কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সংগীতহারা, অমাবস্যার কারা/ লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপ্নের তলে। তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে-যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু,নিভাইছে তব আলো,/তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ,তুমি কি বেসেছ ভালো? বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রশ্ন কবিতাতে যে প্রশ্ন করেছেন- দেড়শ’ বছর পার করে আবারো এ প্রশ্ন আজ বাংলাদেশের শান্তিকামী প্রতিটি মানুষের মনে!
যারা প্রতিনিয়ত আমাদের বায়ু বিষিয়ে দিচ্ছে চোখের আলো নিভিয়ে দিচ্ছে – প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে যারা সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে-কেন আমরা ঘৃণা আর ধিক্কার জানাই না সেই অন্ধকারের শক্তিকে?কেন এই অন্ধকারের শক্তি ভোটের রাজনীতিতে সর্বোচ্চ মূল্যায়িত হয়? কেন এই অন্ধকারের শক্তিকে বারবার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে? এই অন্ধকারের অপশক্তি যে আমার লাল সবুজের বাংলাকে আরবী আতরের মোদো মাতাল হাওয়ায় বিষিয়ে তুলেছে।
এই অপশক্তি এক মাস আগে অভিজিৎ রায়ের মতো মেধাবী বিজ্ঞান গবেষককে শেষ করতে দেরি করেনি। ঠিক এক মাসের মাথায় মো. ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে।
আগুনের স্ফূলিঙ্গ ক্ষণজন্মা মো. ওয়াশিকুর রহমান বাবু আমাদের অনেকের কাছেই অচেনা নাম। দীন দুঃখিনী এই বাংলার অতি সাধারণ দরিদ্র পরিবারের এক অসীম শক্তিধর মেধাবী সন্তান মো. ওয়াশিকুর রহমান বাবু, সামান্য ভর্তা দিয়ে ভাত খাওয়াও তার জন্যে যেন বিলাসিতা; যার শেষ সুযোগটি আর পায়নি ওয়াশিকুর। আমাদের অনেকের কাছে অচেনা হলেও অপশক্তি তার শত্রুদের চিনতে ভুল করেনি। তথাকথিত প্রগতিশীল শক্তির উদাসীনতা আর বিচ্ছিন্নতার আরেকটি বলি ওয়াশিকুর।
ভাবতে সত্যি বড়ো কষ্ট হচ্ছে, এমন সৎ, প্রতিবাদী কণ্ঠ এমন অকালে রুদ্ধ করে দেয়া হলো? পেশাগত দায়িত্বপালন করতে গিয়ে আমি ওয়াশিকুরের প্রাণহীন ক্ষতবিক্ষত নিথর দেহটি দেখেছি। নিহত ওয়াশিকুরের চোখ এবং মুখ বরাবর সমান্তরাল দুইটি কোপে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মুখমণ্ডলের দুইটি অংশ। পুলিশ জানায়, হামলাকারীরা ওয়াশিকুরের শরীরের শুধু মুখমণ্ডল ও গলাসহ শরীরের ঊর্ধ্বাংশে আঘাত করেছিলেন। তাঁর মুখমণ্ডল ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। চোখ ,নাক থেঁতলে চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। প্রচুর রক্তক্ষরণে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেই থেকে আমার কণ্ঠ সত্যিই রুদ্ধ!!
ঢাকার বাইরে থাকার কারণে ড. অভিজিৎ রায়কে হত্যার পর আমি দেখতে যেতে পারি নি, সে সময়ে অনেক ইচ্ছে থাকার পরও নানা জটিলতায় কোন লেখাও দিতে পারিনি। এ নিয়ে যথেষ্ট মনোবেদনায় ভুগছি। ড. অজয় রায় আমার কাছে তাঁর পুত্র অভিজিৎ রায় হত্যার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার সাথে মিলে যায় ওয়শিকুরের হত্যার ধরণ। ‘ঈমানি দায়িত্ব’ পালন করতে গিয়ে ধারাবাহিকভাবে হত্যা করা হচ্ছে মুক্তচিন্তার প্রতিবাদী শক্তির অনুসারীদের, যা যে কোন দেশ, যে কোন সভ্যতার জন্যে অশনি সংকেত!!
অতি সাধারণ পরিবারের একমাত্র পুত্র ওয়াশিকুরকে বর্বরোচিতভাবে হত্যার পর তার লেখার দিকে নজর পড়েছে কৌতূহলী গণমাধ্যম আর অন্যদের। নিজেকে ‘বোকা মানব’ আখ্যা দিয়ে ওয়াশিকুর লিখেছে, "গ্রামে ও শহরে মিশ্রভাবে বসবাসের ফলে আমার মধ্যে একধরনের সংমিশ্রণ ঘটেছে। না হতে পেরেছি শহরের স্মার্ট, মেধাবী, অতি আধুনিক, না হতে পেরেছি গ্রামের পরিশ্রমী, গেছো, ভালো সাঁতারু। দুই স্থানেই আমি একজন অতি বোকা। তাই আমি আজ বোকা মানব। " 'বোকা মানব' নামে একটি ব্লগে নিজের সম্পর্কে এভাবেই আত্মবিশ্লেষণ করেছিলেন ওয়াশিকুর বাবু। অভিজিৎ রায়ের হত্যা তাকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিলো। নিজের ফেসবুকে তাই বাবু কভার ফটো করেছিলেন,'আমিই অভিজিৎ'।
তিনি লিখেছেন,‘আমার নাম মো. ওয়াশিকুর রহমান। জন্ম গ্রামে হলেও শৈশব কেটেছে ঢাকায়। তবে আট বছর বয়সের সময় বেশ কিছুদিন গ্রামে কাটাতে হয়। বছর দুয়েক মফস্বল শহরে কাটিয়ে আবার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। কিন্তু মাস ছয়েক না কাটতেই আবার গ্রামে ফিরে যেতে হয়। একটানা ছয় বছর গ্রামে কাটিয়ে পুনরায় ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। এখন পর্যন্ত ঢাকাতেই আছি। এভাবে গ্রামে ও শহরে মিশ্রভাবে বসবাসের ফলে আমার মধ্যে একধরনের সংমিশ্রণ ঘটেছে। না হতে পেরেছি শহরের স্মার্ট, মেধাবী, অতি আধুনিক, না হতে পেরেছি গ্রামের পরিশ্রমী, গেছো, ভালো সাঁতারু। দুই স্থানেই আমি একজন অতি বোকা। তাই আমি আজ বোকা মানব। ’ এই ব্লগে তিনি সর্বশেষ ২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে একটি লেখা পোস্ট করেছেন।
এখন একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন, এই 'বোকা মানব'টিকে কারা টার্গেট করলো? কারা ওয়াশিকুরের মূল ঘাতক?
চট্টগ্রামের দারুল উলুম মুইনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার তফসির বিভাগের ছাত্র জেএমবি জঙ্গি জিকরুল্লাহকে শনিবার রাজধানীতে আসতে কে নির্দেশ দিয়েছিলো? যে 'বড়ো ভাই' মাসুম রোববার বিকেলে হাতির ঝিলে তাহের, আরিফুল এবং জিকরুলকে ডেকে তিনটি চাপাতি দেয় এবং ওয়াশিকুর বাবুর ছবি দেখিয়ে বাবুকে হত্যার 'ঈমানি দায়িত্ব' দেয়, তার প্রকৃত পরিচয় কী? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরছেন গোয়েন্দারা। তাঁরা জানতে পারলে আমরা আমজনতাও সত্য জেনে উপকৃত হবো।
প্রশ্ন উঠেছে কেন এবং কোথা থেকে নিরীহ, শান্ত তরুণ ওয়াশিকুরকে খুন করার নির্দেশ এসেছে? যাঁকে হত্যা করা হলো, তিনি কোথায়, কী লিখেছেন? কিছুই জানা ছিল না খুনিদের।
ওয়াশিকুর ‘ধর্মের অবমাননা’ করেছেন এমন অভিযোগ এনে ওয়াশিকুর এর ছবি দেখিয়ে, তার বাসার পথ চিনিয়ে তাকে হত্যা করার জন্যে ঘাতকদের হাতে চাপাতি তুলে দেয়া হয়েছে। আর সেটা দিয়ে কুপিয়ে নিরীহ এক তরুণকে প্রকাশ্য দিবালোকে নিঃশঙ্ক চিত্তে নির্বিঘ্নে হত্যা করেছে তিন তরুণ। প্রথম চাপাতির কোপ দেয় তাহের। দ্বিতীয় চাপাতির কোপ দেয় জিকরুল। এর মধ্যে জনরোষের মুখে আরিফুলের চাপাতি আর ব্যবহার করা হয়নি। দুই কোপেই ব্লগার ও অনলাইন লেখক ২৭ বছরের তরুণ ওয়াশিকুর রহমানের চোখ এবং মুখ বিভক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ।
টেলিভিশনের স্ক্রলে ওয়াশিকুর বাবু হত্যার সংবাদ জেনে তার শুভানুধ্যায়ী বন্ধুদের অনেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে উপস্থিত হয়েছেন। যারা সোমবার দুপুর থেকে লাশ বাড়িতে নেয়া পর্যন্ত বসেছিলেন তাদের একজন ওয়াশিকুরের পাতানো বোন তামান্না সেতু। এই প্রতিবেদককে তিনি জানান, শুক্র এবং শনিবার তার অফিস খোলা, ওয়াশিকুরের সেদিন অফিস বন্ধ। তাই অনেকদিন দেখা হয়নি। ২৫ মার্চ শেষবারের মতো তার সাথে ফেসবুকে আলাপ হয় ওয়াশিকুরের। সেদিন ওয়াশিকুর খুব বলছিলো, "দিদি,ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে খুব। আপনি কবে সময় দেবেন, আপনার সাথে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে অনেক। "
ভাই হারানোর শোকে শোকাহত সেতু বলেন," সেদিন কেন যেন কোন রিপ্লাই দেয়া হয় নি। আর কখনো আমার কাছে ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে চাইবে না বাবু, এটা কী করে ভাবা যায়? " তিনি জানান, কয়েক বছর ধরে ওয়াশিকুর ফেসবুকে ‘আসুন নাস্তিকদের কটূক্তির দাঁতভাঙা জবাব দেই...’ শিরোনামে একটি ব্যঙ্গাত্মক লেখা ১০৩ পর্ব পর্যন্ত লিখেছেন। ওই লেখায় ওয়াশিকুর বিভিন্ন ধর্মীয় রীতি-নিয়ম নিয়ে বাড়াবাড়ি যারা করে, তাদের খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন।
তামান্না সেতুসহ ওয়াশিকুরের বন্ধুরা জানিয়েছেন, ড. অভিজিৎ খুন হবার পর ভীষণ মুষড়ে পড়েন ওয়াশিকুর। তাঁর লেখায় তিনি এর প্রতিবাদ জানান। তখন বন্ধুরা তাঁকে সাবধান করেছিলেন। জবাবে ওয়াশিকুর বলেছিলেন,‘আমি তো প্রোফাইল পিকচারও দেইনি। আমারে চিনবে ক্যামনে। ’ তামান্না সেতুর দু'চোখে জলের নীরব ধারা। বললেন,‘ও এমন কিছু লিখত না, যার জন্য কুপিয়ে মেরে ফেলতে হবে। আমরা জানি না, এরপর কার পালা। ’
কয়েকজন নারীসহ হিজড়াদের চিৎকারে এবং আপ্রাণ চেষ্টায় ঘাতকদের দু’জন ধরা পড়েছে। স্যালুট জানাই সমাজে বঞ্চিত নিপীড়িত হয়েও পরম মানবতাবাদী এই বৃহন্নলাদের। যাদের অসীম সাহসিকতায় ভয়ংকর দুই ঘাতককে গ্রেফতারে সক্ষম হয়েছে পুলিশ।
খুনের পর রক্তের দাগ যেন বোঝা না যায়, সে জন্য ঘাতকরা লাল পোশাক পরে হত্যা করতে যায়। জিকরুল্লাহর পরনে ছিল লাল ডোরাকাটা টি-শার্ট, জিন্স, পায়ে কাপড়ের কেডস। আর আরিফুলের পরনে ছিল লাল টি-শার্ট, কালো প্যান্ট ও স্যান্ডেল। এই দুজনের লাল গেঞ্জির নিচেই আরেকটি গেঞ্জি ছিল। চাপাতির ব্যাগের ভেতরে অতিরিক্ত পাঞ্জাবি ছিল। পোশাক বদলে সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যাওয়ার জন্য কৌশল করে দুই স্তরের পোশাক পরেছিলো তিন ঘাতক। ঘটনাস্থলে থাকা দু'জন হিজড়া, স্থানীয় ব্যক্তি ও পুলিশ ধাওয়া করে দু'জনকে ধরে ফেলে। ঘাতকদের বয়স ২০ থেকে ২৫-এর কোটায়।
বিজ্ঞানগবেষক ড. অভিজিৎ রায় খুনের এক মাস পর ওয়াশিকুরকে হত্যা করা হলো। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় অভিজিৎকে। এ সময় তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে কুপিয়ে জখম করে প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের সামনেই পালিয়ে যায় খুনিরা। এর আগে ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে। আহত করে হত্যা করা হয়েছে বুয়েট ছাত্রলীগের সংগঠক দীপকে। একই বছরের ১৪ জানুয়ারি রাতে একইভাবে কুপিয়ে আহত করা হয় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনকে। রাজীব হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে জামায়াত নেতা এবং জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি মুহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। মামলাটি এখন বিচারাধীন। ব্লগার আসিফের ওপরও একই সংগঠন হামলা করেছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ।
২০১৩ সালের ১৫ নভেম্বর বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে প্রকাশ্য দিবালোকে তার বাড়ির সামনে একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এই হত্যার পর ‘আনসার আল ইসলাম বাংলাদেশ-২’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ দায় স্বীকার করে স্ট্যাটাস দেয়। আর সর্বশেষ অভিজিৎ হত্যার পর ‘আনসার বাংলা সেভেন’ নামের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়। একজন হুমকিদাতাকে গ্রেপ্তার ছাড়া পুলিশ আর কাউকেই শানাক্ত করতে পারে নি।
ওয়াশিকুর বাবুর তিন ঘাতকের মধ্যে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার হওয়া দু'জনের মধ্যে জিকরুল্লাহর বাড়ি নরসিংদী, আরিফুলের কুমিল্লা। আমাকে জিকরুল্লাহ জানালো, তারা কখনো ওয়াশিকুরকে দেখেনি। তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা নেই। ওয়াশিকুর কোথায়, কী লিখেছেন, তা-ও তারা জানে না। তাদের 'বড়ো ভাই’ ‘মাসুম ভাই’য়ের কথাতেই তারা ওয়াশিকুরকে হত্যা করেছে।
ওয়াশিকুরের ঘাতক জিকরুল্লাহ তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় আমাকে আরো জানায়, তার বড়োভাই ‘মাসুম ভাই’র কথামতো শনিবার জিকরুল্লাহ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে যাত্রাবাড়ীর দিকে এক মাদ্রাসায় রাত কাটায়। রোববার বিকেলে হাতিরঝিল লেকের পাড়ে ডেকে ওয়াশিকুরকে হত্যার দিকনির্দেশনা দেয় তাদের ‘মাসুম ভাই’। জিকরুল্লাহ, আরিফুল ও তাহের মিলে প্রথম বারের মতো তখন আলোচনা হয়। সহযোগী ঘাতক আরিফুল এবং তাহেরকেও চিনতো না জিকরুল। রোববার বিকেলে হাতির ঝিলেই তাদের প্রথম দেখা। ওয়াশিকুরের ছবি দেখিয়ে মাসুম তাঁদের বলে, ‘এই লোক মহানবী (সা.)-এর অবমাননা করেছে, আল্লাহ ও ইসলামকে নিয়ে কটূক্তি করেছে। তাকে হত্যা করতে হবে।
এরপর মাসুম তাদের নিয়ে হাতিরঝিলের কাছাকাছি দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে ওয়াশিকুরের বাসা দেখিয়ে দেয়। ওয়াশিকুর কখন বাসা থেকে অফিসে যান, কোন্ দিক দিয়ে কিভাবে হামলা করা হবে, সেসব বুঝিয়ে দেয় 'মাসুম'। ওয়াশিকুরের বাসার আশপাশের এলাকা চিনে নেয় ঘাতকেরা। মাসুম তাদের তিনজনকে তিনটি চাপাতি দেয়। 'মাসুম' এর নির্দেশনা অন্ধের মতো অনুসরণ করে মাথায় সাদা টুপি পরে সোমবার সকালে তিন ঘাতক রাজধানীর দক্ষিণ বেগুনবাড়ি দীপিকার মোড়ে অবস্থান নেয়। পরে হত্যা করে ওয়াশিকুরকে।
লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জের টিপু সুলতানের একমাত্র পুত্র নিহত ওয়াশিকুর বাবু। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান তিনি। ২০০০ সালে তার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে যায়। ওয়াশিকুর বাবু তার বাবার সাথেই থাকতেন। ২০০৬ সালে এসএসসি পাশ করেন। তেজগাঁও কলেজ থেকে ইসলামের ইতিহাসে স্নাতক করে মতিঝিলে ফারইস্ট এভিয়েশন নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে শিক্ষানবিশ হিসেবে চাকরি করতেন। এই প্রতিষ্ঠানে ওয়াশিকুরের খালা চাকরি করতেন। তিনিই ওয়াশিকুরকে এই চাকরির ব্যবস্থা করে দেন।
সামান্য বেতনের চাকুরে ওয়াশিকুর তার বাবার সাথে দক্ষিণ বেগুনবাড়িতে ৭ হাজার টাকা দিয়ে একটি রুম ভাড়া নিয়ে থাকতেন। । ওয়াশিকুরের অফিস যেতে দেরি দেখে ফারইস্ট এভিয়েশন থেকে ওয়াশিকুরের মোবাইলে ফোন করলে পুলিশ রিসিভ করে সেই ফোন। এর পর ফারইস্ট এভিয়েশন থেকেই বাবুর খালাকে ফোন করে বাবুর নিহত হবার সংবাদ জানানো হয়। সেই সংবাদ শুনে আত্মীয়-স্বজন মর্গে ছুটে আসেন।
সোমবার সকালেই বাড়ি গেছেন ওয়াশিকুরের বাবা টিপু সুলতান। ছেলে হত্যার সংবাদ শুনে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন তিনি। এ কারণে তাঁর আর রাজধানীতে আসা সম্ভব হয়নি। একমাত্র পুত্রের প্রাণহীণ দেহ গ্রামে নেবার জন্যে জামাতাকে রাজধানীতে পাঠিয়েছেন।
এই পরিবারটির কাছে কী জবাব আছে সুশীল সমাজের? যারা কখনো সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ হন না? তবু বলতে হয়, একদিন কড়ায়-গন্ডায় প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের দায় দিতে হবে। পরবর্তী কোন নিরীহ প্রাণ হত্যার আগেই ঠেকাতে হবে আরো ভয়ংকর বিপর্যয়! অন্ধকারের শক্তির মোকাবেলা করতে হবে কৌশলে!
সুমি খান: সাংবাদিক, কলামিস্ট, sumikhan29bdj@ggmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১০৩২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১, ২০১৫