পর্ব ১
উদ্যোক্তা হওয়া নিয়ে এখন সবারই আগ্রহ আছে। কিন্তু, আমাদের দেশে উদ্যোক্তা কেন সে ভাবে তৈরি হচ্ছে না তা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়ে উদ্বেগ আছে।
অনেক ধরনের বাধা ও সংকট সত্ত্বেও আমাদের দেশে অনেকে উদ্যোগী হন। আবার অনেকে উদ্যোক্তা হয়ে লোকসানের শিকার হয়ে উদ্যম হারান। পশ্চিমা দুনিয়ায় দেখা যায়, কখনো কখনো ৯৮ শতাংশ উদ্যোক্তা সফল হতে পারেন না। কিন্তু সেখানে উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ বজায় থাকায় এতে তাদের সমস্যা হয় নাঅ আমাদের দেশেও তেমন ব্যর্থতা থাকতে পারে। কিন্তু, দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, আমাদের দেশে নবীন উদ্যোক্তারা এগিয়েই আসছেন না। কী কারণে এবং এক্ষেত্রে সমস্যা কীভাবে দূর করা যায়, তা নিয়ে কিছু ভাবনা এইখানে শেয়ার করবো।
উদ্যোগ নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের এখানে নতুন উদ্যোক্তাদের মধ্যে কয়েকটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যেমন চীন, ভারত ও থাইল্যান্ড থেকে কোনো পণ্য-আইটেম এনে ট্রেডিং করা, মার্কেটে প্রচলিত কোনো প্রডাক্ট প্যাকেজিং করে সেল করা। একটা মুদির দোকান বা কাপড়ের দোকান বা মনোহরি দোকানের মতো করে ওয়েবে প্রডাক্ট সেল করার জন্য ওয়েবসাইট খোলা। কোনো একটি দক্ষতা অর্জন করে তার ভিত্তিতে সার্ভিস দেয়া, কোনো সার্ভিসের ভ্যালু অ্যাডিশন করা বা কৃষি উৎপাদন করা বা ম্যানুফাকচারিং করা ইত্যাদি।
এর মধ্যে ম্যানুফাকচারিং করাটাকে সবে থেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। কারণ, ম্যানুফাকচারিং অধিক কর্ম সংস্থান করে এবং দেশের মধ্যে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা গড়ে তোলে। এজন্য এখানে আলোচনাটা নতুন প্রডাক্ট ম্যানুফাকচারিংকারী উদ্যোক্তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
আমাদের দেশের ম্যানুফাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি এখনও ম্যাচিউর হয় নাই। সেটা আপনি যেকোনো মার্কেটে গেলেই দেখতে পাবেন। অজস্র বিদেশী প্রডাক্ট। যা আমাদের দেশেই উৎপাদন করা সম্ভব। ইলেক্ট্রিকালের দোকানে গিয়ে দেখবেন— প্লাগ-মাল্টি প্লাগ, লেড ব্যাটারি থেকে শুরু করে প্রায় ৮০ শতাংশ আইটেমই বিদেশী। একটা স্টেশনারি দোকানে যান, সেখানেও দেখবেন, কলম বাদে, রাবার, হাই লাইটার পেন, বোর্ড পিন, স্ট্যাপলার, রুলার, জ্যামিতি বক্স এবং ফাইল কাভারসহ কমপক্ষে ৯০ শতাংশ আইটেমই বিদেশী। শুধু মুদি দোকানে গিয়ে অনেক দেশি পণ্য দেখা যাব। কিন্তু আগোরা, স্বপ্ন বা ভালো মানের সুপার শপগুলোতে গিয়ে দেখা যাবে ৫০ শতাংশ মুদি পণ্যই বিদেশী।
এর মানে আমাদের দেশে ম্যানুফাকচারিং উদ্যোগের সুযোগ আছে। কিন্তু তার পরেও আমরা দেখবো এই সুযোগ থাকলেও বেশ কিছু বাস্তব সমস্যার কারণে উদ্যোক্তারা এই সুযোগটা নিতে পারছেন না।
আচ্ছা আমরা ধরে নিই, আপনি একজন নতুন উদ্যোক্তা। এবং আপনি ঠিক করলেন, আপনি একটা নতুন পণ্য ম্যানুফাকচার করবেনঅ আমরা উদাহরণ হিসেবে ধরে নেই, আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন আপনি প্লাস্টিক ফাইল কাভার বানাবেন। ধরে নিচ্ছি, আপনার কাছে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার সংস্থান বা বিনিয়োগের সুযোগ আছে। একটু ব্যাখ্যা করি, এই আলোচনায় কেন আমি ৫০ লাখ থেকে ৬০ লাখ টাকাকে বেঞ্ছমার্ক ধরলাম। কারণ এই আলোচনা এসএমই নিয়ে আলোচনা। এবং, আমাদের দেশে ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রির হিসেবে ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা নেট ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্টকে এসএমই হিসেবে ধরে নেয়া হয়। এটা মাথায় রেখেই আমি ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার একটা ফিগারে নিয়ে আলোচনা করছি।
আপনি এখন আলিবাবাতে (alibaba.com মেশিনারিজসহ সকল বিজনেস টু বিজনেস আইটেম কেনা বেচার জন্যে দুনিয়াব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয় সাইট) দেখলেন, এই প্লাস্টিক ফাইল কাভার বানাতে যেই মেশিনারিজ লাগছে সেগুলো আপনি আলিবাবার মাধ্যমে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকায় কিনতে পারবেন।
আপনি চিন্তা করলেন, ওয়াও দারুণ। মেশিনের দাম পাইলাম আলিবাবাতে ৩০ লাখ, আমার আছে ৬০ লাখ। তাহলেতো আমি প্রোডাক্টটা নামিয়ে দিতে পারি। এই বলে আপনি ঝাঁপ দিলেন। এরপর যা হবার তাই হল। এমনভাবে আটকালেন যে আর বেরই হতে পারলেন না।
যাক আপনার প্রথম সমস্যা হলো আপনাকে মেশিন আমদানি করতে হবে। কিন্তু, আপনার আমদানি লাইসেন্স নাই। সেক্ষেত্রে চিন্তা করলেন, এটা নিজে কেন করবো, বাংলাদেশে যারা মেশিনারিজ সেল করে তাদের কাছে যাই। আপনি সেই সব চাইনিজ মেশিনারিজ ট্রেডারদের কাছে গেলেন। ওদের কাছে গিয়ে দেখলেন, আলিবাবাতে আপনি যেই প্রাইস দেখেছেন, ইনাদের কাছে প্রাইস প্রায় ডবল বা ৭০% , ৮০% বেশি। আপনার মাথায় হাত।
এই পর্যায়ে আপনার মেশিনের খরচ পড়লো ৫০ লাখ টাকা। এবার আপনি চিন্তা করলেন, আমি নিজেই ইম্পোরট করবো। এদের কাছে যাবো না।
আপনি যদি নিজে আনতে যান, তাহলে দেখবেন, এই প্রাইজের সঙ্গে ডিউটি বার শুল্ক আছে। ডিউটির সঙ্গে আছে ভ্যাট, অ্যাডভান্সড ইনকাম ট্যাক্স, সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি, রেগুলাটেরি ডিউটি, অ্যাডভান্সড ট্রেড-ভ্যাট ইত্যাদি নানান রকম ভ্যাট। সঙ্গে আপনার শিপিং বা পরিবহন খরচ তো আছেই। ফলে ঘুরে ফিরে ক্যাপিটাল মেসিনারিজের জন্যে আপনার প্রায় ৫০% থেকে ৬০% খরচ যোগ হবে। তখন আপনি চিন্তা করবেন, লোকাল পার্টিই ভালো। সমস্যা হইলে এদেরকে ধরতে পারবেন। সেও আপনাকে বোঝাবে ভাই, আমি তো আন্ডার ইনভয়েস করি। কাগজে-কলমে কোনো প্রমাণ রাখি না। ট্যাক্স না দিয়ে সারতে এভাবেই আমি করি। তো এটাতো আপনি পারবেন না। আর আমার কোয়ালিটি ভালো, আপনি দেখে কিনবেন। আমি আফটার সেলস সাপোর্ট দিব।
এখন আপনার আলিবাবাতে ৩০ লাখ টাকার জিনিস, আপনি তার কাছ থেকে সেটা কিনবেন কমপক্ষে ৫০ লাখে। এই ৬০ লাখ টাকার মধ্যে আপনার ৫০ লাখ শেষ। কিন্তু, আপনি দম হারালেন না, ঠিক করলেন এর শেষ দেখে ছাড়বেন।
এরপর আপনার ফ্যাক্টরি ঠিক করতে গেলেন। দেখলেন মেশিন বসাতে থ্রি ফেজ মেশিনসহ একটা জায়গা লাগবে। সেটা মাত্র ১০০০ স্কয়ার ফিট জায়গা হলেও হয়। কিন্তু দেখলেন এতে আপনার লেগে যাচ্ছে ৫ থেকে ১০ লাখ অ্যাডভান্স।
আর যদি নিজের জায়গা থাকে তাহলে সেই থ্রি ফেজ লাইন নেয়া থেকে শুরু করে ওয়াটার ইউটিলিটিসহ সব যোগাড় করতে আপনার যাবে ১৫ থেকে ২০ লাখ। আমরা কমিয়ে ধরলাম ১০ লাখ।
পরে আপনার সরকারের কাছ থেকে, লাইসেন্স নিতে হবে প্রায় ১৮ রকম। এইখানে আপনার যদি প্রজেক্ট সেন্সিটিভ হয়, পরিবেশ লাইসেন্স নিতেও আপনার অন্তত ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা লাগবে। এতে আপনার প্রজেক্ট পরিবেশদূষণ করে কি করে না সেইটা অন্য জিনিস। পরিবেশকে আপনার এই টাকা দিতেই হবে। তো, আমরা ধরলাম সরকারের এই ১৮ ধরনের লাইসেন্সে আপনার খরচ যাবে, ২ লাখ। কমিয়ে ধরলাম।
লেখক: প্রাবন্ধিক
বাংলাদেশ সময়: ১১৫৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৪