এ কথা আমরা সবাই জানি যে, বর্তমানে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা চালু রাখার অন্যতম এবং প্রধানতম উৎস। যদি বলা হয় বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল রাখতে প্রবাসীদের কষ্টে উপার্জিত টাকার ভূমিকা অনেক তাহলে কিন্তু তা কোনোভাবেই বাড়িয়ে বলা হবে না।
আনন্দের এ কারণেই যে, বাঙালিকে ঘরকুনো বলে একসময় অপবাদ দেওয়া হতো সেই বাঙালি আজ ঘর থেকে বের হয়েছে। গোটা পৃথিবীকে নিজেদের মুঠোয় নিয়ে বাঙালি আজ সম্মানের সঙ্গে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রবাসীদের কষ্টের টাকায় বাংলাদেশ মোটা অংকের বৈদেশিক মুদ্রা গুণছে। বাংলার গ্রামেগঞ্জে সর্বত্রই এখন ডলার, পাউন্ড, দিনার, রিয়াল ইত্যাদির জয় ডংকা বাজছে। কিন্তু কথা হলো, এই আনন্দ উল্লাসের পেছনের যিনি মহান কারিগর সেই হতভাগা প্রবাসীটিকে নিয়ে কজন ভাবছে? সেই প্রবাসীটি সত্যি কেমন আছেন?
আমেরিকা থেকে বাংলাদেশ যাওয়া-আশার পথে প্রতি বছরই দেখি সেই একই চিত্র। ঢাকা বিমান বন্দরে কাস্টমসের বিশাল লম্বা লাইন। সেখানে কিছু মানুষ কাস্টম চেকিং এর নামে বিভিন্নভাবে প্রবাসীদের হয়রানি করছে। সব দিক বিবেচনা করে বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে, একজন প্রবাসী এভাবে নাজেহাল হবেন এ যেন খুবই এক স্বাভাবিক বিষয়। আর আমরা এই প্রবাসীরাও কিন্তু এই অলিখিত নিয়ম কানুনগুলোকে খুব সহজ আর স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়ে আমাদের পথ রচনা করছি। কে জানে, হয়তো আমাদের এই উটকো ঝামেলা মেনে না নিয়ে দ্বিতীয় আর কোনো উপায়ও হয়তো নেই। কেননা আপনিই বলুন, কার ঘাড়ে কটা মাথা? না, কাস্টমসের বিরুদ্ধে বা সরকারের অনাচারের বিরুদ্ধে প্রবাসীরা টু শব্দটি করতে পারেন না? যদিও এর জন্য প্রবাসী মন্ত্রণালয় রয়েছে, এটা রয়েছে ওটা রয়েছে কিন্তু এসব শুধু নাম সর্বস্ব। প্রবাসীদের ভালো সৎ কোনো বন্ধু নেই। সত্যি বলতে এর সবচেয়ে নিরীহ শিকার হয়ে থাকেন আমাদের মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসী ভাইবোনেরা। কাস্টম চেকিংয়ের সময় এরা অনেকেই ভালোভাবে কথা বলতে পারেন না, শহুরে চটকদার ভাষায় কাস্টমস-এ দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারদের সঙ্গে কথার মারপ্যাচ জানেন না বা নিজেদের তক্কে জড়াতে পারেন না। আর সমস্যাটা হয় সেখানেই। তাদের একমাত্র অপরাধ হলো তারা প্রবাসী। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভাসমানদের মতো এরা নিজ ভাগ্যের অনুসন্ধানে ব্যাতিব্যস্ত। এরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে নিজের নামের আগে ‘প্রবাসী’ তকমা এঁটে এই মানুষগুলো ছড়িয়ে পড়েছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে।
প্রতি বছরই যখন বাংলাদেশ ভ্রমণ করি ততোবারই আমি নিজের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই এই বলে যে, প্রবাসীদেরকে নিয়ে সত্যিই কিছু লেখা উচিৎ। কিন্তু কথা হলো, লিখে কি হবে? যে প্রবাসী তার নিজের জীবন হাতের তালুতে নিয়ে জীবন বাজি রেখে অর্থ উপার্জন করছেন এবং সেই অর্থ দেশে পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন সেই প্রবাসীটি যখন তার প্রিয় দেশে ঘুরতে আসেন তখন এই ‘প্রবাসী’ নামক প্রজাতিটি তাদের নিজ দেশে কতোটুকু যে সম্মানিত হচ্ছেন সে খবর আমরা সবাই জানি।
নিউইয়র্ক জেএফকে থেকে কুয়েত তারপর কুয়েত থেকে ঢাকা। এই হলো আমার যাত্রাপথ। কুয়েতে নেমেই বিমান পাল্টাতে হবে। তাই এই মাঝ পথে জিরায়ে নেয়ার জন্য এক লম্বা সময়ের জন্য যাত্রাবিরতি করতে হয়। তখনই পরিচয় হলো, কুয়েত বিমান বন্দর এর ক্লিনিং এন্ড সেনিটারি বিভাগে কর্মরত আমাদের বাংলাদেশের ছেলে সোলায়মান এর সঙ্গে। বয়স বাইশ-তেইশ হবে। প্রাণবন্ত। প্রতিদিন ১২ ঘণ্ট করে কাজ করেন এখানে। সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তার কাজের সময়। প্রতি মাসে রোজগার করেন বাংলাদেশের টাকায় দশ হাজার টাকা। জানালেন ৬ বছর যাবৎ তিনি আছেন কুয়েতে। এক লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করে তিনি এসেছিলেন এখানে। ভালো খবর যে, মধ্যপ্রাচ্যে আসার টাকাটা তার উঠে গেছে। এই কিছুদিন আগে মাকে নাকি একটা দামি সেলফোন সেট কিনে দিয়েছিলেন। এখন বাংলাদেশে যাবেন বিয়ে করতে। কিন্তু সোলায়মান কি সুখে আছেন? প্রতিদিন হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম। গাদাগাদি করে একটা বাসায় অনেকগুলো মানুষের কোনো রকমের বসবাস। এর কারণও একটাই। পয়সাটা সেভ হবে। আর সেই জমানো টাকাটা দেশে পাঠাতে পারবেন। সেই টাকায় হয়তো একটা বাড়ি হবে, একটা ছোট্ট জমি কেনা হবে, একটা ব্যবসা হবে অথবা ছোট বোনটার বিয়ে হবে। কিন্তু সোলায়মানের আর নিজের বিয়ে করা হয়ে ওঠে না। সোলায়মান জানালো, তার বিয়ে করতে কমপক্ষে এক লক্ষ টাকা খরচ হবে। কিন্তু এতো টাকা তার জমানো নেই। তাই আরো বছর দুয়েক পরে সে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে বলে ঠিক করেছে। এই সোলায়মানরাই কিন্তু একেকটা বাংলাদেশের পতাকা, একটা মানচিত্র।
এবার কুয়েত থেকে ঢাকার বিমানে ওঠার পালা। সাধারণত যা হয় তখন আমাদের মধ্যপ্রাচ্যের প্রচুর প্রবাসী দিয়ে বিমানটি চোখের পলকেই ভরে যায়। তখন আমেরিকান বাংলাদেশি প্রবাসীরা গোটা বিমানে সংখ্যালঘু হয়ে পড়েন। বিমানটি বাংলাদেশের মাটি ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘটতে থাকে যতো সব লংকা কাণ্ড! দেখা গেলো কুয়েত থেকে এসেছেন এক প্রবাসী ভদ্রলোক বিমান এর ‘অবতরণ কার্ডটি’ পূরণ করতে রীতিমতো হিমশিম খাছছেন। কি আশ্চর্য, তাকে সহযোগিতার জন্য সেখানে প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের কাউকেই দেখতে পেলাম না। উল্টো, সেখানে নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত এক কর্মী বার বার সেই ভদ্রলোককে ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়াতে তাড়া দিচ্ছিলেন। ইমিগ্রেশন অফিসারগুলো সবাই বিরক্তভরা বাঁকা চোখে এই প্রবাসীদের দিকে তাকাচ্ছিলেন। ভাবখানা এই যে, এই জঞ্জালগুলো আবার কোথ্বেকে এল? কেউ কেউ এই সহজ সরল প্রবাসীদের পকেট থেকে কিভাবে দুটো পয়সা হাতিয়ে নেওয়া যায় সেই ধান্দায় ইতিউতি ঘোরাফেরায় ব্যস্ত।
এই হলো একজন প্রবাসী হওয়ার চরম খেসারতের গল্প। নিজ প্রিয় ভূমিটাকে ফেলে এসে এক অজানা শহরের ঠিকানায় বাসা বাঁধেন এই প্রবাসীরা। গায়ের রক্ত ঢেলে তিনি প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকেন তার পরিবার পরিজন, সমাজ আর দেশের জন্য সুখের ফুলটি ফোটাতে। কিন্তু কুজন সেই ফুলটি নিজের জন্য ফোটাতে পারেন? তারপরও প্রতিনিয়ত সংগ্রাম চলে জীবনের সঙ্গে। সমস্ত বাধা, ভয়, ভীতি ও মৃত্যুকে জয় করে প্রবাসীরা এগিয়ে যান সামনের দিকে তাদের সোনালী স্বপ্নের ডানায় ভর করে। এই যাত্রাপথের কোনো শেষ নেই। কবে একজন প্রবাসী তার নিজ প্রাপ্যটুকু ঠিকঠাক বুঝে পাবেন?
লেখক: প্রাবন্ধিক
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০১৪