ঢাকা: রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী এমদাদুল ইসলামের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
সম্প্রতি তিন মামলার আসামি রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী এমদাদুল ইসলামের বিরুদ্ধে এবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেও (এনবিআর) অসংখ্য অভিযোগ জমা পড়েছে।
জানা গেছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ক্ষমতার অপব্যবহারকারী এই বিতর্কিত কর্মকর্তার বিভিন্ন দুর্নীতি খতিয়ে দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ সংস্থাটিও প্রকৌশলী এমদাদুল ইসলামের সব আর্থিক আয়-ব্যয়ের বিবরণী ও আয়কর ফাইলসংক্রান্ত বিভিন্ন নথি চেয়েছে এনবিআরের কাছে। পাশাপাশি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য ভুক্তভোগীও এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে অনেক অভিযোগ দিয়েছেন। এর মধ্য থেকে বেশকিছু গুরুতর অভিযোগ আমলে নিয়ে তা তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনবিআর।
সম্প্রতি এনবিআরে জমা হওয়া এমন একটি অভিযোগে দেখা গেছে, রাজধানীর তেজতুরী বাজার এলাকার বর্তমান বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা নরেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস নামের একজন অভিযোগ করে বলেছেন, তিনি ২০০৩ সালে অবসর নেওয়ার পর মিরপুর কালাপানি এলাকায় পৈতৃকসূত্রে পাওয়া পৌনে ৩ কাঠার একখণ্ড জমিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে বাড়ি নির্মাণের জন্য রাজউকে স্ট্রাকচারাল প্ল্যান জমা দিয়েছেন। এরপর দীর্ঘ ছয় মাস রাজউকে ঘোরাঘুরির পর তাকে জানানো হয়- উপরের নির্দেশে তার প্ল্যান পাস বন্ধ রাখা হয়েছে। ‘উপরের নির্দেশ’ বলতে কার নির্দেশ, তা জানতে সময় লাগে আরও তিন মাস।
তবে এরপর তিনি রাজউকের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে জানতে পারেন তার জমির ওপর নজর পড়েছে প্রকৌশলী এমদাদুল ইসলামের। অনেক চেষ্টা-তদবির করে এই প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নরেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস। এ সাক্ষাতে এমদাদ তাকে ধমক দিয়ে বলেন, জমিতে তার বৈধ মালিকানা নেই। তখন নরেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস তার বাবার আমলের জমির দলিল, খতিয়ান হিসেবে সিএস, আরএস ও এমএস পরচা তাকে দেখানোর চেষ্টা করলে এমদাদ বলেন, এ জমি তার এক বান্ধবীর কাছে বিক্রি করতে হবে। এরপর তিনি একমাত্র সম্বল এ জমি বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় এখন পর্যন্ত প্ল্যান পাস করেননি এমদাদ। বরং তার পরিচিত এই এলাকার সন্ত্রাসী মজনু সরদারকে দিয়ে জমি বিক্রি করতে নরেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাসের ওপর বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন।
একপর্যায়ে ২০০৭ সালে হঠাৎ করে ওই জমির ওপর কে বা কারা ঘর তুলে দখল নেয়। সাত বছর ধরে এ জমি উদ্ধারে মামলা করেও কোনো সুফল না পেয়ে এখন সর্বস্বান্ত নরেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস। তিনি পরে জানতে পারেন, তার জমির পাশে আরেকটি খালি প্লট কিনেছেন এমদাদের বান্ধবী। তার এই বান্ধবী এমদাদের ক্ষমতার দাপটে নরেন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাসের প্লটটিও দখল করে নিয়েছেন।
জানা গেছে, রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী এমদাদুল ইসলামের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগের অন্ত নেই। ক্ষমতার অপব্যবহার, জাল দলিল সৃজন ও পরিবেশ আইন ভঙ্গ করায় এমদাদুল ইসলাম এখন তিন মামলার আসামি। প্রথম মামলা তদন্ত করছে দুদক (সিআর মামলা নম্বর ৪৫০০/০৮)। দ্বিতীয় মামলা তদন্ত করছে মিরপুর থানা পুলিশ (সিআর মামলা নম্বর ৪৩৮/২০১৩)। তৃতীয় মামলার তদন্ত করছে অপরাধ তদন্ত সংস্থা-সিআইডি (সিআর মামলা নম্বর ০৬/২০১৪)। এ ছাড়া রাজধানী মিরপুরের হোল্ডিং নম্বর ৫/১০, বসতি প্রপার্টিজ লিমিটেড, বড়বাগ, মিরপুর-২ এ ঠিকানায় নিজ পরিবারের নামে কেনা ৫ কাঠা জমি রয়েছে।
ওই জমি বেনামে কেনা হয়েছে এমদাদুল ইসলামের খালাত ভাই এম জি রহমান বুলুর নামে। সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে পাঁচ তলা ভবন। আবাসিক ভবনের নামে রাজউকের অনুমোদন নেওয়া হলেও এটি বর্তমানে পরিণত হয়েছে বাণিজ্যিক ভবনে। ওই ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে আরমিন সোয়েটার লিমিটেড নামের একটি তৈরি পোশাক কারখানা। কারখানার পরিবেশ দূষণকারী কালো ধোঁয়া ও শব্দদূষণ এলাকাবাসীর জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এলাকাবাসী সোয়েটার কারখানাটি সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানালেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য আদালত পর্যন্ত গড়ায়। রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী এমদাদের আসছে নভেম্বরে চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার কথা।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল ও অনিয়ম কমাতে ই-টেন্ডারিং করার যে উদ্যোগ তাও রুদ্ধ করে রেখেছেন প্রধান প্রকৌশলী এমদাদ। এতে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন তিনি। আর দুর্নীতির বোঝা চাপানো হচ্ছে রাজউক তথা সরকারের ঘাড়ে। সব মিলিয়ে পুরো রাজউক এখন অনেকটা এমদাদের কাছে জিম্মি। জানা গেছে, রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী এমদাদুল ইসলাম এবার বিদেশ সফরে গিয়ে বিস্ময়কর কাণ্ড ঘটিয়েছেন।
সম্প্রতি রাজউকের পক্ষ থেকে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি সফরকালে এমদাদুল ইসলাম তার সহকর্মীর বিরুদ্ধে এনেছেন ডলার চুরির অভিযোগ। সফরকালে এমদাদের হোটেল কক্ষ থেকে কয়েক হাজার ডলার চুরির চমকপ্রদ ঘটনায় বিব্রত হন সফরসঙ্গীরা। এ নিয়ে যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে লঙ্কাকাণ্ড ঘটান তিনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিদেশ সফর থেকে ফিরে রাজউক চেয়ারম্যানের কাছে একটি লিখিত আবেদনও দিয়েছেন এমদাদুল ইসলাম। ওই আবেদনে সফরকালে তার কক্ষ থেকে ডলার চুরির জন্য প্রবাসে তার রুমমেট ও রাজউকের উপ-নগর পরিকল্পনাবিদ মো. মোশারফ আলী আকন্দকে দায়ী করেছেন।
আবেদনে তিনি উল্লেখ করেছেন, সম্প্রতি বিদেশে শিক্ষা সফরকালে রাজউক থেকে প্রদত্ত ভাতা চুরি হওয়া প্রসঙ্গ। এমদাদুল ইসলাম তার আবেদনে বলেছেন, শিক্ষা সফরকালে রাজউক থেকে তাকে ৩ হাজার ৪৯৫ ডলার দেওয়া হয়। ওউ ডলারের সঙ্গে বাড়তি ২ হাজার ডলার সঙ্গে নিয়েছিলেন তিনি। জার্মানি থেকে ফ্রান্স যাওয়ার দিন সকালে তার মানিব্যাগ থেকে ডলার চুরির অভিযোগ করেছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এমদাদের হাজার হাজার ডলার বিদেশে নিয়ে যাওয়াসংক্রান্ত কোনো তথ্য তার পাসপোর্টে এনডোর্সমেন্ট নেই। কীভাবে এত ডলার তার হারিয়ে গেল তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানান প্রশ্নের।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৪