ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

মালালাকে নিয়ে শেয়াল পণ্ডিতদের উ-লা-লা

জাহিদ নেওয়াজ খান, কনট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৪
মালালাকে নিয়ে শেয়াল পণ্ডিতদের উ-লা-লা

অবস্থা যা তাতে মনে হচ্ছে, আমাদের সবারই শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত। আমাদের ভাবটা এরকম যে, মনোনয়ন তালিকায় আমাদের সবারই নাম ছিলো, সেখানে কোত্থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে ‘দ্যা প্রাইজ ওয়েন্ট টু পুঁচকে মালালা ইউসুফজাই’।



সত্যিই তো। মালালাটা কে হে? ওইরকম কাজ আমরা সবাই কতোই না করেছি। এখন না হয় পত্নী সেবা আর শ্যালিকার বায়না মেটাতে সময় পাই না, কিন্তু ছোটবেলায় আমরা সকলেই তো সমাজসেবায় একেকজন বীর বাহাদুর ছিলাম। কই! তার স্বীকৃতি তো নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি দিলো না।

এই আমার কথাই ধরুন না। আজ থেকে ৩৫ বছর আগে, আমার বয়স যখন মাত্র ১০। কী অসাধ্যই না সাধন করেছিলাম। তখন খাল-টাল কেটে, বাড়ির পুকুর পর্যন্ত কুমির এনে গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার এক মহান উতসব শেষে আমরা ছোটরাও মেতেছিলাম এক ভোট উতসবে। ১৯৭৯ সালের ওই নির্বাচনের পর আমার মামাবাড়িতে আমরা একটা নির্বাচনের আয়োজন করি যাতে ভোটার ছিলো শুধু ছোটরা। ‘মামাবাড়ির আবদার’ বলে যে কথা সেটা মেটাতে মামার বড় ছেলেরা ওই ভোটের আয়োজন করেন। গোপনে বলে রাখি, প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা যে মামাত ভাই; তারও একজন প্রার্থী ছিলো, ‘নৌকা’ মার্কা। ‘ধানের শীষে’ও ছিলো একজন। কিন্তু আমরা ইঁচড়ে পাকারা ‘মাছ’ মার্কার প্রার্থীকে ভোট দিয়ে জিতিয়ে দেই।

এর পরের কয়েকদিন ওই ‘এমপি’র নেতৃত্বে গ্রামের সব ভাঙ্গা রাস্তাঘাট ঠিক করে ফেলি। বড় কিছুর জন্য ছোট কিছুর যে ত্যাগ করতে হয়, সেই মহান বাণীকে বুকে ধারণ করে কয়েকজনের ধানক্ষেতে সেচের পথটাও বন্ধ করে দেই। এ নিয়ে একটু ঝাড়ি-ঝাপটা আর দৌড়ানি খেলে কী হয়েছে! লংমার্চের মতো বিপ্লবী না হলেও, অন্তত: গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রোইকার মতো মহান সংস্কারের যে কাজটি আমরা সেদিন করেছিলাম, সেই খবর নোবেল কমিটি পায় নি। পেলে মালালা তো ১৭ বছরে নোবেল পেয়েছে, আমরা তার চেয়েও কম বয়সেই নোবেল পেয়ে যেতাম। আর সেটা হতো আমি এবং অন্যদের যৌথ প্রাপ্তি।

নিজের ঢোল নিজেকে পেটাতে হয় না, তা না হলে আজ আপনাদের বলতাম, ওই নির্বাচন আয়োজনের আইডিয়া, ‘মাছ’ মার্কার প্রার্থী সিলেকশন এবং সংস্কার কর্মসূচি; সবকিছুর পুরোধা ছিলাম ‍আমি। নোবেল কমিটি জানতে পারলে নিশ্চয়ই ঘোষণা করতো: ‘দিস ইয়ার দ্যা নোবেল পিস প্রাইজ গোস টু জুয়েল অ্যান্ড হিজ গ্রুপ’।

ভেবে দেখুন তো, এরকম ছোট-বড় কতো কাজ আমরা করেছি। সে তুলনায় মালালার আর কী অবদান! সে না হয় একটু লেখাপড়া করতে চেয়েছে, নিজের সুবিধার কথা বিবেচনা করে তার বন্ধুরাও যাতে স্কুলে যাওয়া-আসা করে; সেটা চেয়েছে। এজন্য তালেবানদের হুমকি কোনো বিষয় হলো নাকি! অ মা, এটা কে না জানে যে তালেবান হচ্ছে মার্কিনীদের সৃষ্টি। তালেবানরা তাই মালালাকে এমনকি মাথায় গুলি করে দিলেও কুচ পরোয়া নেহি। তার চিকিতসার জন্য মার্কিনীদের ধামাধরা ব্রিটিশরা আছে না! তারাই সব চিকিতসার ব্যবস্থা করে দেবে। এমনকি পরে সারাজীবন পায়ের উপর পা তুলে ‍আরাম-আয়েশে-সুখে-শান্তিতে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করবে।

মালালাকে শুধু একটা কাজ করতে হবে, মাথায় গুলি খেলেও মরে যাওয়া যাবে না। প্রতিটি গুলিকে লাল পিঁপড়ার একেকটা ছোট কামড় বিবেচনা করে মটকা মেরে পড়ে থাকতে হবে, কিন্তু কোনোভাবেই পরপারে চলে যাওয়া চলবে না।

দু’ দিন ধরে আমার বিপ্লবী ভাই-বন্ধু-বোনদের আলোচনার শানে নূযুল এরকমই মনে হচ্ছে। তাদের মধ্যে এমনকি তারাও আছেন যারা মার্কিন বা ব্রিটিশদের কোম্পানিতে ফুট-ফরমাশ খাটেন আর নোবেল পুরস্কারকে সারাক্ষণ মার্কিনীদের পাতানো খেলা বলে মুখে ফেনা তুলেন। ভাই একটু থামেন। আপনার কথায় আমি একমত। নোবেল হচ্ছে মার্কিনীদের এক মহা প্রহসন। তা হলে ভাইজান, সেটা মালালা পেলো নাকি উ-লা-লার সঙ্গে উদ্দ‍াম নাচ নেচে বিদ্যিয়া বালান; সেটা নিয়ে ‍আমাদের এতো টেনশন কেনো? সেটা মালালা পেলেও যা, ঝামেলা পেলেও তা। এ নিয়ে তা হলে কথা বাড়ানোর মাজেযা কী?

মালালাকে নোবেল দেওয়ার জন্য নোবেল কমিটি কিংবা মালালাকে সামনে পেলে তাকেই ছিড়েখুঁড়ে চিড়েচ্যাপ্টা করে দেওয়ার যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে যে ক্লিন-শেভড অথবা মুস্টাচ ম্যানরা গোঁফে তা দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা মালালার নোবেলকে পশ্চিমাদের ‘সাপ হয়ে দংশন আর ওঝা হয়ে ঝাড়া’র তত্ত্বে ফেলছেন। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেলে কিন্তু তারা গর্বিত বা গরবিনী। ডক্টর ইউনূসের জন্য এমন গর্বিতদের মধ্যে তারাও আছেন যারা তাঁর আগে-পরে শান্তিতে সব নোবেলকে সাম্রাজ্যবাদীদের কারসাজি বলেছেন।

এ কথা সূর্যালোকিত দিনের মতো স্পষ্ট যে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারটা রাজনৈতিক। তবে সেটা বিশ্ব রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ থেকে পরিচালিত হয় বলে সেখানে বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটই বিবেচিত। সে কারণেই ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার পরও শেখ হাসিনা নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন না। ওই পুরস্কারে ভূষিত হন দারিদ্র বিমোচনের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। এখন শেখ হাসিনা শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পরও নোবেল পান নি বলে আমরা ডক্টর ইউনূসের নোবেলকে অবমাননা করবো?

তা হলে ওই ছেলেটির গল্প শুনুন। অংকে ১০০-তে ১০০ পেয়েছে সে। মাকে বলার পর মা বললেন, কিন্তু আরো তিনজনতো ১০০ পেয়েছে। ছেলেটির তখন উত্তর ছিলো, মা- আমার কাজ আমি করেছি, ১০০-তে ১০০ পেয়েছি। এখন অন্যরাও যদি ১০০ পায় সেটা তো আমি আটকে রাখতে পারবো না।

ঠিক যে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেতে পারেন এমন অনেকেই হয় তো নোবেল পান না। কিন্তু যিনি পেয়েছেন তাঁর কাজকে আপনি কিভাবে অবজ্ঞা করবেন!

কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, মালালা কোথায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে? তাদের কাছে বিষয়টা এরকম যে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটা দৃশ্যমান গুণগত পরিবর্তন দেখা যেতে হবে। সেটা কিছু ক্ষেত্রে হয় তো ঠিক আছে। কিন্তু একজন মানুষের একটি ছোট বা বড় কাজের অদৃশ্য যে ব্যাপক গুণগত ভূমিকা সেটা চোখের দেখায় দেখলে হবে না, মস্তিষ্ক দিয়ে বুঝতে হবে।

ঠিক সেই কাজটাই করেছেন মালালা ইউসুফজাই। মেয়েদের শিক্ষার জন্য তার যে সংগ্রাম সেটা এমনকি বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকা এলাকা ভুরুঙ্গামারিতে কাজ করতে গিয়েও বোঝা যাবে না। সেটা ঢাকার কোনো ফাইভস্টার হোটেলে জঙ্গিবাদবিরোধী কর্মশালাতে বসেও বোঝা সম্ভব না। তার সংগ্রামটা বুঝতে হলে ‘বর্বর’ পাকিস্তানের ‘বর্বরতম’ এলাকা সোয়াত উপত্যকাতেই যেতে হবে। একটা বাচ্চা মেয়ের বুকে কতোটা সাহস থাকলে সেখানে বসে সে তালেবানদের চ্যালেঞ্জ করে মেয়েদের শিক্ষার জন্য কাজ করতে পারে, সেটা বুঝতে হলে তার সাহস নিয়ে তোলা প্রশ্নকর্তাদের সেখানেই পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। অথবা তালেবানদের নতুন কাজিন কথিত ইসলামিক স্টেট, আইএসের ছুরির নীচে।

আইএস কাউকে কতল করার যে ভিডিও পাঠায়, তার ছোট্ট সংগ্রামে মালালা সবসময়ই ওইরকম অদৃশ্য ছুরির নীচে ছিলো। সেটা যে শুধু কাল্পনিক হমকি ছিলো না, সেটা তার মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাই প্রমাণ করে। আপনি কল্পনা করুন যে, কিরকম বর্বরদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মালালা মেয়েদের শিক্ষার জন্য তার সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছিলো, যে বর্বররা ১৫ বছরের একটা বাচ্চার মাথায় গুলি চালিয়ে দিতে পারে। যারা তার নোবেল নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তারা নিশ্চয়ই বলবেন না, মার্কিনী পানিপড়া দিয়ে নিজের মাথা মুড়িয়ে রেখেছিলো মালালা, তাই ‍তালেবানের বুলেট তাকে মেরে ফেলতে পারে নি।

তালেবানের ঘাঁটিতে বসে তালেবানকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সাহস দেখিয়েছে মালালা। তবে সে শুধু সেখানেই থেমে থাকে নি। অসম্ভব প্রাণশক্তি দিয়ে আবার জীবনে ফিরে এসে সে তার নতুন লড়াইটাও চালিয়ে যাচ্ছে। মালালার সাহস ও অঙ্গীকার এভাবে সার্বজনীনতা পেয়েছে যেখানে জঙ্গিবাদকে চ্যালেঞ্জ জানানোর নতুন অস্ত্র হয়েছে শিক্ষা, বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা। সেটা যে শুধু বর্বর পাকিস্তানের জন্য, তা না; সারাবিশ্বের জন্যই।

নোবেল কমিটির রাজনীতি যদি থেকে থাকে, সেটা এখানেই। জঙ্গিবাদ- সেটা হোক মার্কিনীদের তৈরি অথবা অনেক আগে থেকেই ইসলামের নামে জঙ্গিবাদি সাপের বিষাক্ত ফণা, সেটা এখন সারাবিশ্বের জন্যই হুমকি এবং সেই হুমকি মোকাবেলায় দীর্ঘস্থায়ী উপশম হচ্ছে শিক্ষা; এবং সেই কাজে মালালা আলোকর্তিকা হয়েছে বলেই তাকে নোবেল কমিটির স্বীকৃতি।

আপনার বাড়িতে যদি একটা শিশু থেকে থাকে, আপনি যদি তাকে মালালার গল্পটি বলেন; তা হলে তার প্রতিক্রিয়ায় আপনি কিছুটা হলেও মালালার নোবেল পাওয়ার মাহাত্ম্য বুঝবেন। আমার যে বন্ধুরা এখন মালালার নোবেল প্রাপ্তিতে কম্পিউটারের কি বোর্ডে ঝড় তুলছেন, তারা যদি বোকো হারাম কয়েকশ মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর একইরকম প্রতিক্রিয়া জানাতেন; তা হলেও না হয় কিছুটা সান্ত্বনা পেতে পারতাম।

মালালার নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার খবরে ধর্মীয় শক্তির নাখোশ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু দিনরাত প্রগতি প্রগতি বলে চিতকার করে মুখে ফেনা উঠানো মানুষদের বেদনাটা বুঝতে কষ্ট হয়। আর বিষয়টা এরকমও না যে মালালা আচানক নোবেল পেয়ে গেছে। গতবারও তার নাম বিবেচনায় ছিলো। এরপর সে আরো অনেক পুরস্কার পেয়েছে। কিছু আন্তর্জাতিক সম্মেলনের পাশাপাশি জাতিসংঘেও সে অসাধারণ এক বক্তৃতা করেছে। ষোল বছর বয়সী একটা মেয়ের জাতিসংঘে বক্তৃতাও তো এক বিশাল ঘটনা। কই, তখন তো কেউ চিতকার-চেঁচামেচি করে নি। এখন ‍সব শেয়ালের এক রা-তে মনে হয়, ঠিক সময়েই নোবেল পেয়েছে মালালা।

আপনি যদি জঙ্গিবাদকে হুমকি মনে করেন, তালেবান ও আইএসকে বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি মনে করেন, তা হলে তাদের মোকাবেলায় মালালা এখন এক বড় অনুপ্রেরণার নাম। ‘একদিন ঝড় থেমে যাবে’ সেই অপেক্ষ‍ায় থেকে তাকে সেই স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য তার পরিণত বয়স পর্যন্ত অপেক্ষারও কোনো যুক্তি ছিলো না।

কারণ জঙ্গিবাদি ঝড় থামাতে মালালার সাহস এবং মেয়েদের শিক্ষার জন্য তার যুদ্ধ, দুটোই বড় বেশি প্রয়োজন।

আর কেউ যদি মালালা পাকিস্তানি, শুধু এ কারণেই তার নোবেল পাওয়ার বিরোধিতা করেন, তা হলে তাদের বুঝতে হবে, যে পঁচা-গলা আদর্শকে প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম, ভিন্ন প্রেক্ষাপটে সেই প্রতিক্রিয়াশীলতাকে নাকচ করেই মালালার উত্থান।

জাহিদ নেওয়াজ খান: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।