ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর জলবায়ু ঋণ ।। আমিনুল হক

জলবায়ু/মুক্তমত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৪
কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর জলবায়ু ঋণ ।। আমিনুল হক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

২৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের উদ্যোগে জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন শুরু হয়েছে। বাংরাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেখানে যোগ দিয়েছেন।

প্রতি বছর জলবায়ু বিষয়ক যে বৈশ্বিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, এই সম্মেলন তার থেকে অনেকটাই আলাদা এবং বিশেষ অর্থ বহন করে। কারণ জাতিসংঘ মহাসচিব বান-কি-মুন নিজ উদ্যোগে এই সম্মেলনের আয়োজন করেছেন এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে বিশেষ করে সকল দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, গবেষক ও উন্নয়ন পরিকল্পনাবিদ এবং সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিকে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি আশা প্রকাশ করছেন, এই সম্মেলন থেকেই বিশ্বের সরকার প্রধান ও বেসরকারি নেতৃবৃন্দ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাস্তবভিত্তিক কৌশল ও কর্মসূচির পাশাপাশি সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিসমূহ ঘোষণা করবেন এবং তার কার্যকর বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই আগামীতে পরিবেশ এবং উন্নয়ন উভয় বিবেচনায় একটি নিরাপদ ও টেকসই বিশ্ব নিশ্চিত হবে।

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনে কী বক্তব্য দিবেন তার খসড়া প্রস্তুত করার দায়িত্ব থাকে বিশেষ করে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উপর। বিগত দিনে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সরকারি কর্মকর্তা, জলবায়ু গবেষক ও দেশের নাগরিক সমাজের মধ্যে প্রতক্ষ্য বা পরোক্ষ সমন্বয় সাধনের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে এবং যার ফলশ্রুতিতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে জনগণের চাহিদাই প্রতিফলিত হয়েছে এবং জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে এদেশের জনগণের চাহিদা ও ন্যায্য দাবি বিশ্বের সামনে উত্থাপতি হয়েছে।

তবে আমরা বিশ্বাস করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা আছে এবং তিনি অতীতের মতই নাগরিক সমাজের মতামত ও জনগণের চাহিদার প্রতি দৃষ্টি দিবেন এবং বাংলাদেশের জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবি তুলে ধরতে ও ভবিষ্যতে তা আদায়ে সচেষ্ট হবেন।

গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন
ঐতিহাসিকভাবে ধনী দেশগুলোর ক্রমাগত গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ। ধনী দেশগুলো বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে স্বল্পোন্নত ও দরিদ্র দেশগুলো (উপনিবেশ) থেকে বিবেচনাহীনভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করেছে এবং সে সম্পদ ব্যবহার করে নিজেদের দেশে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। ব্যাপক শিল্পায়নের মাধ্যমে তারা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে আসছে, যার কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। অথচ আমরা দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশ কার্বন নিঃসরণের কোনও প্রকার দায় না থাকা সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি এবং ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত হবার হুমকি জারি আছে। এই ক্ষতি মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশের মত স্বল্পোন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোর কোনও প্রকার আর্থিক ও কাঠামোগত সক্ষমতা নাই বলে আমরা মনে করি। ধনী দেশগুলোকে এই ঐতিহাসিক দায় স্বীকার করে নিতে হবে এবং গ্যাস নিঃসরণ কমানোর কার্যকর প্রতিশ্রুতি তাদেরকেই দিতে হবে।

গ্রিনহাউস গ্যাস হ্রাস
IPCC (Intergovernmental Panel on Climate Change) এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে যে হারে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হচ্ছে তার কারণে অদূর ভবিষ্যতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাবে। গ্রিনহাউস গ্যাস হ্রাসের জন্য ধনী দেশগুলো ২০০৫ সালে কিয়োটো প্রটোকল স্বাক্ষর করেছিল এবং এই চুক্তির মেয়াদ ২০১২ সালে শেষ হলেও কেউই তা অনুসরণ করেনি। বরং এ ব্যাপারে নতুন আইনি কাঠামো প্রণয়নে তারা বিগত জলবায়ু সম্মেলনগুলোতে বিভিন্ন অজুহাত এবং বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি করেছে। তাদের নেতিবাচক ভূমিকার কারণেই এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে। ফলে, দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো আরও বিপদাপন্ন হচ্ছে। এ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করা এবং ধনী দেশগুলোকেই তা করতে হবে। এবং এটা কার্যকর করতে হলে গ্রিনহাউস গ্যাস হ্রাসের বাধ্যবাধকতামূলক আইনি কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে এবং ২০১৫ সালের প্যারিস সম্মেলনেই তা হতে হবে বলে আমরা মনে করি।

জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সর্বাধিক ঝুঁকির সম্মূখীন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ক্যারোলিন সুলিভান, যুক্তরাজ্যের ম্যাপলক্রফট এবং জার্মানওয়াচ-এর জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে বাংলাদেশকে বর্তমান ও আগামী ৩০ বছরের জন্য সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিশেবে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতিসঙ্ঘ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক কর্মকাঠামো সনদ (UNFCCC) অনুসারেও বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম। বাংলাদেশের ঝুঁকিগুলোর মধ্যে রয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্র উপকূল তলিয়ে যাওয়া—পাশাপাশি নদী ও উপকূলীয় ভাঙন, ক্রমবর্ধমান ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস, দীর্ঘমেয়াদি বন্যা, অতিরিক্ত লবণাক্ততা, খরা ও জলাবদ্ধতা। এসব কারণে সারাদেশে প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুতিতে বাধ্য হয়। এর বাইরেও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ভবিষ্যতে দেশের উপকূলের প্রায় ১৭ শতাংশ এলাকা নিমজ্জিত হয়ে তিন থেকে চার কোটি মানুষ স্থানান্তরে বাধ্য হতে পারে। IPCC’র সর্বশেষ প্রতিবেদনেও এ আশংকা করা হয়েছে।

বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমাবদ্ধতার কারণে এ বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে ভবিষ্যতে দেশের অন্য কোথাও পুনর্বাসন করা সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করি না।

সবুজ জলবায়ু তহবিল
২০১০ সালে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বৈশ্বিক সম্মেলনে (কপ-১৬) সকল দেশের অংশগ্রহণ ও সম্মতিতে সবুজ জলবায়ু তহবিল (GCF- Green Climate Fund)  নামে একটি আন্তর্জাতিক তহবিল গঠন করা হয়। ধনী দেশগুলোর পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, তারা এই তহবিলে অর্থ প্রদান করবে এবং জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো অভিযোজন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার জন্য এখান থেকে আর্থিক সহযোগিতা পাবে।

কিন্তু ধনী দেশগুলো স্বল্পোন্নত দরিদ্র দেশগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতার কথা স্বীকার করলেও অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রচণ্ড উদাসিনতা দেখাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কর্মসূচিতে দ্রুত অর্থায়নের জন্য ধনী দেশগুলো ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ৩০ বিলিয়ন ডলার এবং দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়ন হিসেবে ২০১২ সালের পর প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার করে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ২০১২ সাল পার হয়ে গেলেও GCF-G এখন পর্যন্ত কোন অর্থ তারা প্রদান করেনি।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি পূরণ
এটা সত্য যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা, তীব্রতা এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী ঘুর্ণিঝড় সিডরের কারণে আমাদের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার। পরবর্তীতে ২০০৯ সালেও ঘুর্ণিঝড় আইলা ও তার সঙ্গে আসা জলোচ্ছ্বাসের কারণে আমাদের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে যা আজও সরকারের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব হয়নি। তাই আমাদের দাবি হচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ইতিমধ্যেই সংঘটিত দুর্যোগের কারণে যে সকল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবার সম্ভাবনা রয়েছে তা মোকাবেলার জন্য সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বিশেষ করে বাংলাদেশকে ক্ষয়ক্ষতি (Loss & Damage) নীতিমালার আওতায় অভিযোজন কর্মসূচির বাইরেও অতিরিক্ত অর্থ ও কারিগরী সহযোগিতা দিতে হবে। এক্ষেত্রে বীমা কর্মসূচির নামে জলবায়ু আক্রান্ত দেশগুলো থেকে কোনো সম্পদ বা অর্থ স্থানান্তর করা যাবে না।

লেখক: সচিবালয় সমন্বয়কারী, ইক্যুইটি এন্ড জাস্টিস ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশ (ইক্যুইটি বিডি)

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।