একটা সময় জল আর জলযান ঘিরে মুখরিত ছিল জলনির্ভর জীবনময়তা। কত ঘটা করে বানানো হতো নানান জাতের নানান মাপের নাও।
অদ্বৈত মল্ল বর্মণ তিতাসকে নিয়ে লিখেছিলেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, সেই তিতাসকে উন্নয়ন অবকাঠামোর মাধ্যমে খুন করা হয়েছে। মনসামঙ্গল থেকে শুরু করে মৈমনসিংহ গীতিকা সবইতো নদীজীবনের আখ্যান। পদ্মা নদীর মাঝি, ছিন্নপত্র, দেবতার গ্রাস, নৌকাডুবি, ভাগিরথীর উৎস সন্ধানে, নদী পথ, পদ্মা নদীর মাঝি, কাঁদো নদী কাঁদো, গঙ্গা, তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত, তিস্তাপুরাণ, জলদাসীর গল্প, ধীবর জীবনকথা, মোহনা, হাঁসুলীবাঁকের উপকথা, কৈবর্তকথা, ধীরে বহে মেঘনা, নদীর নাম মধুমতী, চিত্রা নদীর পাড়ে নদীকে ঘিরেই তো আমাদের কাব্য-গাথা-গীত-নাটক-সিনেমা।
রাষ্ট্র কখনোই দেশের সংস্কৃতিকে নদী-সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচনা করেনি। তাই নদীর মৃত্যুতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নিশ্চুপ থাকছে। দেশের নদী-সংস্কৃতির সাথে এক বিচ্ছিন্নতার দুঃসহ গণিত তৈরি হয়েছে এভাবেই, আন্তঃমন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সকল রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়হীনতার ভেতর দিয়ে। নদী তাই কেবল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, অভ্যন্তরীণ নৌ কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মপরিধির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা নদীর সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ও নদীজীবনের সংস্কৃতি-বিজ্ঞানকে গুরুত্ব ও স্বীকৃতি দিতে বরাবরই অসমর্থ হচ্ছে। আবার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় যখন দেশের সংস্কৃতি বিকাশ ও সংরক্ষণের জন্য কাজ করছে তখন নদীকে অন্যায়ভাবে দূরে সরিয়ে রাখছে, নদীসংস্কৃতির রূপান্তর ও আহাজারিকে কোনোভাবেই নিজের কর্মপরিধির আওতায় টানতে পারছে না। নদী ঘিরে রাষ্ট্রের এই আন্তঃমন্ত্রণালয়গত কঠোর মনস্তত্ত্ব বদলাতে হবে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে দেশের সংস্কৃতিকে নদী-সংস্কৃতি হিসেবেই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। নদ-নদীর দুঃসহ করুণ পরিণতি কিভাবে ঠেকানো যায়, এ দায়িত্ব সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কেও নিতে হবে। কারণ প্রতিটি নদী প্রবাহের পরিবর্তন ও ঝুঁকির যাবতীয় প্রভাব পড়ে নদী অববাহিকার জনজীবনের সংস্কৃতিতে।
নদীকে খুনজখম করে, লাশ বানিয়ে, লুট ধর্ষণ করে কোনোভাবেই নদী অববাহিকার সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও বিকাশ সম্ভব নয়। নদী এক জীবনের বিজ্ঞান, উজান ভাটিতে এটি নিরন্তর নির্মাণ-বিনির্মাণ করে চলে জীবনের বৈচিত্র্য ও বৈভব। এ কারণেই শংখ কি কর্ণফুলী, গড়াই কি তিস্তা, ফেনী কি সিমসাং, পিয়াইন কি মেঘনা, পদ্মা কি করতোয়া, বড়াল কি রায়মঙ্গল অববাহিকার সংস্কৃতি এক নয়। নদীপ্রবাহের ভিন্নতা মানে মাটি ও শস্যফসলের ভিন্নতা, পেশা ও উৎপাদন সম্পর্কের ভিন্নতা। আর এই ভিন্নতাই গড়ে তোলে গীত-বাদ্য-নৃত্য-নাট্য-পালা-চিত্র-কারিগরির অসীম বিস্তার ও বৈচিত্র্য।
ফারাক্কা ব্যারেজ, তিস্তা ব্যারেজ, টিপাইমুখ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পসহ উজানে একটার পর একটা বাঁধ দেশের নদীধারার উপর চরম অনাচার জিইয়ে রেখেছে। যার দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নদীনির্ভর সংস্কৃতির ময়দানকেও। অথচ আমরা মূলধারার সংস্কৃতি নিয়ে আলাপ বাহাসে বরাবর নদীনির্ভর সংস্কৃতির এই প্রশ্নহীন মুমূর্ষু দশাকে কখনোই জান জবান দিয়ে চিহ্নিত করিনি। নিম্নবর্গের নদীজীবনের সংস্কৃতির ভেতরে নদীখুনের বিরুদ্ধে টগবগ আওয়াজ আছে। পদ্মা নদীর মাঝি’র কুবের বা তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্তের বাঘারুরা সেই দ্রোহ জানান দিচ্ছে কাল থেকে কালে। কিন্তু রাষ্ট্র কবে নিম্নবর্গের এই নদী-আবদার বুকের কলিজায় ধারণ করবে?
১৯৮০ সনে নদী সংরক্ষণকর্মী ড. মার্ক অ্যাঞ্জেলো নদী দিবসের সূচনা করেন। ২০০৫ সনে জাতিসংঘ বিশ্ব নদী দিবসকে অনুসমর্থন করে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার নদীপ্রেমী অনেকেই বিশ্ব নদী দিবস পালন করলেও নদীমাতৃক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এখনও এ দিবসটিকে গুরুত্ব দেয়নি। বাংলাদেশের নদীপ্রেমী সংগঠকেরা এ বছরের বিশ্ব নদী দিবসের প্রতিপাদ্য ঠিক করেছে, নদীকে তার তীর ফিরিয়ে দাও। নদীর তীরেই গড়ে ওঠেছে সমাজ, সভ্যতা ও দেশ। নদীর তীরেই আয়োজিত হয় পূজা-পার্বণ, পুণ্যস্নান, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, হাট-বাজার, পালা-পার্বণ, কবিগান, গ্রামীণ খেলা, মেলা ও বারুণী। কিন্তু অন্যায়ভাবে নদ-নদীসমূহের তীর লুটতরাজ চলছে। তীরহীনতায় কেবল নদীই যে তার জীবনের গতিপথ হারাচ্ছে তা নয়, তীরকেন্দ্রিক নদীনির্ভর সাংস্কৃতিক চর্চাধারাও নাব্যতা হারিয়েছে। একতরফাভাবে কেবল নদীখনন করে নদীসংস্কৃতির বিকাশমানতার সুরক্ষা সম্ভব নয়, একইসাথে সাংস্কৃতিক খননও জরুরি। কারণ নদীপ্রবাহের সাথেই দেশের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস প্রিয় সংস্কৃতিমন্ত্রী নদী ও সংস্কৃতির এই অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ককে বিশেষভাবে বিবেচনা করে দেখবেন। দেশের সংস্কৃতিকে নদী-সংস্কৃতি হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে নদীনির্ভর সংস্কৃতির আপন প্রবাহ সুরক্ষায় নিজ নদীপ্রেমকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সত্য করে তুলবেন। নদী ও সংস্কৃতির অভিন্ন মুর্মূষু ধারাকে বুকে আগলে বিশ্ব নদী দিবসে মাননীয় সংস্কৃতিমন্ত্রীর কাছে এই ক্ষুদ্র নদী-আবেদন রাখছি। নদীর আপন গতিপ্রবাহেই নিরন্তর বিকশিত হয়ে ওঠুক নিম্নবর্গের সংস্কৃতির জোয়ার-ভাটা।
পাভেল পার্থ: গবেষক ও লেখক।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৪