ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

উচ্চশিক্ষায় ভর্তি সংকট ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৫
উচ্চশিক্ষায় ভর্তি সংকট ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’ পৃথিবীজুড়ে সর্বজন স্বীকৃত বাণী। অর্থাৎ শিক্ষায় যে জাতি যত বেশি উন্নত, সে জাতি অন্যান্য সব ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি লাভ করতে সক্ষম।

সেই রোমান সভ্যতা থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক বিশ্বেও এই প্রতিযোগিতায় এগিয়ে ইউরোপীয়রা। ফলে তাদের উন্নতির কথা আমাদের সবারই জানা।

আমরা প্রায় দু’শ বছর ব্রিটিশ গোলামী এবং দুই যুগ পাকিস্তানি গোলামী থেকে স্বাধীন হয়েছি। দেশ স্বাধীনের ৪৩ বছর পরও আমরা কি আমাদের মেরুদণ্ড শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে পেরেছি? এ জন্য যে ধরনের মাস্টারপ্ল্যান ও সুনির্দিষ্ট নীতি থাকা প্রয়োজন, আমরা কি সেটা করতে পেরেছি? বলা যায়, এসব কিছুর কোনোটাই নেই আমাদের। যখন যে সরকার ক্ষমতাসীন হয়, তারা জাতি গঠনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে নিয়ে নিজেদের মতো করে চিন্তা করে এবং তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। এতে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।

আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সস্তা বাহবা নিতে শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করছেন। জানিনা আমাদের শিক্ষামন্ত্রী নিজেকে কী মনে করেন! তবে আমাদের শিক্ষা সেক্টরের এমন কোনো বিষয় নেই যেখানে তিনি হাত দেননি।   কী প্রাথমিক, কী মাধ্যমিক, কী উচ্চশিক্ষা। সবখানেই তার ‘পবিত্র পারদর্শী’ হাতের ছোঁয়ায় আজ শিক্ষা সেক্টরে ব্যাপক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। আর সে অস্থিরতা এখন সমাজের সর্বক্ষেত্রেই ছড়িয়েছে। এর ফলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে গোটা জাতি আজ চরম উদ্বিগ্ন। এমনকি শিক্ষার্থীরা নিজেরাও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম হতাশায় পড়েছেন।

উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু সাম্প্রতিককালে শিক্ষা সেক্টরে অস্থিরতার পেছনে অন্যতম কারণ হলো- কর্তৃত্ব বলে কোনো ব্যক্তির একক চিন্তা-চেতনাকে গোটা জাতির উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। নতুন কোনো কিছু জাতির ঘাড়ে চাপাতে হলে সমাজের অংশীদার জ্ঞানী-গুণীজনদের সঙ্গেও পরামর্শের দরকার রয়েছে সেটা হয়তো আমাদের বিজ্ঞ শিক্ষামন্ত্রী প্রয়োজনবোধ করেন না।   আর সেই কারণেই তিনি যখন যা মনে করেন - সে আলোকেই সকাল-বিকেল সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের শিক্ষা সেক্টরকে অস্থির করে তুলেছেন। বিজ্ঞ শিক্ষামন্ত্রীর নতুন নতুন সিদ্ধান্তে শিক্ষক-শিক্ষার্থী নিজেরাও বুঝতে পারছেন না- তারা কী শিখাচ্ছেন আর কী শিখছেন। ফলে আজ গোটা শিক্ষাব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।

থাক এসব কথা, আজকের মূল আলোচ্য বিষয়ে প্রতি ফিরে আসি।

গত ৩১ ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় হঠাৎ করেই এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তির নির্দেশনাপত্র জারি করে। তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখে নির্দেশনা জারির এক দিনের মাথায় (১ জানুয়ারি) মন্ত্রণালয় ওই নির্দেশনাপত্র স্থগিত করে।  

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ৩১ ডিসেম্বর বিদ্যমান ভর্তি পরীক্ষার পরিবর্তে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তির কার্যক্রম সম্পন্ন করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে এই চিঠি পাঠানো হয়।

চিঠিতে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত ভর্তি পরীক্ষার পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয় এবং দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। এ অবস্থায় এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তির কার্যক্রম সম্পন্ন করা হলে শিক্ষার্থীদের সেশন শুরু ত্বরান্বিত হবে এবং অভিভাবকদের হয়রানি লাঘব হবে।

মন্ত্রণালয়ের এই চিঠির ভিত্তিতে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ‘জাতির মেরুদণ্ডে যা একটু জোর ছিল, তাও নিঃশেষ করার চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হলো এবার। ’ ‘এবার শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের শুধু ষোলকলা নয়, সতেরো কলা পূর্ণ হলো। ’ এভাবেই অনেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

শুধু তাই নয়, বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণের মধ্যেও তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। নাম প্রকাশ না করে একাধিক উপাচার্য প্রতিক্রিয়ায় বলেন, মন্ত্রণালয়ের ওই অনুরোধ রাখতে গেলে শিক্ষার সর্বনাশ হয়ে যাবে। উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণকে নিয়ে একাধিক বৈঠক করেও এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। উপাচার্যগণ ভর্তি পরীক্ষার পক্ষেই মত দেন।

উচ্চশিক্ষায় ভর্তির আসন সংকট
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির এই সংকট নতুন কোনো বিষয় নয়। বছরের পর বছর ধরে চলে এলেও এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। ফলে বহু মেধাবী শিক্ষার্থীকে শিক্ষাজীবনের ধারাবাহিকতাকে অনিশ্চিত করে তোলে বা শিক্ষাজীবনকেই  বিপর্যস্ত করে। রাষ্ট্র কিংবা শিক্ষা নীতিনির্ধারক কর্তাব্যক্তিরা কোনোভাবেই এর দায় এড়াতে পারেন না।

এখন আমরা একটু খতিয়ে দেখার চেষ্টা করি এই সংকট কী পর্যায়ে রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ডের তথ্য মতে, ২০১৪ সালে এইচএসসি পাস করে ৮ লাখ ৮৫ হাজার ৭০ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করে ৭০ হাজার ৬০২ জন। এর সঙ্গে রয়েছে আগের বছরের ভালো ফল অর্জন করা কিন্তু কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি এমন শিক্ষার্থীরাও। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক সম্মান প্রথম বর্ষে ভর্তিকৃত আসন আছে ৫১ হাজারের মতো। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা ছয় হাজার ৫৮২, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯৯৬, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় তিন হাজার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন হাজার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় তিন হাজার, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় এক হাজার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চার হাজার, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হাজার ৫০০, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় দুই হাজার আসন। এদিকে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে তিন হাজার ১৭৬টি আসন রয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সব ক’টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও বুয়েটে ভর্তিযোগ্য আসন আছে ৫৪ হাজারের মতো।

এছাড়া, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় (সরকারি-বেসরকারি) কলেজগুলোতে অনার্সে আসন সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা ৮০ হাজার। বেসরকারি ৬৬টি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে আসন রয়েছে ৬৫০০টি। এখন আমরা সহজেই অংক কষে দেখতে পারি কতজন শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ রয়েছে। আমাদের দেশে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। মোট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৩৭টি। আর ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয় ৩৫টিতে। শিক্ষার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে শিক্ষার্থীরা ততটা আগ্রহী নয়। এছাড়া, সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবছর সেমিস্টার ফি বাড়ানো হচ্ছে। ফলে আর্থিক সামর্থ্য না থাকায় অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে না। একইভাবে বেসরকারি মেডিকেল কলেজেগুলোর অবস্থাও অনেকটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো।

ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও বুয়েটে ভর্তি হতে না পারা বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকে পড়তে হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি ও বেসরকারি কলেজগুলোতে। এসব কলেজে সেশনজট থাকায় চার বছরের কোর্স শেষ করতে সময় লেগে যায় ৬-৭ বছরেরও বেশি। তাই শিক্ষার্থীরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সহজে ভর্তি হতে চায় না। সঙ্গত কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারেই শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেশি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো শিক্ষকমণ্ডলী ছাড়াও শিক্ষার ব্যয় কম এবং সুযোগ-সুবিধাও বেশি।

প্রতি বছর এইচএসসি পরীক্ষার ফল পাওয়ার পর শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির মহারণ চলে। কিন্তু এই যুদ্ধে উত্তীর্ণ হওয়ার স্বীকৃতি পেলেও সবার ভাগ্যে বিজয়ের মাল্য যে জোটে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সীমিত আসনসংখ্যার কারণে এমনকি জিপিএ-৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীর প্রকৌশল, মেডিকেল কিংবা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির স্বপ্ন ভেঙে যায়। এইচএসসিতে পাস করা আট লাখ ৮৫ হাজার ৭০ জনের মধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির স্বীকৃত যোগ্যতার শিক্ষার্থীসংখ্যা সাত লাখের মতো। অথচ আসন সংখ্যা মাত্র ৫৪ হাজার। অর্থাৎ শতকরা ৯৯ জনকে ব্যর্থ মনোরথ হতে হয়।

সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই চাপ কমাতে দেশে বর্তমানে ৭৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম চালালেও গোটা কয়েক ছাড়া বাকিগুলোর মান ও নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। উচ্চ টিউশিন ফির বিষয়টি তো আছেই। ফলে মেধাবী শিক্ষার্থী ও অনেক অভিভাবক সেসব প্রতিষ্ঠান নিয়ে আগ্রহ দেখান না। সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে বটে, কিন্তু সেখানে তাদের শিক্ষার্জন কতটুকু মানসম্মত হচ্ছে কিংবা ভবিষ্যতে পেশাগত ক্ষেত্রে তা কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা পাবে, এ নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।

একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, বহু মেধাবী শিক্ষার্থী যখন ভর্তিবঞ্চিত হয়ে হতাশায় পোড়ে, তখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন বিভাগে আসন খালি থাকার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এটি ভর্তি ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা ও প্রশাসনিক আন্তরিকতার অভাব ছাড়া আর কিছুই নয়।   এসব শূন্য আসন পূরণের ব্যবস্থা রেখে ভর্তি নীতিমালা করা বাঞ্ছনীয়। আর প্রশ্নপত্র ফাঁস কিংবা ভর্তি কার্যক্রমে অনিয়মের খবর প্রায়ই শোনা যায়, এটি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।  

প্রতি বছর এএইচসি পরীক্ষা ফল প্রকাশের পরপরই আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়- উচ্চশিক্ষার আসন সংকট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ভর্তিতে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না। অথচ মন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বর্তমানে শিক্ষার্থীর তুলনায় উচ্চশিক্ষায় আসন সংখ্যা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। ফলে মানবসম্পদ তৈরির ফলাফলও অনাকাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে। ‘সারা অঙ্গে ব্যথা/ওষুধ দেবো কোথা’- গ্রাম বাংলার বহুল প্রচলিত এ প্রবাদের মতোই আমাদের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা যেখানে সংকটময়, সেখানে উচ্চশিক্ষায় ভর্তির বিষয়টিও তা থেকে মুক্ত নয়।

ফলে এই সংকট থেকে সম্ভাব্য উত্তরণের বিষয়ে আমার কিছু মতামত নিম্নে তুলে ধরলাম, যদিও সচেতন পাঠক সমাজ বা দেশের শিক্ষাবিদ ও নীতিনির্ধারণের সঙ্গে জড়িত সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ আমার সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন।

প্রথমত: উচ্চশিক্ষার আসন সংকট নিরসনের সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও কেন এই সংকট নিরসন করা যাচ্ছে না এসব বিষয়ে এবং এর একটা স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকদের নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে    ‘ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত’ বিষয়ে একটি সংলাপ কিংবা সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করা যেতে পারে। আর তাদের পরামর্শের ভিত্তিতেই এর ব্যবস্থাপনা ঠিক করা যেতে পারে। তবেই একটা ভালো ফলাফল প্রত্যাশা করা যায়। অন্যথা মস্তিষ্ক থেকে উদ্ভব একক আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত চাপানোর চেষ্টা করা হলে এই সংকট আরও তীব্র হতে পারে।

দ্বিতীয়ত: সার্বিকভাবে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ২০১০ সালে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের পর জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর কথা থাকলেও বাস্তবে তা কমেছে। বর্তমানে আমাদের জাতীয় আয়ের (জিডিপি) মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করা হয়। দেশ স্বাধীনের পর ২০০৭-০৮ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বাজেটে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ ৬ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। সাম্প্রতিককালের সর্বোচ্চ বরাদ্দ ছিল ২০১০-১১ অর্থবছরে ১৪ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু এরপর থেকে টাকার অঙ্ক বাড়লেও মোট বার্ষিক বাজেটের হারে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এসে তা দাঁড়িয়েছে মোট বাজেটের মাত্র ১১ দশমিক ৬০ ভাগ।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে একটি দেশের শিক্ষা খাতে মোট জাতীয় আয়ের ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দকে আদর্শ হিসেবে ধরা হয়, যা ২০০০ সালে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের সম্মতিতে স্বাক্ষরিত ‘ডাকার ঘোষণা’য়ও এ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ জাতীয় আয়ের আড়াই শতাংশের সামান্য বেশি, অর্থাৎ বাজেটের ১১ দশমিক ৬ শতাংশ, যা আফ্রিকার অনেক দরিদ্র দেশের চেয়েও কম। এছাড়া, বাংলাদেশের শিক্ষা খাত নিয়ে বিশ্বব্যাংকের পর্যালোচনা প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বা বরাদ্দে যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, উন্নয়নশীল দেশগুলো শিক্ষা খাতে গড়ে বাজেটের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ বরাদ্দ রেখেছে। আগামী ১০ বছরে উদীয়মান অর্থনীতিতে পরিণত হতে হলে বাংলাদেশকে মাধ্যমিক, কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

ফলে শিক্ষাখাতে ব্যয় জাতীয় আয়ের (জিডিপি) ২ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে এবং জাতীয় বাজেটের বরাদ্দ ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। আর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উচ্চ শিক্ষায় অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় বাড়াতে হবে।

উল্লেখ্য, জাতীয় উন্নয়নের জন্য মানবসম্পদ উন্নয়নে উচ্চ শিক্ষা অতীব গুরুত্বপূর্ণ হলেও আমাদের শিক্ষাখাতের বরাদ্দের সিকি অংশও অবকাঠামোগত তথা শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যয় করা হয় না। আর যতটুকুই বরাদ্দ দেয়া হয় তার সিংহভাগ দুর্নীতির রাহুগ্রাসে বিলীন হয়ে যায়। ফলে আমাদের সংকট থেকেই যাচ্ছে। তাই উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি কঠোর হস্তে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।

তৃতীয়ত: দেশজুড়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ১৯৯টি কলেজে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণীর কার্যক্রম রয়েছে। কিছু কলেজে স্নাতকোত্তর রয়েছে। এসব কলেজ থেকে অবকাঠামো সুবিধাসংবলিত প্রতিষ্ঠানগুলো বাছাই করে যে সব জেলায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি, সেসব এলাকায় কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা যেতে পারে। এতেও ভর্তি-সংকটের কিছুটা সুরাহা হতে পারে।

চতুর্থত: উচ্চশিক্ষায় ভর্তি-সংকট কাটানোর জন্য আশু সমাধান হিসেবে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ মানসম্মত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আসনসংখ্যা বাড়ানো দরকার। মান সম্মত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুই শিফটও চালু করা যেতে পারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাতে মেধাবী শিক্ষার্থীরা আকৃষ্ট হয়, সেজন্য ওই সব প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম দূর ও শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারের কড়া নজরদারি প্রয়োজন। এছাড়া, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় চিকিৎসা বিদ্যা, কৃষি, নার্সিং এবং প্রকৌশল বিদ্যা চালু করা যেতে পারে।

পঞ্চমত: বর্তমানে এইচএসসি উত্তীর্ণদের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদাভাবে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হতে হয়। । সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য একটি সমন্বিত পরীক্ষা নেওয়ার উদ্যোগ এর আগে নেওয়া হলেও তা সফল হয়নি। তবে সময়ের বিবর্তনে এবং প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে এই ধরনের ভর্তি প্রক্রিয়া পুনরায় গ্রহণ করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গ্রেডিং স্কেলে এনে মেডিকেল কলেজের ভর্তির মতো পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এর ফলে প্রতিবছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে যে তুঘলকি কাণ্ড ঘটে তা কিছুটা নিবারণ হবে। এতে প্রতিবছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রক্রিয়াগত কারণে যে বিপুলসংখ্যক আসন শূন্য থাকে তা বন্ধ হবে এবং শিক্ষার্থী ভর্তি প্রক্রিয়াও সহজ হবে।

ষষ্ঠত: শিক্ষা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত মানহীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তির ক্ষেত্রেও একটা নীতিমালার আওতায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে সেশন ও টিউশন ফি নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের নাগালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।  

সপ্তমত: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী উচ্চশিক্ষায় ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষে মত দিয়ে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তির যে উদ্যোগের কথা বলেছেন তা কার্যকর করা হলে উচ্চশিক্ষায় বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। কারণ, গত কয়েক বছর থেকে আমাদের দেশে হাইব্রিডের ফলনের মতো জিপিএ-৫ এর যে বাম্পার ফলন হচ্ছে, তাতে ভর্তি পরীক্ষা ব্যবস্থা না থাকলে উচ্চশিক্ষায় অমেধাবীদের প্রাধান্য বেড়ে যেতে পারে। ফলে ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি বহাল রেখেই উচ্চশিক্ষার এই সংকট নিরসন করতে হবে।

সবশেষে বলবো, যেহেতু মানবসম্পদ উন্নয়নে উচ্চশিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। সেহেতু মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিয়ে সবাইকে নতুন করে ভাবতে হবে। এই সমস্যাকে সবোর্চ্চ গুরুত্বারোপ করে সমাধানে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সঙ্গে শিক্ষাখাতের দুর্নীতি বন্ধ ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি শিক্ষাখাতের বাজেটের বড় অংশ অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় করতে হবে। তবেই জাতির জন্য একটা কাঙ্ক্ষিত ফল বয়ে আনতে পারে বলে আশা করা যায়। অন্যথায় ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।

তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারণের সঙ্গে জড়িতদের প্রতি আহবান রাখবো, অগ্রসরমান বিশ্বায়নের নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এবং জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি এবং এর মানোন্নয়নে যথাসম্ভব কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।

লেখক: শিক্ষা ও সমাজবিষয়ক গবেষক
ই-মেইল: sarderanis@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ০১৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।