নভেম্বর মাসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নতুন রূপ নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা তখন সুসংহত, অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত এবং স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য প্রবলভাবে আত্মবিশ্বাসী।
যথারীতি মুক্তিযোদ্ধাদের এই আক্রমণকে অস্বীকার করে দৈনিক সংগ্রাম। তাদের ভাষ্য হচ্ছে, ভারতই আক্রমণ চালিয়েছে। যে কোনো আক্রমণ হলেই তার পিছনে এরা ভারতকে দেখতে পেতো। যদিও ভারতীয়রা তখনও এই যুদ্ধে নিজেদের সম্পৃক্ত করে নি সরাসরি। তারপরেও মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো কৃতিত্ব দিতেই এরা নারাজ ছিলো। একই দিনের প্রথম পাতায় সংগ্রামে 'ভারতের হামলায় গোটা জাতি বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে' শিরোনাম দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হয়। সেখানে লেখা হয়ঃ
"১২ ডিভিশনেরও বেশী ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতীয় সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানকে ঘিরে ফেলে ৪টি ফ্রন্টে আক্রমণ শুরু করেছে। পাকিস্তানের অজেয় সেনাবাহিনী ভারতের এই সর্বাত্মক হামলার যথাযথ মোকাবেলা করতে যাচ্ছেন। এই সাথে এই চরম সংকটের মোকাবেলা করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছেন।
ভারতের এই অঘোষিত আক্রমণের কথা প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে শহরে-বন্দরে গ্রামে-গঞ্জে ঈমানী প্রেরণায় উজ্জীবিত মানুষেরা '৬৫ এর যুদ্ধ কালীন সময়ের মতই গর্জে উঠেছে।
'৬৫ সালের মত এবারও পাকিস্তানের বীর সেনাবাহিনী ও জনগণ মিটিয়ে দেবে ভারতের যুদ্ধের সাধ। লাইলাহা ইল্লাল্ললাহুর অগ্নিশিখায় ভস্মীভূত করে তারা আর একবার ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতকে বুঝিয়ে দেবে তারা কোন জাতির বিরুদ্ধে লড়তে এসেছে। "
দেশের উপরে ভারতীয় আক্রমণ হয়েছে। এমন অবস্থায় গোলাম আযম নিশ্চুপ বসে থাকতে পারে না। তাই, সে জানায় যে আত্মরক্ষার জন্য আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করতে হবে। ২৪ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রামে গোলাম আযমের বক্তব্য এভাবে আসে।
"একটি মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে চাইলে পাকিস্তানের পক্ষে আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। পূর্ব পাকিস্তানের শান্তি রক্ষার উদ্দেশে সকল দেশপ্রেমিক শান্তি কমিটির সদস্য এবং রেজাকারদের উন্নত্মানের ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত করার জন্য অধ্যাপক গোলাম আযম দাবী জানান। "
পাক ভূমিতে সাম্রাজ্যবাদী ভারতের ঘৃণ্য হামলার প্রতিবাদে নিন্দা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ঢাকা শহরে কিলিং গ্রুপ আল বদরের উদোগে ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল আয়োজন করা হয়। মিছিলটা বায়তুল মোকাররম থেকে শুরু হয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে।
জামায়াতের আব্বাস আলী খান ভারতীয় হামলা প্রতিহত করার জন্য দেহের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে দেবার আহ্বান জানান সকলকে। ২৬ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রাম তা প্রকাশ করে।
"ভারতীয় হামলা মোকাবেলায় দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ইসলাম ও পাকিস্তানের জন্য দেহের শেষ রক্ত বিন্দু পর্যন্ত বিসর্জন দেবার জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান।
এতে আর কোনো সন্দেহ নেই যে তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর ছদ্মাবরণে পূর্ব পাকিস্তানকে গ্রাস করার হীন মতলবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কতিপয় ফ্রন্ট নির্লজ্জ হামলা শুরু করেছে। এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে নিজেদের সকল ভেদাভেদ বিসর্জন দিয়ে ভারতের এ হামলার মোকাবেলায় আমাদের ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষায় এগিয়ে আসা একান্ত কর্তব্য। "
মুক্তিযোদ্ধাদের এই সাঁড়াশি আক্রমণে জেহাদ ফরজ হয়ে গেছে বলে ফতোয়া দেয় জামায়াতের ধর্মীয় গুরু মওদুদী। তিনি বলেন, "গত কিছুদিন থেকে হিন্দুস্তানী সৈন্যরা পাকিস্তানের উপর আক্রমণ চালিয়ে আসছে। তারা আমাদের ভূখণ্ডের বিভিন্ন এলাকায় আক্রমণ চালাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে কোরআন আমাদের এ সত্য সম্পর্কে অবহিত করে যে, সংখ্যাধিক্য বা সাজসরঞ্জামের প্রাচুর্যের দ্বারা মুসলমানদের শক্তির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় না বরং সত্যের উপর দৃঢ়তা এবং দৃঢ়তার উপর পূর্ণ আস্থার দ্বারাই নির্ধারণ করা হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, তোমাদের মধ্য থেকে ২০ জন যদি ধৈর্যশীল হয় তবে তারা দশ জনের উপর জয়লাভ করবে আর যদি তোমাদের মধ্য থেকে ১০০ জন ধৈর্যশীল হয় তবে তারা এক হাজার জনের উপর জয়লাভ করবে। "
বাংলাদেশ বাহিনীর এই আক্রমণকে এদেশের মুসলমানদের ঈমানের উপরে হামলা বলে ঘোষণা দেন গোলাম আযম। এর পালটা হিসেবে আসাম, পশ্চিম বঙ্গ এবং কাশ্মীর দখল করে সেগুলোকে পাকিস্তানের অংশ করে নেবার হুমকি দেন তিনি। নভেম্বরের ৩০ তারিখে গোলাম আযমের এই সদর্ভ উক্তি প্রকাশিত হয়।
"ঢাকা শহর জামাতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম ঘোষণা করেন যে, ভারত পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তে নয় বরং এদেশের মুসলমানদের ঈমানের উপর হামলা চালিয়েছে। তিনি বলেন, মুসলমান কখনো পরাজিত হয় না, তারা শহীদ অথবা বিজয়ী হয়ে গাজী হয়।
জামায়াত নেতা বলেন, ভারতীয় হামলার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমানরা যে ঐক্যবদ্ধ আজকের মিছিল তারই প্রমাণ। তিনি বলেন, আমাদের মানচিত্র অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। হানাদার শত্রুকে নির্মূল করে আসাম, পশ্চিম বানগ্লা, কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে আমরা এই মানচিত্র পূর্ণ করে ছাড়বো। "
জামায়াত নেতাদের এসব প্রলাপ থেকে বুঝতে পারা যায় যে, কী প্রতাপে তখন মুক্তিবাহিনী তথা বাংলাদেশ বাহিনী আক্রমণে ঝাঁপিয়েছিলো। শীত শেষ হবার আগেই দেশ স্বাধীনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলো তাঁরা। আমাদের সেই সব গৌরবগাথাকে সবসময়ই অস্বীকার করেছে এই সব বরাহ শাবকেরা। সবকিছুর পেছনে তারা ভারতকে দেখেছে, ভারতকে আবিষ্কার করেছে। বুঝেও, না বোঝার ভান করেছে।
গ্রামাঞ্চলে এক সময় কুলবধূরা লজ্জায় ভাসুরের নাম মুখে নিতো না। ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে যে, মুক্তিযোদ্ধারাও জামায়াতের কাছে ভাসুরই ছিলো। তাই, ভাসুরের নাম কিছুতেই মুখে নিতো না তারা। ভাসুরের বদলে ভারতই ছিলো তাদের কাছে অধিকতর প্রিয়। তাই, সবকিছুতেই ভারতকে টেনে আনতো তারা। যদিও খুব ভাল করেই জানতো যে, তাদের রাতের ঘুম, দিনের আরাম সব নষ্ট করে দিচ্ছে ওই মুক্তি সেনারই দল।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৪