ভদ্রলোক সম্পর্কে খবরটা কানে এসেছিল অনেক আগেই। আমিও খুব তক্কে তক্কে ছিলাম।
হ্যালো বলতেই অত্যন্ত বিনম্র আর নিচু গলায় এক বাঙালির কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। জানা গেল, তিনি সেই ভদ্রলোক যাকে আমি দিনের পর দিন খুৎজে বেড়াচ্ছি! আনন্দে বুকটা যেন ভেসে গেল। যাক, পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত। ভদ্রলোক আমাকে তার বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। আর আমাকে এত দেরিতে স্মরণ করার জন্য বারবার ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু তাঁর অতিরিক্ত বিনয় দেখে আমি সত্যিই লজ্জিত হয়ে যাই। মনে মনে আনন্দিত হই এই মনে করে যে, এমন একজন অসাধারণ মানুষের সঙ্গে আমি পরিচিত হতে পেরেছি। ঝটপট দিনক্ষণ ঠিক করে একদিন টুক করে চলে যাই তার কুইন্সের এস্টোরিয়াতে ছোট্ট একটা অ্যাপার্টমেন্টে।
নিউইয়র্কের এস্টোরিয়ায় ছোট্ট দোতলা বাড়িতে কলিংবেল চাপতেই গায়ে সেন্টো গেঞ্জি পড়া মাঝ বয়েসি এক বাঙালি ভদ্রলোক দরজা খুলে দিলেন। না। আমি উনাকে আগে কখনই দেখিনি। প্রথম দেখাতেই এক ধরনের ভালোলাগার অনুভূতিতে প্রাণ ছুঁয়ে গেল। ঠোঁটের এক কোণে কোথায় যেন একচিলতে হাসি সারাক্ষণ লেগে আছে। বিনয় নামের শব্দটা যেন উনার মতো মানুষদের জন্যই তৈরি হয়েছিল। ছোট্ট একটা এক বেড রুমের বাসা। খুবই এলোমেলো অবস্থা। আরো দুজন বাঙালির সঙ্গে শেয়ার করে তিনি থাকেন। চাকরি-বাকরি করেন খুবই সামান্য। হ্যাঁ, খুবই সামান্য। কিন্তু তাতে কি? এই পাঁচ ফুট মাপের মানুষটার ভেতর পাঁচ হাজার টন পরিমাণ ভালোবাসা আর আদর যেন গিজ গিজ করছে। অসাধারণ হৃদয়বান মানুষ বলতে যা বুঝায় তিনি হলেন আক্ষরিক অর্থে তাই। তার চোখের তারায় শুধু দেখি নিত্য মানুষের জন্য ব্যাকুলতা আর মানুষের জন্য ভালোবাসা।
ভদ্রলোকের নাম ফজলুর রহমান। হাজার নিষেধ সত্ত্বেও ঝটপট চায়ের ব্যবস্থা আর দুটো নোনতা বিস্কিট দিয়ে বাঙালির আপ্যায়নের প্রথাটি রক্ষা করলেন। প্রথমে এই বিষয়ে একদম কথা বলবেন না। তার ভাষায়, ‘এইতা কিছু না’। কিন্তু আমার কাছে এই ‘এইতা’ যে অনেক কিছু তা এই মানুষটাকে বুঝাই কী করে? শেষ পর্যন্ত অনেক টেনেটুনে কাঠখড় পুড়িয়ে যতটুকু উদ্ধার করা গেল তাই আপনাদের পাতে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
ফজলু ভাই আমেরিকায় এসেছেন প্রায় বছর পাঁচেক হল। কাজ করছেন একটা ফাস্টফুড রেস্তোঁরায়। খুব সামান্য কটা পয়সা তার রোজগার। কিন্তু সেই সামান্য কটা টাকা দিয়েই তিনি যেন এ যুগের ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। কী দয়ার হাত! তাঁর নিজের এলাকার গরিব আর মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের টাকা পয়সা দেন বই-খাতা কিনতে। খরচ যোগান দেন স্কুলের মাইনে দিতে। পাশের বাড়ির গরিব মানুষটি যার চিকিৎসা হচ্ছে না টাকার জন্য, তিনি তার সাধ্যমত চেষ্টা করেন কিছু একটা করার। এইতো সেদিন দশ হাজার টাকা খরচ করে একজনের চোখের অপারেশন করালেন। না, তিনি একা নন। তাঁর সঙ্গে আরো অনেকেই এই মহান কাজে এগিয়ে আসেন। তিনি শুধুমাত্র উদ্যোগটা নেন। তার আফসোস। ‘ট্যাহা নাই, থাকলে দেখতেন কি করতাম’। কিন্তু টাকা না থাকলে কি হবে ফজলু ভাইয়ের বিশাল একটা মন আছে। তার সেই বিশালতার কাছে আমরা সবাই খুবই তুচ্ছ, খুবই সামান্য। আনন্দের সঙ্গে জানালেন যে তার সহযোগিতায় বেড়ে ওঠা এক হত দরিদ্র ছেলে এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ছে। এটা তার খুব গর্বের একটি বিষয়। ফজলু ভাই সিগারেট খান না, পান খান না এমন কি জ্যাকসন হাইটস যেয়ে কোনোদিন চা আর সিঙ্গারা কিনে খাননি। কারণ এই টাকাটা তিনি সঞ্চয় করে বাংলাদেশে পাঠান গরিব ছোট ছোট বাচ্চাদের সাহায্য করতে।
তাঁর কথা, ‘অযথা ট্যাহা নষ্ট করার কোন রাইট আমরার নাই। ’ আর সে কারণেই তিনি অযথা কোন ‘অকামে’ টাকা পয়সা খরচ করেন না। তিনি যে সামান্য কটা টাকা আয় করেন, তাই দিয়ে বাসা ভাড়া ও অন্যান্য আনুসাঙ্গিক খরচ মিটিয়ে যা থাকে তা বাংলাদেশে তার নিজের সংসার চলে আর মানুষদের সাহায্য সহযোগিতার চেষ্টা করেন। তার কথা যতই শুনছিলাম ততই যেন অবাক হচ্ছিলাম। এই ধরনের মানুষ এখনো আছে তাহলে? এ যেন সাক্ষাৎ বিদ্যাসাগর। ঈশ্বরচন্দ্র তো নিজে বিত্তবান ছিলেন। মানুষকে দান করতে পারতেন। কিন্তু আমাদের এই ফজলু ভাই? অথচ কত সুখী মানুষই না তিনি। উনার মুখ যেন হাসি আর আদরে ভরা থাকে সারাক্ষণ! কথায় কথায় অনেক কথাই বললেন। বললেন মানুষ হিসেবে আমাদের দায়বদ্ধতার কথা। বললেন আর কিছুদিন বাদেই এই নিউইয়র্কের সংগঠনগুলোর ভেতর পিকনিকের ধুম পড়ে যাবে। অথচ এরা খুব সহজেই পিকনিকের খাবার দাবার থেকে একটা আইটেম ছেটে দিয়ে খরচ কমিয়ে সেই টাকাটা নিজেদের এলাকার গরিব মানুষদের সাহায্যে পাঠিয়ে দিতে পারেন। বলেন আরো আনেক অনেক মূল্যবান কথা। পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে লোক দেখানো কোরবানির গরু না কিনে ত্রিশ হাজার টাকায় সে গরু কিনে বাকি বিশ হাজার টাকা গরিব মানুষদের জন্য দিয়ে দিলে কি ক্ষতি হয়? উনি এমনটাই মনে করেন। তার একটাই কথা। আমাদের সবার সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব মানুষকে সাহায্য করা উচিত। কারণ মানুষকে ভালোবাসাই যে সবচেয়ে বড় ধর্ম!
জানি, এই ফজলু ভাইদের মতো নীরবে নিভৃত্যে হাজারো ফজলু ভাইরা আমাদের চারপাশেই হয়তো রয়েছেন। এটাও জানি যে তারা এই দানটা খুব নীরবেই করতে ভালোবাসেন। নিউইয়র্কের এই ব্যস্ত কঠিন জীবনের মাঝেও তারা মানুষ নিয়ে ভাবেন। মানুষকে ভালোবাসেন। তাদের ছোট্ট ভালোবাসায় ভরা বাঙালি বুকে আরেক বাঙালিকে আগলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেন।
ফজলু ভাই এর কাছ থেকে যখন বিদায় নিচ্ছিলাম তখন নিউইয়র্কের বিকেলের নরম রোদ ফিকে হয়ে রাস্তায় সন্ধ্যার বাতি জ্বলতে শুরু করেছে। ফজলু ভাই, আপনাকে আমার এই ছোট্ট হৃদয়ে কোথায় স্থান দেই, বলেন তো? আপনার পবিত্র চরণদুটো কি একটু ছুঁয়ে দিতে পারি?
লেখক : প্রাবন্ধিক
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৪