ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

শিশুদের পাঠ্য বই : একটি পর্যালোচনা

কে এম এস আলম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১৪
শিশুদের পাঠ্য বই : একটি পর্যালোচনা ছবি: ফাইল ফটো

প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে পাঠ্য বই। এর মধ্য দিয়েই শিশু শিক্ষালাভের অন্তহীন পথে পা রাখে।

উন্নত দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ কখনো বিফলে যায় না; বরং এটি দেশের অমূল্য সম্পদ হিসেবে ফিরে আসে।
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও জ্ঞানে উৎকর্ষ অর্জন বড় মাপের উন্নয়নের পক্ষে সবচেয়ে টেকসই ভিত হিসেবে কাজ করে।

১৯৯০ সালের পর সামরিক শাসন-উত্তর যেসব সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সবাই মানবসম্পদ উন্নয়নে গভীর মনোযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ পেতে পারে। এ সময় প্রশংসনীয় যে উদ্যোগগুলো নেওয়া হয় তার মধ্যে আছে ২০২০ সালের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা, প্রাথমিক ও জুনিয়র স্তরে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ, মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বিনা মূল্যে বই সরবরাহ ও মেয়েদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা।

বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রীও শিক্ষার প্রসারে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তিনি প্রাথমিকভাবে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রীদের জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা প্রদানের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। পরবর্তী পর্যায়ে ধাপে ধাপে ছাত্রদেরও এ সুযোগের আওতায় আনা হবে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি জাতিসংঘ ফোরামেও 'এডুকেশন ফার্স্ট' শীর্ষক একটি ভাষণ দিয়েছেন। সরকারগুলোর এসব উদ্যোগে উন্নয়ন অংশীদার থেকে শুরু করে সমাজের সচেতন মহল শুধু সমর্থনই জানায়নি, তারা সাধ্যমতো মঞ্জুরি ও সহায়তারও অঙ্গীকার করেছে।

স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার কমে আসা, সেই সঙ্গে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাইমারি ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (পিএসসি ও জেএসসি) পরীক্ষায় আশাব্যঞ্জক ফলাফলকে রাষ্ট্র পরিচালিত এসব শিক্ষা উদ্যোগের সাফল্য হিসেবেই গণ্য করা হচ্ছে এবং উদ্যোগগুলো জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও উন্নয়ন অংশীদারদেরও প্রশংসা কুড়াচ্ছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) রাষ্ট্রীয় শিক্ষা উদ্যোগ বাস্তবায়নকারীদের মধ্যে অন্যতম। মূলত এনসিটিবি উদ্দিষ্ট শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায়োগিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন ও প্রতিবছর ১০০ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয়ে কোটি কোটি পাঠ্যপুস্তক বিতরণের মধ্য দিয়ে এ কাজটি করছে।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে পাঠ্যপুস্তকে নিম্নমানের কাগজ, অপ্রাসঙ্গিক ও অসংলগ্ন বিষয়, দুর্বল সম্পাদনা, ভুল মুদ্রণ, নাজুক বাঁধাই, বিলম্বিত মুদ্রণ ও সরবরাহে ঘাটতির খবর প্রতিবছরই, বিশেষ করে প্রতি শিক্ষাবর্ষের প্রথম তিন মাসে পত্রপত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে।

যেসব অভিযোগের কারণে এ খাতটি বারবার গণমাধ্যমের নজরে পড়ছে তার মধ্যে আছে সম্পদ সমন্বয়ে ত্রুটি, দুুর্বল নজরদারি এবং প্রান্তিক কর্মপ্রক্রিয়ায় অব্যবস্থাপনা। পর্দার আড়ালে আরো অনেক সমস্যা রয়েছে, যেগুলো পূর্বোল্লিখিত সমস্যাগুলোর মতো অতটা দৃশ্যমান নয়। এসব সমস্যার তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব না দেখা গেলেও একটা সময় বায়ু, মাটি, পানিসহ আমাদের চারপাশের প্রাণিজগতের জন্য ক্ষতিকারক হিসেবে দেখা দিতে পারে।

উদ্বেগজনক বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সস্তা বা নিম্নমানের কাগজ, যার অধিকাংশই স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে পুরনো পত্রিকা ও নানা ধরনের কাগজের বর্জ্য ব্যবহার করে। মনে করা হয় যে রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার তুলনামূলক সম্পদসাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব।

কাগজ উৎপাদনে ডেইনকিং, পালপিং, রিপালপিংয়ের মতো জটিল প্রক্রিয়া রয়েছে এবং এর মধ্য দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্য বেরিয়ে আসে, যেগুলো সরাসরি প্রকৃতিতে নিক্ষেপের উপযোগী নয়; এমনকি কারখানাতেও এগুলোকে যথাযথভাবে নিরাপদ আকারে আনা সম্ভব হয় না।

মুদ্রণের রং ও কালিতে বিভিন্ন বিষাক্ত উপাদান ও ভারী ধাতব পদার্থ থাকে, যার মধ্যে আছে ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, সিসা, পারদ প্রভৃতি। কাগজের ডেইনকিং কারখানার বর্জ্য এ কারণেই উচ্চমাত্রার বিষাক্ত ও মানবদেহের জন্য অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর।

সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণা মতে, এ ধরনের বর্জ্যের সংস্পর্শে এলে স্বল্পস্থায়ী থেকে দীর্ঘস্থায়ী- দুই ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। পুরনো কাগজ প্রক্রিয়াজাত করে পুনরায় কাগজ তৈরির সময় যেসব ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য তৈরি হচ্ছে, নিয়মিত ও মাঝারি মাত্রায়ও সেগুলো জলাশয়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে।
বিশেষ করে ক্লোরিনেটেড ফেনলস, পলিক্লোরিনেটেড ডি-বেনজো ডাইঙ্নি, ডি-বেনজো ফুরানস মাছ, সামুদ্রিক পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও চূড়ান্তভাবে মানুষের খাদ্য শৃঙ্খল বা ফুডচেইনে রাসায়নিক বিষ ছড়াতে পারে এবং পানির গুণগত মান খারাপ করে দিতে পারে। এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ জৈবের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার, লিমফোমাস, ডায়াবেটিস, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অকার্যকর এবং শিশুর অননুমানযোগ্য জন্মগত ত্রুটির ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে।

অবশ্য নিশ্চিতভাবে কেউ জানে না, সরকার পরিচালিত শিক্ষা উদ্যোগুলোর আওতার বই-পুস্তক মুদ্রণে যে পুনঃপ্রক্রিয়াকৃত কাগজ বা নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোতে এমন কোনো মাত্রায় বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি আছে কি না, যার ফলে বিপুলসংখ্যক শিশু-কিশোরের স্বাস্থ্য কোনো ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।

সিনিয়র চক্ষুবিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কম উজ্জ্বল কাগজে বর্ণ ছাপা হলে তা পড়ার স্বাভাবিক গতিকেই যে শ্লথ করে দেয় তা নয়, সঠিকভাবে পড়ার ক্ষেত্রেও বাধা তৈরি করে। বিশেষ করে নতুন পাঠকদের ক্ষেত্রে কথাটি সত্য। নিষ্প্রভ কাগজে ছাপা হলে নতুন পাঠকদের তা বারবার পড়তে বাধ্য করে, দৃষ্টি সরিয়ে দেয়, মনোযোগ নষ্ট করে এবং মাঝারি থেকে দীর্ঘ ধরনের পাঠ্য বিষয়ের ক্ষেত্রে ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়।

যখন গাঢ় বর্ণ তুলনামূলক সাদা তলে প্রদর্শিত হয় তখন ইতিবাচক ইমেজ পোলারিটি তৈরি করে এবং এর বিপরীত ব্যবহারের ক্ষেত্রে তৈরি হয় নেতিবাচক ইমেজ পোলারিটি। পাঠ্য উপাদান কেনার ক্ষেত্রে এটিও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিবেচ্য বিষয়। নতুন পাঠকদের সাড়া ইতিবাচক ইমেজ পোলারিটির ক্ষেত্রে খুবই বেশি হয়। একইভাবে কাগজের শুভ্রতা এ জন্যই বেশি প্রয়োজন যে এর ফলে পাঠক এক বর্ণের সঙ্গে আরেক বর্ণের মিশে যাওয়ার দৃষ্টিভ্রম থেকে রক্ষা পায়।

আরো একটি দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, নিম্নমানের এবং পুনঃপ্রক্রিয়াকৃত কাগজে তৈরি পাঠ্যপুস্তক উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার পক্ষে অতি সংবেদনশীল এবং এ ধরনের আবহাওয়াই বাংলাদেশে সাধারণত বিরাজমান। উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়ায় পাঠ্য বইয়ের পাতার বহির্ভাগ শক্ত হয়ে আটকে যায় এবং আপনা-আপনি খুলে আসে অথবা হলদে বা বিবর্ণ হয়ে যায়। আর আর্দ্র আবহাওয়ায় বইয়ের পাতা সিক্ত হয়ে ওঠে এবং আলতো স্পর্শেই আলগা হয়ে যায়। এর ফলে বইটি একেবারে নষ্ট না হয়ে গেলেও এর ব্যবহারের সুযোগ বহুলাংশে কমে যায়।

যেহেতু এসব পাঠ্যপুস্তকের ব্যবহারকারীরা প্রত্যন্ত ও গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা প্রয়োজনীয় যত্ন নিতে পারে না বা বাজারে গিয়ে নতুন বই কেনার সুযোগ থাকে না, পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে তারা সমস্যায় পড়ে। এর ফলে বিনা মূল্যে বই বিতরণের সরকারি উদ্যোগটিই আসলে অর্থহীন হয়ে যায়। দেখতে ভালো, দীর্ঘস্থায়ী, পড়ায় আরামদায়ক- এমন বই সহজে স্থানীয়ভাবেই তৈরি করা যায়, যদি প্রকাশনা ও বিতরণের দায়িত্বে থাকা সরকারের সংস্থাগুলো এ বিষয়ে যথেষ্ট যত্নবান থাকে এবং তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হয়।

অবিবেচক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু বাণিজ্যের জন্য এনসিটিবির এ কাজের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং কাগজের নির্ধারিত মান, উন্নত মুদ্রণ এবং বইয়ের সময়োচিত সরবরাহের দিকে তাদের কোনো ধরনের মনোযোগ থাকে না।

এনসিটিবির পাঠ্য বই উৎপাদন ও বিতরণকাজের টেন্ডারে অদক্ষ ও অসৎ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে অংশ নিতে আর না পারে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। অনেকেই মনে করছেন, কাগজ উৎপাদন ও মুদ্রণে যোগ্য ও আদর্শ প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ কাজের জন্য নিবন্ধিত করা হলে এই নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ অনেকটাই সহজ হবে।

ওপরে উল্লিখিত সমস্যাগুলোর সমাধানের দিকগুলো এনসিটিবি কখনো ভেবেছে কি না তা জানা যায়নি। তবে নির্ভুল, মানসম্মত পাঠ্য বই মুদ্রণে আরো মনোযোগ দেওয়া এবং প্রধানমন্ত্রীর 'সব কিছুর আগে শিক্ষা' এই স্বপ্নের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে প্রত্যেক নতুন পাঠকের হাতে সে বই তুলে দেওয়ার সময় এসেছে।
লেখক : জর্দানের সাবেক কান্ট্রি ম্যানেজার, বাটা শু,
ই-মেইল : shahidul.alam.1968@gmail.com

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।