হরতাল দেয়া খুব সহজ হয়ে গেছে। মন চাইলে পত্রিকা অফিসে একটি বিবৃতি পাঠিয়ে দিলে হরতাল হয়ে গেল।
হরতাল বন্ধ করার উপায় কী? আমাদের সিস্টেমের মধ্যে একটা ফুটো রয়েছে। ফুটো দিয়ে হরতাল আসছে। হরতাল ঘোষণা হচ্ছে। পালন হচ্ছে ফুটোর ভেতর। ফুটোর নাম 'মিডিয়া'। মিডিয়ায় যদি কোনোভাবে হরতাল ঘোষণা সংক্রান্ত সংবাদ প্রচার না করে। তবে দেশে হরতাল হবে না।
মাসের পর মাস কাপুরুষ এর মত অজ্ঞাত স্থান থেকে ইমেইলে হরতাল আহবান করছে বিএনপি। অত:পর সেই ঘোষণা প্রচার করে মিডিয়া হরতাল পালনে কার্যত বিএনপি বা জামায়াতকে সাহায্য করছে। এসব সংবাদের ভিত্তি প্রায়ই হয়ে থাকে একটি ইমেইল বা একটি বিবৃতি। সংবাদ মাধ্যম বেশীরভাগ সময় যাচাই না করেই এসব বিবৃতি প্রচার করছে। আমার মনে হয়, এই হরতাল বন্ধ করার উপায় হচ্ছে মিডিয়ায় এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রচার বন্ধ করে দেয়া। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।
কিছুদিন আগে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু গণমাধ্যম সম্পাদকদের বৈঠকে এমন কিছু কথা বলেছিলেন। অমনি হইহই রব ঊঠল, তাদের শাসানো হচ্ছে, গণমাধ্যমের উপর হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। অথচ গণমাধ্যমও সবসময় রাষ্ট্রের প্রতি শতভাগ নৈতিক দায়িত্ব পালন করছে না। হুজুগে বা বেখেয়ালে বা অপরিপক্কতায় তারা শতভাগ নৈতিকতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। এটা বলতে বাধা নাই যে, এই সহিংসতায় গণমাধ্যমের দায় কম নয়।
গণমাধ্যমের উচিত কোথায় ঠাণ্ডা কফি খেতে খেতে, বসে, নিজেদের দায়িত্ব এবং কর্তব্যগুলো স্মরণ করা। দেশের স্থিতিশীলতার দিকে তাকিয়ে "ইমেইল হরতাল' এর সংবাদ প্রচার আর করব না বলে গণমাধ্যম সম্পাদকরা একমত হলে দেশ ও জাতির কিছুটা দুর্ভোগ কমে যেত। যদি কোন দল বা দলের নেতা আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে সশরীরে এসে ব্রিফিং করে হরতাল দেয় তবেই সে সংবাদ প্রচার করবেন মর্মে একাট্টা হওয়া উচিত।
যদি কোন সম্পাদক মনে করেন, এই লেখা পড়ে শতভাগ নৈতিক হয়ে যাবেন সেটাও সম্ভব নয়। কারণ অসুস্থ প্রতিযোগিতা। কোন সম্পাদক চাইলেও সম্ভবত পারবেন না। তার প্রতিযোগীরা যতক্ষণ শুদ্ধ না হন। তবে একটা পথ আছে। সেটা হল তথ্য মন্ত্রণালয়। তথ্য মন্ত্রণালয় ইচ্ছে করলে রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা এড়াতে সাময়িকভাবে কোন সংবাদ প্রচারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। বিশেষ করে অজ্ঞাত স্থান থেকে আল কায়েদার মতো ভিডিওবার্তা বা ইমেইল পাঠিয়ে হরতাল আহবান এর সংবাদ প্রচার না করার জন্য আদেশ দিতে পারেন। টিভি, প্রিন্ট অনলাইন, ফেসবুক বা ব্লগে হরতালের ঘোষণা সংক্রান্ত সংবাদ প্রচারে নিষেধাজ্ঞার এখতিয়ার সরকারের আছে। গণমাধ্যম নীতিমালার ১৩(গ) অনুসারে এ সংক্রান্ত কোন আদেশ পত্রিকাগুলোকে মানতে হবে।
হরতালের ঘোষণা প্রকাশে গণমাধ্যমের আক্কেলজ্ঞানহীন ভূমিকায় তথ্য মন্ত্রণালয়ের এতটুকু ভূমিকা কমপক্ষে নেওয়া উচিত। অন্তত একমাসের জন্য এমন একটি নির্দেশনা পরীক্ষামূলক আরোপ করা যেতে পারে। যেচে গিয়ে তথ্যমন্ত্রীকে এমন একটি পরামর্শ দেয়া উচিত। (সেটাও অবশ্যি বলার দরকার নেই। তথ্যমন্ত্রী নিয়মিত অনলাইন পত্রিকা পড়েন। সুযোগ পেলে ভালো লাগাও প্রকাশ করেন। একটি অভিজ্ঞতা থেকে এটা জানি। তিনি নিশ্চয়ই এটা দেখবেন। )
সত্যি যদি এমন কিছু হয়, মানে অন্তত একমাসের জন্য অজ্ঞাত স্থান থেকে হরতালের ঘোষণার সংবাদ প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, গণমাধ্যমের উপর হস্তক্ষেপ হচ্ছে বলে কেউ যে চেঁচাবেন না তা কিন্তু নয়। আমি মনে করি, এই চেঁচানো সরকারের জন্য ইতিবাচক। কোন কিছু অপছন্দ হলে গণমাধ্যম প্রতিক্রিয়া দিতে পারছে, এটাই তাদের স্বাধীনতা প্রমাণ করে।
সম্পাদক পরিষদ নামে একটি সংগঠন সম্প্রতি সরকারের বিরুদ্ধে গুরুতর একটি অভিযোগ এনেছে। তারা বলেছে- সরকার প্রিন্ট মিডিয়া, টিভি মিডিয়া, টকশোতে ভয়াবহ হস্তক্ষেপ করছে। এই সংগঠনের সভাপতি সমকাল সম্পাদক গোলাম সরওয়ার এই বিবৃতির সাথে তার ভিন্নমত পোষণ করেছেন। দ্বিমত করেছেন ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত। ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম নিজ গরজে তার অফিসে একটি মিটিং ডেকে এই বিবৃতি দিয়েছেন বলে আমরা শুনেছি। সম্পাদক পরিষদের সদস্য ২৪ জন, উপস্থিত ছিল ১০ জন, মিটিং এ বিবৃতির বিরোধিতা করেছেন ২ জন। ৮ জনের রাজী, নিমরাজীর ভিত্তিতে সম্পাদক পরিষদের ব্যানারে বিবৃতি দিয়েছেন। স্বাক্ষর করেছেন মাহফুজ আনাম। তার পত্রিকাগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সরকার বিরোধিতার অভিযোগ রয়েছে। যে কেউ কোন মত বা পক্ষে অবস্থানের গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে। কিন্তু গণমাধ্যমকে ব্যক্তিগত অভিলাষে ব্যবহার করা কতটুকু গণতান্ত্রিক সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
এরপর সংবাদ হলো- সম্পাদক পরিষদের সভাপতি গোলাম সরওয়ার নিজেই বলেছেন তিনি এই বিবৃতির দায় নেবেন না। তিনি বক্তব্য ওন করেন না। অন্য অনেক সদস্যই বিবৃতি দেখে অবাক হয়েছেন। ডেইলি স্টারের একটি নিউজের সূত্র ধরে সংসদে সরকার প্রধানের এক বক্তব্যের প্রেক্ষিতে মাহফুজ আনাম তার সংগঠনকে ব্যবহার করে বিবৃতি দিইয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই হলো গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতা। নৈতিকতা।
এই সংগঠনটি তৈরির আগে প্রায় একই সম্পাদকরা (১৪জন) মিলে হলুদ পত্রিকা খ্যাত ‘আমার দেশ’এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের নি:শর্ত মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন!!! এরপর বাংলানিউজ "বিবৃতি পরায়ণ সম্পাদক সমীপেষু" শিরোনামে সেই সম্পাদকবৃন্দের নৈতিক নিরপেক্ষতার প্রতি প্রশ্ন রেখে লেখা প্রকাশ করেছিল। তাদের কাছে কিছু প্রশ্নের জবাব আহবান করা হয়েছিল। ওনারা স্বভাবতই জবাব দেননি।
বেদনার সাথে বলতে হয়, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার দাবিটা যত জোরালো, তাদের জবাবদিহিতার চর্চায় তারা ততটাই বিমুখ! বাংলাদেশের গণমাধ্যম কারো কাছে কোন জবাবদিহিতা নেই বা করে না, এমনকি নিজেরাও নিজেদের কাছে জবাব দিহিতা করতে ইচ্ছুক নন।
রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার কথা ভেবে বৈঠকে সরকার পক্ষ থেকে পত্রিকাগুলোকে ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ এর কথা বলা হয়েছিল। সেলফ সেন্সরশিপ বা কোন বিশেষ সময়ে কোন সংবাদ প্রকাশে সচেতন থাকতে হবে ততটুকু আধুনিক আমাদের গণমাধ্যম হয়ে উঠেনি। এককভাবে কোন প্রতিষ্ঠান বা সম্পাদকের সেই সক্ষমতা থাকলেও সামষ্টিকভাবে ভাবে নেই।
৫০ দিনের অধিক সময় ধরে চলমান এ হরতাল অবরোধে কার্যত বিএনপির কোন নেতা কর্মীয় দৃশ্যমান সংশ্লিষ্টতা নেই। তারা হরতাল দিচ্ছে ইন্টারনেটে। পত্রিকাগুলো যদি এসব হাওয়াই মাধ্যমের উপর নির্ভর না করত তাহলে এই হরতাল হতোই না। বিএনপির কর্মীরাও পত্রিকা থেকে হরতালের সংবাদ জেনে হরতাল পালন করে। ফলে এসব হরতালে সহিংসতা বা মৃত্যুর দায় মিডিয়া এড়াতে পারে না। আর এসব নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সময়োপযোগী সাময়িক নির্দেশনা দরকার হতে পারে। সংবাদমাধ্যম তার স্বাধীনতার সুযোগ ব্যবহারে যথেষ্ট পরিণত নয়। বিশৃংখল স্বেচ্ছাচারী স্বাধীনতায় শাসন বারণ জরুরি হয়ে পড়ে।
মনোয়ার রুবেল: কলামিস্ট ও অনলাইন এক্টিভিস্ট, monwarrubel@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ২১১০ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০১৫