং কান তো ছিল। দু’চোখ দিয়ে পৃথিবীকে দেখেছি। পৃথিবীর সুরূপ এবং কুরূপ। কান দিয়ে শুনেছি পৃথিবীর সঙ্গীত এবং যন্ত্রণা। কিন্তু কি যে হল! হঠাৎ আমার শ্রবণেন্দ্রিয় হয়ে গেল বিকল। হঠাৎই। আমি বধির হয়ে গেলাম। মনে হল আমি শব্দহীন জগতের এক মানুষ। ’

এই বধিরত্ব থেকে রুশো তার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নিষ্কৃতি পাননি। শ্রবণেন্দ্রিয় কিছুটা সচল হয়ে উঠলেও সেটা বধিরত্বেরই সামিল ছিল। অনেক কষ্টে যেটুকুওবা তিনি শুনতে পেতেন তা খুবই অস্পষ্ট। অনুরূপ দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছিলেন অস্ট্রিয়ার বিশিষ্ট লেখক পিটার রোজেগের। একদিন ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে তিনি আবিষ্কার করলেন কানে তালা। শব্দ শোনার ক্ষমতা; বলতে গেলে, প্রায় পুরোপুরিই খুইয়ে বসে আছেন। বেশ বড়সড় একটি লোহার গোলক মেঝেতে আছড়ে ফেলা হলো । বিকট শব্দে আশপাশের সবাই হকচকিয়ে গেলো। সেই শব্দ পিটারও শুনেছেন। কিন্তু তার কাছে মনে হয়েছিল, পুরু কার্পেটের উপর কারো ভারি পদক্ষেপে হেঁটে যাবার শব্দের মতো। অবশ্য কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনি শ্রবণ ক্ষমতা ফিরে পান। তবে আগে যেমনটি শুনতে পেতেন, তেমন ক্ষমতা আর কোনওদিন ফিরে পাননি। আশ্চর্য যে, রুশো এবং পিটারের এই বধির হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি ঘটেছিল খুবই তাৎক্ষণিক। প্রদীপের আলোয় তেল কমে এলে যেমন ধীরে ধীরে নিভে যায়, তেমনটি নয়। এ যেন সুঁইচ অফ করে একটি বৈদ্যুতিক বাল্ব হঠাৎ নিভিয়ে দেওয়ার মত। আরো আশ্চর্যজনক যে, হঠাৎ এই বধির হয়ে যাওয়ার ঘটনার কথা জানা সত্বেও ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এ নিয়ে তেমন কোনো গবেষণাও করেননি।

একুশ শতকের গোড়ায় কানাডার টরন্টো শহরে কর্ণবিষয়ক চিকিৎসা সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করেছিল কানাডা স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের জেনারেল মেডিক্যাল কাউন্সিল। সহযোগিতায় ছিল ইতালি, জার্মান, অস্ট্রিয়া ও মার্কিন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এখানেই হঠাৎ বধির হয়ে যাওয়ার সমস্যাটি তুলে ধরেছিলেন কানাডীয়ান কর্ণবিশেষজ্ঞ  জেরড জেকনার। এই কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শ্রোতা হিসেবে আমার আমন্ত্রিত হবার সুযোগ ঘটে অটোয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে কর্মরত থাকার সুবাদে।

জেকনার তার ভাষ্যে উল্লেখ করেছিলেন, ১৯৫৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে পাঁচ হাজারের বেশি হঠাৎ বধির রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। এরা নথিভুক্ত রোগী, তবে বাস্তব হচ্ছে, এদের বাইরেও রয়েছে আরো অনেক রোগী। যারা চিকিৎসক পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। তেমন রোগীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। যারা নাক, কান, গলার চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞদের কাছে যান, তাদের মধ্যে তিন থেকে চারজনই হঠাৎ বধির হয়ে যাওয়া রোগের শিকার। উন্নত দেশে এধরনের রোগীর সংখ্যা আগের চেয়েও অনেক বেড়েছে। তুলনায় বিকাশশীল দেশগুলোতে এ রোগ এখানো পর্যন্ত প্রায় অজ্ঞাতই বলা চলে। চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা সেমিনারে স্পষ্ট করলেন, আধুনিক জীবনযাত্রাই এ রোগের অন্যতম কারণ। যেমন দেখা যায় হৃদরোগের ক্ষেত্রে। জেরড জেকনার যেমন উল্লেখ করেছেন— সত্যিই যেন ব্যাপারটা সেই রকমই। হার্ট অ্যাটাকেরই মত। কানের হার্ট অ্যাটাক। ’ তার মতে, ‌তুলনাটা অমূলক নয়। হৃদরোগীদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাইরে থেকে স্বাস্থ্য দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। হঠাৎ ঘটল ‘হার্ট এ্যাটাক। ’ এবং বেশির ভাগ সময় তা ঘটে জীবনের মাঝামাঝি সময়ে, পূর্ণতায় জীবন যখন উচ্ছল, মনের ভাবটা-আমি না হলে এই পৃথিবীটা বুঝি অচল। হঠাৎ বধিরত্বের ঘটনাটা ঠিক এই রকমই। আগাম বোঝার কিছু জো থাকে না। শ্রবণ ক্ষমতা খুবই স্বাভাবিক। অকস্মাৎ মুহূর্তে বধিরতা। ”

কর্ণবিষয়ক সেমিনার ও কর্মশালায় অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার প্রতিনিধিরা থাকলেও এশিয়া, আফ্রিকার অনুপস্থিতির উল্লেখ করে জানানো হয় যে, ওই দুটি মহাদেশে হঠাৎ বধির হয়ে যাওয়ার সংখ্যাও বাড়ছে। সেখানেও এই রোগের চিকিৎসার প্রাথমিক সুযোগ সুবিধা তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানালেন, মানসিক ভারসম্যতা বজায় রাখার ব্যাপারটা দৈহিক স্বাস্থ্যের উপরও নির্ভর করে। হয়তো কোনো কারণে শারীরবৃত্তীয় ঘটনাবলী অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। যা স্বাস্থ্যের পক্ষে প্রতিকূল। এ ধরনের ঘটনাও হঠাৎ বধিরতার কারণ হতে পারে। অনেকে এমন পরিবেশে কাজ করে, যেখানকার তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। অতিরিক্ত তাপমাত্রা তার শারীরবৃত্তের পক্ষে ক্ষতিকর হলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, অতিরিক্ত ঠান্ডাও অন্যতম কারণ হওয়া সম্ভব। অনেক সময় বিশেষ বিশেষ ভাইরাসের আক্রমণও এই রোগের অন্যতম কারণ হতে পারে। স্পাইনাল কর্ড বা সুষুন্মাকান্ডের গোলাযোগেও হওয়া সম্ভব। এধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে ‘ইনার ইয়ার’ বা অন্তঃকর্ণে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। কানের স্নায়ুতন্ত্র তখন ঠিক মত কাজ করতে পারে না। ফলে শ্রবণক্ষমতা হ্রাস পায়। অনেক সময় পুরোপুরি বধির হয়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। মস্তিস্কে হঠাৎ রক্ত চলাচল বন্ধ হলে যেমন ‘স্ট্রোক’ হয়, এক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেই রকম। সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ ধমনীর মধ্য দিয়ে রক্ত এবং অক্সিজেন সরবরাহ হয় অন্তঃকর্ণে। অক্সিজেনের  সামান্য ঘাটতি হলেই অন্তঃকর্ণ শ্রবণের অনুভূতি হারিয়ে ফেলে। একজন বিশেষজ্ঞ, ইতালির, বলেই ফেললেন, এটি একটি মতবাদ। তবে কিভাবে রক্তসংবহন হতে পারে সে সম্পর্কে কোনো সঠিক তথ্য তখনো পর্যন্ত অবশ্য বিশেষজ্ঞরা জেনে উঠতে পারেননি।

বাংলাদেশেও হঠাৎ বধিরতার সংখ্যা বাড়ছে। অবশ্য বাংলাদেশে হঠাৎ বধিরতা সম্পর্কে সচেতনতা কম। শব্দ দূষণ ‘কানে তালা লাগিয়ে’ দেয় এদেশে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বোমা, গ্রেনেড, কামানের শব্দও অনেককে বধির করেছে। এছাড়া ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও জননেত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলায় বিকট শব্দও বধিরতার জন্ম দিয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় প্রাণে বেঁচে গেলেও ‘হঠাৎ বধিরতা’য় আক্রান্ত হয়েছিলেন। দেশে বিদেশে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। বাংলাদেশে এ ব্যাপারে সুচিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্যোগ নেন। তিনি জানেন, এই ইন্দ্রিয়হীনতা মানুষের স্বাভাবিকতার বিঘ্ন ঘটায়, তাই এর নিরসনে জননেত্রীর সক্রিয়তা উল্লেখ করার মতোই।



লেখক : মুহম্মদ সবুর, কবি, কথাসাহিত্যিক



বাংলাদেশ সময়: ১২৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ২১,২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।