বাংলাদেশের পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত তো বটেই, সেই সাথে পতাকার নকশা কেমন হবে সে বিষয়ে নীতিনির্ধারণী ব্যক্তি শিবনারায়ণ দাস ছিলেন না। সত্তরের দশকের প্রথম থেকে সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদের যে নিউক্লিয়াস বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করতো, তার সিদ্ধান্তেই পতাকা তৈরির মত মাইলফলক সিদ্ধান্ত গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়েছিল।
শিব নারায়ণ দাসকে সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের একটি পর্যায়ে (দর্জির দোকান থেকে সেলাই করে নিয়ে আসা পতাকায় মানচিত্র আঁকা) যুক্ত করা হয়েছিল। নিশ্চিতভাবেই তিনি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নিবেদিত মানুষ এবং পতাকা তৈরির প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন। কিন্তু প্রথম পতাকার ডিজাইনার/নকশাবিদ /নকশাকারক /রূপকার হিসেবে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেয়াটা অগ্রহণযোগ্য।
সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদের যে ত্রয়ী নিউক্লিয়াস শুরু করেছিলেন তাদের পক্ষ থেকে কাজী আরেফ আহমেদ ১৯৭০ সালের ৬ জুন পতাকা তৈরির বৈঠকে বসেন তখনকার ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থি ছাত্রনেতাদের নিয়ে গঠিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের সদস্যদের নিয়ে। সেখানে তার প্রস্তাবনাকে কেন্দ্র করেই পতাকার ডিজাইন চূড়ান্ত করা হয় সম্মিলিতভাবে। প্রথম পতাকা তৈরির পুরো প্রক্রিয়ায় অনেক পরে আসে শিবনারায়ণ দাসের ভূমিকা।
পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ, তার নকশায় কী থাকবে, কেন থাকবে এবং সে নকশা চূড়ান্ত করা পর্যন্ত শিবনারায়ণ দাসের উপস্থিতি ছিল না। পতাকার নকশা সিরাজুল আলম খানের কাছ থেকে অনুমোদন করিয়ে নিয়ে আসা এবং তারপর সেই নকশা অনুযায়ী পতাকা বানিয়ে নিয়ে আসা ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থি ছাত্রনেতাদের ভেতরেও শিবনারায়ণ দাসের উপস্থিতি ছিলো না। নির্ধারিত নকশা অনুযায়ী বানিয়ে আনা সে পতাকায় যখন সোনালী রঙের মানচিত্র আঁকার প্রসঙ্গ এলো, তখন তিনি তাতে ভূমিকা রাখেন।
পতাকা তৈরির ইতিহাসকে কামরুল হাসানের নাম দিয়ে চেপে রাখার প্রায় তেতাল্লিশ বছর পর আবারও তা শিবনারায়ণ দাসের নাম দিয়ে চেপে রাখাটা কী কাম্য হতে পারে? সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের আরো কতটি “তেতাল্লিশ বছর” ভ্রান্তিতে কাটাতে হবে!
শিবনারায়ণ দাসের প্রতি উদাসীনতা দূর হওয়াটাই কাম্য, কিন্তু তা স্বাধীনতার জন্য অসম সাহসে বুক বাঁধা মানুষগুলোর বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান ও কর্মতৎপরতার প্রতি উদাসীনতা দেখিয়ে তা হতে পারে না। শিবনারায়ণ দাসকে ডিজাইনার/নকশাবিদ/নকশাকারক/রূপকার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়ে সে কাজটিই করা হচ্ছে।
ক’বছর আগে এক জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত এক লেখায় ইউসূফ সালাহউদ্দীন আহমদ জাতীয় পতাকা তৈরির সময়টার কথা স্মরণ করে লেখেন, ... ... ... পতাকা তৈরি নিয়ে মিটিংয়ে বসলাম আমরা ইকবাল হলের ১০৮ নং কক্ষে। এ কক্ষটি বরাদ্দ ছিল তৎকালীন ছাত্রনেতা আসম আব্দুর রবের নামে। কাজী আরেফ আহমেদের প্রস্তাব অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হলো পতাকায় সবুজ জমিনের ওপর থাকবে একটি লাল বৃত্ত, আর লাল বৃত্তের মাঝে থাকবে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। সবুজ জমিন বাংলার চির সবুজের প্রতীক, লাল সূর্য রক্তে রাঙা হয়ে উঠবে স্বাধীনতার সূর্য, আর জন্ম নেবে একটি নতুন দেশ সোনালি আঁশের রঙে হবে তার পরিচয়। লাল বৃত্তের মাঝখানে সোনালি রঙের মানচিত্র তারই প্রতীক। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবাই কাজে নেমে পড়লাম।
খসরু ভাই গেল তখন বলাকা সিনেমা হলের চারতলায় এক বিহারি দরজির দোকানে। বড় এক টুকরা সবুজ কাপড়ের মাঝে সেলাই করে আনলেন লাল বৃত্তাকার সূর্যের প্রতীক। এখন হলো আরেক সমস্যা। পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। সিদ্ধান্ত হলো ওটা লাল বৃত্তের মাঝে রঙ দিয়ে আঁকা হবে। আঁকাআঁকিতে কুমিল্লার শিবুদার হাত ছিল ভালো। তিনি বললেন, ‘আমি বাপু পেইন্ট করতে পারব, তবে মানচিত্র আঁকতে আমি পারব না’। কী করা যায়? ঠিক করলাম হাসানুল হক ইনু আর আমি পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র ট্রেসিং পেপারে ট্রেস করে নিয়ে আসব। আমরা গেলাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন জিন্নাহ্ হলে (বর্তমানে তিতুমীর হল)। উল্লেখ্য, আমি এবং ইনু ভাই উভয়েই তখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। জিন্নাহ্ হলে ৪০৮ নং কক্ষে থাকেন এনামুল হক (ইনু ভাইয়ের কাজিন)। তার কাছ থেকে অ্যাটলাস নিলাম। ট্রেসিং পেপারে আঁকলাম পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। নিয়ে এলাম ইকবাল হলের ১০৮নং কক্ষে। বাকি সবাই সেখানে অপেক্ষা করছিল। শিবুদা তার নিপুণ হাতে ট্রেসিং পেপার থেকে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র আঁকলেন লাল বৃত্তের মাঝে। তাতে দিলেন সোনালি রঙ। ... ... ...
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র বইয়ের ১২৮ পৃষ্ঠায় মনিরুল ইসলাম লেখেন, ... ... ... চূড়ান্ত মহড়া ৬ই জুন বিকালে শেষ হয়। ওই দিনই সন্ধ্যায় সিদ্ধান্ত হয় জয় বাংলা বাহিনীর একটা পতাকা তৈরির বিষয়ে যা পরদিন (৭ই জুন) সকালের অনুষ্ঠানকে আরও তাৎপর্যমণ্ডিত করবে। সে অনুযায়ী বাদন দলের বাড়তি সৌন্দর্যের জন্য সংগৃহীত কাপড় থেকে একটা পতাকা তৈরি হয়। কালচে সবুজ জমিনের ঠিক মাঝখানে পরিমিত আকারে একটা লাল বৃত্ত। (পতাকাটি বলাকা ভবনের ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় অফিসের পাশে এক দরজির দোকান 'পাক ফ্যাশন' থেকে সেলাই করে নেয়া হয়)। পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত ও পতাকা তৈরি পর্যন্ত কাজী আরিফ (আরেফ) ছাড়া উচ্চ পর্যায়ের কারো অনুমতি গৃহীত হয়নি। কিন্তু পরদিন একটা পতাকা, তা যে নামেই হোক, প্রদর্শনের আগে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের প্রয়োজন দেখা দেয়। ছাত্রলীগের ৭ই জুন পালনের সকল কার্যক্রম তখন জহুরুল হক হলের নিচ তলার ১১৬ নম্বর কক্ষ থেকে পরিচালিত হচ্ছিল। ওই হলেই তিন তলার একটি কক্ষে সিরাজুল আলম খান প্রায়ই থাকতেন। স্বভাবতই, স্বাধীনতার কার্যক্রমের একজন উর্ধতন নেতা হিসেবে তার কাছে অনুমোদন নিতে যাওয়া হল। তিনি পতাকা তৈরি ছাড়া সকল কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত থাকায় আগামীকালের কার্যক্রমকে আরও অর্থবহ করার জন্য পতাকা তৈরির কথা জানিয়ে তা প্রদর্শনের জন্য তাঁর অনুমতির জন্য আবেদন করা হল। সমস্ত কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন 'যে নাম দিয়েই পতাকা প্রদর্শন কর না কেন তাকে জনগণের ভবিষ্যতের স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা বলে ভেবে নিতে কোন বাঁধা থাকবে না। ' এই মুহূর্তে 'বাঙলাদেশ' ও বাঙ্গালি' নিয়ে প্রতিপক্ষের অপপ্রচারের শিকার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করলেন। তিনি বললেনঃ 'বাংলাদেশ তথা পূর্ব বাঙলার স্বাধীনতা বিষয়ক আন্দলোনকে অনেকেই যুক্ত বাঙলার কথা বলে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেরই বিরুদ্ধে ঠেলে দিতে পারে। ' অনেক আলোচনার পর তিনি লালবৃত্তের মাঝে পূর্ব বাঙলার মানচিত্রে এঁকে প্রদর্শনের পক্ষে মত দিলেন। সোনার বাঙলার প্রতিচিত্র সুস্পষ্ট করতে তিনি ওই মানচিত্র সোনালি রঙয়ে আঁকার পক্ষে মত দিলেন।
এই সব কিছুর মধ্য দিয় ৬ই জুনের রাতের দ্বিতীয় প্রহরের প্রায় শেষ প্রান্ত উপস্থিত। বলাকা ভবনে ছাত্রলীগ অফিস হওয়ার কারণে নিউ মার্কেটের পাশের কাঁচা বাজার সংলগ্ন এক রঙয়ের দোকান থেকে, দোকানিকে জাগিয়ে, সোনালি রঙ ও তুলি জোগাড় করা হল। মানচিত্রের নকশা অঙ্কন এবং রঙ করার জন্য একজন শিল্পীর প্রয়োজন দেখা দিল। সে সমস্যাও সহজেই সমাধান হয়ে গেল। সলিমুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগের সম্মেলন উপলক্ষে ব্যানার ফেস্টুন আঁকার জন্য কুমিল্লা ছাত্রলীগের নেতা শিবনারায়ণ দাস তখন কর্মরত ছিল। সে একজন ভাল শিল্পীও বটে। ফলে তাকে নিয়ে আসা হল কালচে সবুজ জমিনের মধ্যখানে লাল বৃত্তের মাঝে সোনালি রঙ দিয়ে পূর্ব বাঙলার মানচিত্র আঁকার জন্য। ১১৬ নম্বর কক্ষের মেঝেতে বিছিয়ে লাল বৃত্তের মাঝে পূর্ব বাঙলার সোনালি মানচিত্র আঁকা হল। ... ... ...
বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র বইতে কাজী আরেফ আহমেদ লিখেছেন, ... ... ... ১৯৭০ সালের ৭ জুন শ্রমিক জোটের পক্ষ থেকে পল্টন ময়দানে শেখ মুজিবকে অভিবাদন দেয়ার কর্মসূচি নেয়া হয়। ঐদিন ছাত্রলীগও সিদ্ধান্ত নেয় যে একটা বাহিনী গঠন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গার্ড অব অনার প্রদাণ করা হবে। এবারও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। এই বাহিনীর নাম দেয়া হয় “জয় বাংলা বাহিনী”। অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয় আসম আবদুর রবকে। নিউক্লিয়াস থেকে বাহিনীর পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই পতাকা বঙ্গবন্ধুকে ‘ব্যাটালিয়ান ফ্ল্যাগ’ হিসেবে প্রদান করা হবে। ৬ জুন ’৭০ সালে ইকবাল হলের ১১৬ নম্বর রুমে মনিরুল ইসলাম, শাজাহান সিরাজ ও আসম আবদুর রবকে ডেকে আমি ‘নিউক্লিয়াস’-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ফ্ল্যাগ তৈরির কথা জানাই। এই ফ্ল্যাগ পরবর্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হিসেবে গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনার কথাও জানাই। তখন মনিরুল ইসলাম (মার্শাল মনি) ও আসম আবদুর রব বলেন যে, এই পতাকার জমিন অবশ্যই বটলগ্রিন হতে হবে। শাজাহান সিরাজ বলেন যে, লাল রঙের একটা কিছু পতাকায় থাকতে হবে। এরপর আমি পতাকার নকশা তৈরি করি। বটলগ্রিন জমিনের উপর প্রভাতের লাল সূর্যের অবস্থান। সবাই একমত হন। তারপর পতাকার এই নকশা 'নিউক্লিয়াস' হাইকমান্ডের অনুমোদন নেয়া হয়।
তখন আমি প্রস্তাব করি যে, এই পতাকাকে পাকিস্তানি প্রতারণা থেকে বাঁচাতে হলে লাল সূর্যের মাঝে সোনালী রঙের মানচিত্র দেয়া উচিত। কারণ হিসেবে দেখালাম যে, প্রায়ই বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী “ভারতের হাত আছে” বা “ভারতীয়দের অনুপ্রবেশ হচ্ছে” অথবা “ভারতীয় এজেন্টদের কার্যকলাপ” বলে প্রচারণা চালায়। তাছাড়া এই সময় ‘ইউনাইটেড স্টেটস অফ বেঙ্গল’ বা ‘বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র’ নামের কাল্পনিক একটি দেশের জন্ম দেয়া হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যসহ পূর্ব পাকিস্তান ও মায়ানমারের আরাকান রাজ্যসহ এই কল্পিত ‘ইউনাইটেড স্টেটস অফ বেঙ্গল’-এর মানচিত্র তৈরি করে বাঙালির স্বায়ত্বশাসনের দাবিকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য সরকারি প্রশাসনযন্ত্র তা বিলি করত। এই ধরনের প্রচারণা থেকে পতাকাকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের সোনালী আঁশ ও পাকা ধানের রঙে বাংলাদেশের মানচিত্র পতাকার লাল সূর্যের মাঝে রাখার আমার এই প্রস্তাবে সবাই একমত হন।
পতাকার কাপড় কিনে তৈরি করতে পাঠান হয় কামরুল আলম খান খসরু, স্বপন কুমার চৌধুরী, মনিরুল হক, হাসানুল হক ইনু ও শহীদ নজরুল ইসলামকে। এরা নিউমার্কেটের অ্যাপোলো নামক দোকান থেকে গাঢ় সবুজ ও লাল রঙের লেডি হ্যামিলটন কাপড় কিনে বলাকা বিল্ডিংয়ের পাক ফ্যাশন থেকে তৈরি করায়। যে দর্জি এই পতাকা তৈরি করেন তিনি ছিলেন অবাঙালি এবং ইতিবৃত্ত না জেনেই এই পতাকা তৈরি করেছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর ঐ দর্জি পাকিস্তানে চলে যান।
সমস্যায় পড়লাম মাঝের সোনালী মানচিত্র আঁকা নিয়ে। এই সময় কুমিল্লার শিবনারায়ণ দাস (বিপ্লবী পরিষদের সদস্য) ইকবাল হলে এসে উপস্থিত হন। তিনি জানালেন মানচিত্রের ওপর শুধু রং করতে পারবেন, মানচিত্র আঁকতে পারবেন না। তখন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাসানুল হক ইনু ও ইউসুফ সালাউদ্দীন আহমদ চলে গেলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এনামুল হকের ৪০৮ নং কক্ষে। তাঁর কাছ থেকে অ্যাটলাস নিয়ে ট্রেসিং পেপারে আঁকা হল বাংলাদেশের মানচিত্র। সোনালী রং কিনে আনা হল। শিব নারায়ণ দাস ট্রেসিং পেপার থেকে দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে লাল বৃত্তের মাঝে আঁকলেন মানচিত্র। মানচিত্রের ওপর দিলেন সোনালী রঙ। শিবুর কাজ শেষ হওয়ার মধ্য দিয়েই একটা ভবিষ্যতের নতুন দেশের নতুন পতাকার জন্ম হল।
এক বেসরকারি টেলিভিশনের আলোচনা অনুষ্ঠানে শাজাহান সিরাজ বলেন, ... ... ... পতাকা নিয়েও বিতর্ক হচ্ছে, ১১৬ বা ১১৮ হয়তো, এখন ১১৬ হয়েছে; আমি আর রব ভাই ভাই থাকতাম ওখানে। এটা হয়তো সিরাজুল আলম খানের মাধ্যমেই এসেছে, কিন্তু এমনভাবে এসেছে যে আমি যে প্রস্তাব দিয়েছি সেটা সিরাজ ভাই আমাকে বলে দেয়নি, রব ভাইকে বলে দেয়নি। কাজী আরেফ হয়তো জানে, কিন্তু উনি বলে দেননি যে এইটা করতে হবে। একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমি প্রস্তাব দিয়েছি লাল সূর্য। রব ভাই প্রস্তাব দিয়েছে জমিন। এর আবার মধ্যস্থতা করে দিল আমাদের মার্শাল মনি। তারপর এক্সেপ্ট হয়ে গেল। আরেফ ভাই তখন আমার কাছে উদ্ভট মনে হওয়া একটা প্রস্তাব দিল। বাংলাদেশের, পূর্ব পাকস্তানের, একটা ম্যাপ দিতে হবে। আমি বললাম যে এটা পৃথিবীর কোথাও নেই। সে বললো যে কারণ আছে। যে কোন আন্দোলনকে ভারতের সাথে ট্যাগ করা হয়। আমরা অন্য কোন অংশের স্বাধীনতা চাইনা। আমরা এই অংশের স্বাধীনতা চাই। বিশ্বাস করেন, সেদিন অনেক খুশি হয়েছিলাম।
এটা দশ বারজন যে জানতো না, তা না। তারা বাইরে ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির কিছু ছেলে জানতো। ইনু হয়তো কিছু জানতো। কিন্তু সিদ্ধান্তটা আমরা চার পাঁচজনই নিয়েছি। আজকে বলা হচ্ছে শিবনারায়ণ দাস না কী এটার সবকিছু। আমারা তো উনাকে ডেকে আনলাম এটা রেডি করার পরে। কাপড় এনে, খসরু ভাইকে দিয়ে দোকান থেকে কাপড় সেলাই করিয়ে যখন আমাদের কাছে আসলো তখন প্রশ্ন উঠলো যে আর্টিস্ট পাবো কোথায়। রাত তখন প্রায় তিনটা বাজে। স্বপন চৌধুরীকে দিয়ে তখন হল থেকে তাকে ঘুম থেকে টেনে নিয়ে আসা হল। সে এটা এঁকে দিল। হ্যাঁ, সেও আমাদের পার্ট, যেহেতু সে এঁকেছে। কিন্তু এটা নিয়েও অনেক খেলা খেলার চেষ্টা করা হয়েছে। ... ... ...
সম্প্রতি এক অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে আসম আব্দুর রব লেখেন, ... ... ... ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের ইকবাল হল। ১১৬ নং কক্ষে থাকতাম। এ কক্ষে বসে ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের প্রতিষ্ঠাতা বাঙ্গালির আর এক শ্রেষ্ঠ সন্তান সিরাজুল আলম খানের পরামর্শে আমি, শাজাহান সিরাজ, কাজী আরেফ আহমেদ, মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মনি বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীনতার পতাকা তৈরির পরিকল্পনা করি। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে পতাকা তৈরির পরিকল্পনা সব ঠিকঠাক। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ আঁকতে জানে না। সবাই চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলেন। তখন সম্ভবত শাজাহান সিরাজ জানান, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শিবনারায়ণ দাস ঢাকায় আছে। সে ভালো পোস্টার লেখে।
সবাই আলোচনা করে পতাকার কাঠামো তৈরি করেন। মানচিত্র অংকন করেন শিবনারায়ণ দাস। নীলক্ষেতের নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্স (বিহারি মালিক) পতাকা তৈরি করে দেন। ... ... ...
তাই সবার প্রতি সম্মান দেখিয়েই বলতে চাই, প্রকৃত সত্য আর ইতিহাস চাপা পড়ে গেল আমাদের অর্জন আর গৌরবের গায়ে তা কলঙ্ক হিসেবেই বিবেচিত হবে। উপরের আলোচনায় সেই কলঙ্কমোচনের পর্যাপ্ত রসদ আছে বলেই মনে করি।
কাজী আফরিন জাহান জুলি: কাজী আরেফ আহমেদের মেয়ে, kaziafrin.julee@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১২৫২ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০১৫