ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

ভুভুজেলা কবে কোথায় আমাদের সংস্কৃতির অংশ ছিলো?

আদম অনুপম, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৫
ভুভুজেলা কবে কোথায় আমাদের সংস্কৃতির অংশ ছিলো? ছবি: প্রতীকী

ইদানিং একটা ব্যাপার বেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যে কোনো উৎসবে বাঙালি মহানন্দে এক ধরনের বাঁশি বাজাচ্ছে।

পহেলা বৈশাখ তো বটেই, ষোলই ডিসেম্বর, ছাব্বিশে মার্চ, এমনকি একুশে ফেব্রুয়ারিতেও! বড়, ছোট, মাঝারি এই বাঁশিগুলোতে আস্তে করে ফুঁ দিলেই তৈরি হয় বিরাট-বিকট আওয়াজ। যে আওয়াজ সজোরে কানের পর্দায় আঘাত করে। হৃদযন্ত্র কাঁপিয়ে তোলে। মস্তিষ্কের উপর চাপ প্রয়োগ করে।

ভুভুজেলা নামক অদ্ভূতুড়ে এ বাদ্যযন্ত্রটি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ২০১০ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের সময়। বাহারি রঙ-ঢঙের বিরাট লম্বা একখানা বাঁশি যে যার মতো বাজাচ্ছে, বিকট আওয়াজ হচ্ছে, তাতেই যেন পূর্ণতা পাচ্ছে সবার আনন্দ! দক্ষিণ আফ্রিকান এই ফুটবলীয়-সংস্কৃতি নিজেদের মধ্যে আত্তীকরণ করতে বাঙালি বেশি দিন দেরি করেনি! চট করেই নিজের সংস্কৃতির অন্যতম একটি প্রধান উপাদান বানিয়ে ফেলেছে ভিনদেশি এই বাদ্যযন্ত্রটাকে!

বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ভুভুজেলার প্রসার হয়েছিল ২০১১ ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময়। শ্রীলঙ্কা-ভারতের সাথে যৌথভাবে বাংলাদেশ সেবার ছিল বিশ্বকাপের আয়োজক দেশ। সদ্য শেষ হওয়া ফুটবল বিশ্বকাপের স্বাগতিকদের থেকে শিক্ষা নিয়ে বাঙালি সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ভুভুজেলা বাজাল। উপভোগ করল ক্রিকেট ম্যাচ দেখা ও জেতার আনন্দ।

কিন্তু ভুভুজেলা ব্যাপারটি শুধু খেলার আনন্দ উপভোগের মধ্যেই আর সীমিত থাকলো না। খেলা থেকে আস্তে আস্তে সেই বাঁশি জায়গা করে নিল পহেলা বৈশাখসহ আমাদের অন্যান্য রাষ্ট্রীয় উৎসবেও। ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকলো এর বিস্তৃতি।

পহেলা বৈশাখ আমাদের নিজস্ব উৎসব; একান্তই বাঙালির। বাংলার আবহমানকালের ঐতিহ্য আর পরম্পরাই এ উৎসবের প্রধান উপাদান। সকল নাগরিক ব্যস্ততা, যান্ত্রিকতা আর অস্থিরতা ভুলে গিয়ে আমরা যেতে চেষ্টা করি শেকড়ের খুব কাছাকাছি। উপলব্ধি করতে চেষ্টা করি আমার আমার ঐতিহ্য, আমার সংস্কৃতি, আমার বাঙালিত্ব।

বাঁশের বাঁশি, ডুগডুগি, একতারা-দোতারা, নাগরদোলা, লোকজ গান, মাটি-বেত-বাঁশের তৈরি শৌখিন দ্রব্যাদি, পান্তা ভাত, মুড়ি-মুড়কি, পাঞ্জাবি-শাড়ি নানা আয়োজন প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের নষ্টালজিয়ায় ভোগায়। আমরা ফিরে পাই যেন আমাদের আবহমানকালের আপন বাংলাকে। মনে হয়, এই বুঝি আমি, এই বুঝি আমার আমিত্ব, আমার বাঙালিপনা। আর তাই প্রখর রোদ, ভ্যাপসা গরম, ভিড়-ভাট্টা, ধুলাবালি ইত্যাদি অবহেলা করে আমরা বাইরে বের হয়ে আসি, মেতে উঠি প্রাণের উৎসবে।

কিন্তু অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত আমাদের এ বর্ণিল উৎসবে হঠাৎ করেই আবির্ভাব এবং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ভিনদেশি এক উপকরণ, ভুভুজেলা। গ্রাস করে ফেলছে আমাদের প্রাণের উৎসবের জৌলুস। আনন্দোৎসবকে করে তুলছে বিষাদময়, যন্ত্রণাময়। ভুভুজেলার এ বিকট উৎপাতে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠছে আমাদের স্বাভাবিক পথচলা, কথাবার্তা, আড্ডা। উৎসবস্থলগুলোতে আনন্দ উপভোগের চেয়ে কান চেপে ধরে রাখা বা কোনোমতে ‘নিরাপদ স্থানে’ পৌঁছানোটাই যেন এখন প্রধান দায়িত্ব হয়ে পড়েছে।

সুষ্ঠু-সুন্দর উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় রাখতে হলে ভুভুজেলা নামক দানবীয় দাপাদাপিকে এবার না থামালেই নয়। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রীয় উৎসবে এই উৎপীড়ক যন্ত্রণাময় আপদটির গলা চেপে ধরা এখন সময়ের দাবি। মনে রাখতে হবে, ভুভুজেলা বাজানো আমাদের সংস্কৃতির কোনো অংশ নয়। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্যের কোথাও এর ঠাঁয় নেই। তবে কেন আমরা আমাদের লোকজ উৎসবে এ বাঁশি নিয়ে মেতে থাকব? কেন আমাদের দেশিয় ঐতিহ্যবাহী চমৎকার সব বাদ্যযন্ত্রগুলিকে ফেলে ভিনদেশি এই কিম্ভূতকিমাকার যন্ত্রটিকে নিয়ে উন্মাদ হব?

তাছাড়া, এটি প্রচণ্ডরকম বিরক্তি উৎপাদন করে। নষ্ট করে আমাদের উৎসবের আমেজ এবং তাৎপর্য। এটা ঠিক, উৎসব-অনুষ্ঠান বা মেলায় উচ্চমাত্রার শব্দ হবেই। শব্দ না হলে উৎসব-উৎসব ভাবও আসে না। কিন্তু তার জন্য ক্রমাগত বিকট আওয়াজ তুলতে হবে, তা কিন্তু নয়। উৎসবে আমরা অবশ্যই আনন্দ করব, হৈ হুল্লোড় করব, মাতিয়ে রাখব। কিন্তু সেটা হবে, গানের শব্দ, ঢোল-ডুগডুগির শব্দ, নলখাগড়া বা বাঁশের বাঁশির শব্দ; ভয়ানক বিকট আওয়াজ তোলা ভুভুজেলার শব্দ নয়।

কানের কাছে অনবরত একটা বিকট আওয়াজ হতে থাকলে তা সহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাছাড়া এক ধরনের উঠতি বয়সের তরুণ মেলায় আসা তরুণীদের উত্যক্ত করার হাতিয়ার হিসেবে এ যন্ত্রটিকে ইদানিং বেশ ভালোভাবেই ব্যবহার করে চলেছে।

পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের জন্যও এই বাঁশি মারাত্মক একটি হুমকি। এক সাথে অনেকগুলো ভুভুজেলা বাজলে যে মাত্রার শব্দ উৎপন্ন হয় তা মানুষের স্বাভাবিক শ্রবণসীমার দ্বিগুণ। উচ্চমাত্রার এ শব্দ শ্রবণযন্ত্রকে শুধু ক্ষতিগ্রস্তই করে না, নষ্টও করে দিতে পারে। শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত করার পাশাপাশি উচ্চস্তরের এ শব্দ স্নায়ুবিক দুর্বলতা, হৃদযন্ত্রের সমস্যাসহ একাধিক রোগের কারণ হতে পারে।

বছর কয়েক ধরে আমাদের সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রীয় উৎসবগুলোতে এত ব্যাপকভাবে ভুভুজেলা বাজানো হচ্ছে, যা দেখলে মনে হয়, আবহমানকাল ধরেই আমরা যেন বাজিয়ে আসছি এই বাঁশি। এটাই যেন আমাদের আপন ঐতিহ্য, পরম্পরা, সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ। বিবিধ ক্ষতিকারক দিক বিবেচনায় রাষ্ট্রের উচিত হবে এ ধরনের বিজাতীয় ক্ষতিকর বাদ্যযন্ত্রের উৎপাদন ও ব্যাপকতা রোধে প্রদক্ষেপ নেয়া। সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রীয় উৎসবগুলোর তাৎপর্য, স্বকীয়তা এবং নির্বিঘ্নতা বজায় রাখার স্বার্থেই রাষ্ট্র ও প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে হবে। অনুষ্ঠানের  পরিবেশকে করে তুলতে হবে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ। আশা করি, পরবর্তী উৎসবগুলোতে এ ধরনের ক্ষতিকর উপাদান থেকে বিরত রাখবার জন্য সরকার যথাযথ প্রদক্ষেপ নেবে।

আদম অনুপম, adam.anupam@yahoo.com

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৬, ২০১৫
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।