গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর মাধ্যমে জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের মতামতের প্রতিফলন ঘটায়।
প্রসঙ্গত বলতেই হয়, এর আগে দেশবাসী স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আর কোনো দিন এমন নির্বাচনী উৎসবের আমেজ দেখেছে বলে আমার জানা নেই। সবার অংশগ্রহণের ফলে এই নির্বাচন বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সবার তৎপরতায় এই নির্বাচন ভোটারদের মাঝে অন্যরকম এক উৎসবের আমেজ তৈরি করেছে। নির্বাচন উপলক্ষ্যে এখন রাজধানী ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলছে অন্যরকম উৎসবের আমেজ। প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা শেষ, নির্বাচন কমিশনের সব প্রস্তুতিও সম্পন্ন। ভোটাররা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই ভোটারদের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
কিন্তু এরপরও এই নির্বাচন নিয়ে একটি বিশেষ পক্ষের নানা অপকৌশল ও ছলচাতুরির কমতি নেই। ফলে একজন সচেতন নাগরিক ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের একজন সাবেক মেয়র হিসেবে নিজের দায়িত্ববোধ থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামবাসীর সাথে আমার কিছু কথা শেয়ার করতেই আজকের এই লেখা।
আমরা সবাই জানি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নাগরিক সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে মহাজোট সরকারের বিগত মেয়াদে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন বিভাজন হওয়ার পর এটিই প্রথম নির্বাচন। তবে ডিসিসির ইতিহাসে এটি তৃতীয় নির্বাচন। এর আগে দুটি নির্বাচন হয়েছে ১৯৯৪ সালে এবং ২০০২ সালে। তবে ২০০২ সালের একতরফা নির্বাচনে তৎকালীন বিরোধীদল (আওয়ামী লীগ)কোনো প্রার্থী না দিয়ে নির্বাচন বর্জন করায় সাদেক হোসেন খোকা বলতে গেলে অনেকটা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে দীর্ঘদিন ক্ষমতা ভোগ করে।
অবশ্য এর আগে ১৯৯৪ সালের নির্বাচনটি ছিলো বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও জমজমাট। সেই নির্বাচনে আজকের ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওয়ামী সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকনের বাবা মরহুম মোহাম্মদ হানিফ সাহেব বিপুল ভোটের ব্যবধানে ঢাকা দক্ষিণের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মির্জা আব্বাসকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছিলেন। এছাড়া মরহুম হানিফ সাহেবের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ও ঢাকাবাসীর কল্যাণে তাঁর জীবন ও কর্মের কথা তো আমাদের সবার জানা। থাক এসব কথা, ফিরে আসি আজকের প্রেক্ষাপটে-
আমরা সবাই জানি, নানাদিক থেকেই এই নির্বাচনটি বেশ গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ । বিশেষ করে দীর্ঘ সময় ঢাকা সিটির নির্বাচন না হওয়ায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে জনসেবার ক্ষেত্রে ঢাকাবাসীর যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তা দ্রুত নিরসন একান্ত অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ফলে জনগণের সমস্যার কথা বিবেচনায় বর্তমান সরকার ইতোপূর্বে বেশ কয়েকদফা এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করে।
কিন্তু জাতীয় রাজনীতির নানা ঝঞ্ঝাট একে ঘিরে রাখে। অবশেষে নির্বাচন কমিশন গেল মার্চ মাসে তফসিল ঘোষণার পর থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামবাসী নির্বাচনমুখী হয়ে উঠে। অন্যদিকে স্বাধীনতা বিরোধী বিএনপি-জামায়াত চক্র নির্বাচন কমিশনের এই উদ্যোগকে বানচাল করতে নানা অপচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে অবশেষে পেট্টোলবোমা তথা মানুষ পুড়িয়ে মারার কর্মসূচি ছেড়ে নির্বাচনমুখী হয়।
এতে এই নির্বাচনকে ঘিরে দেশের অশান্ত পরিস্থিতিও হয়ে উঠে শান্ত। তিন মাস ধরে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকা বিরোধী জোটও কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে এসে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ফলে এই নির্বাচন এক শান্তির প্রতীকে পরিণত হয়। সরকার এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিক ক্ষমতা যথাযথভাবে প্রযোগের আহবান জানায়।
আর নির্বাচন কমিশনও তাদের সাংবিধানিক ক্ষমতা বলে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। কিন্তু আমরা কী লক্ষ্য করছি- একটি বিশেষ দল ও তাদের সহযোগীরা তাদের অতীত কর্মের কারণে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে এই নির্বাচনে পরাজয়ের ভয়ে নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে নানা ধরনের ছলচাতুরী ও অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে।
তারা নির্বাচনী মাঠে জনরোষে পড়ে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। তারা এমন সব ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলছে যার বাস্তবতার সাথে কোনো মিল নেই। এসব কিছুর মূলে অবশ্য ইতোমধ্যে তারা নির্বাচনী হাওয়ায় জনমতের প্রতিফলনটা কেমন হতে পারে তা বুঝে গেছে। যার ফলে তারা এসব নাটক মঞ্চস্থ করে চলেছে।
তবে গত কয়েকদিন ঢাকা সিটির বিভিন্ন এলাকার অলিগলি ঘুরে আমার যতটুকু মনে হয়েছে তাতে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত ঢাকা দক্ষিণ সাঈদ খোকনের ইলিশ প্রতীক আর ঢাকা উত্তরের আনিসুল হকের ঘড়ি প্রতীকের পক্ষে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে তা সত্যিই বিরোধীদের আতে ঘা লাগার মতোই। তরুণ সমাজ থেকে শুরু করে আবালবৃদ্ধ বনিতা ভোটারদের সবার মুখে মুখে এখন সাঈদ-খোকন আর আনিসুল হকের নাম। আর কেনইবা হবে না, মরহুম মোহাম্মদ হানিফ বাদে এমন স্বচ্ছ মেয়র প্রার্থী ইতোপূর্বে ঢাকাবাসী পেয়েছে বলে তো আমার জানা নেই। যাদের মাঝে রয়েছে এখনো তারুণ্য, ব্যাপক কর্মস্পৃহা, নতুন নতুন উদ্যম ও মানবসেবার অদ্যম স্পৃহা। চট্টগ্রামেও আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আ জ ম নাছির উদ্দিনের পক্ষে একই ধরনের গণজোয়ার। কেনইবা হবে না, তারা তো একবাক্যেই পরিচিত মুখ, তাদের সবকিছুই জনগণের নখদর্পনে। অন্যদিকে আমরা যদি প্রধান বিরোধী প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রতি একটু খেয়াল করি তবেই সবার চোখের সামনে ভেসে উঠবে তাদের অন্ধকার অতীত জীবনের নানা ভেজাল কর্মের প্রতিচ্ছবি। ফলে এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে সবাই এখন ভোট দেয়ার অপেক্ষায়।
পরিস্থিতির দেখে আমার যা মনে হয়েছে তাতে, বিরোধীরা এখন ভরাডুবির ভয়ে আতঙ্কিত। ফলে তারা নানা ধরনের ছলচাতুরি করছে। নারায়ণগঞ্জ সিটির মতো নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও জনরোষের ভয়ে হয়তো তারা সেটা করতে পারছে না। কিন্তু নির্বাচনকে বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তারা এখন ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনী পরিবেশকে ক্রমেই অশান্ত করার চেষ্টা করছে। সেই সাথে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টাও করছে।
এরই অংশ হিসেবে আমরা ইতোমধ্যে লক্ষ্য করেছি- চট্টগ্রামে টাকার বিনিময়ে ভোট কিনতে গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়েছে এক বিএনপি নেতা। অন্যদিকে তারা এবারও একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। এছাড়া বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া নির্বাচনী বিধি লঙঘন করে বিশাল গাড়িবহর নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে গত কয়েকদিন জনরোষের শিকার হয়েছেন। যদিও সেটার দায় সরকার ও আওয়ামী লীগের উপর চাপানোর অপচেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সে কৌশল হালে পানি না পেয়ে অবশেষে আমরা কী দেখলাম, গত রোববার সংবাদ সম্মেলন ডেকে মিডিয়ার সামনে চোখের জল ফেলে আবেগ ছড়িয়ে ভোটারদের এক ধরনের বিভ্রান্ত করার চেষ্টাও করা হয়েছে। যদিও এটা এক ধরনের নির্বাচন আচরণবিধি লঙঘনের মধ্যেই পড়ে।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যে নির্বাচনে কোনো না কোনো পক্ষের জয়-পরাজয় তো হবেই সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটা মেনে নেয়ার মতো কোনো মানসিকতা বিএনপির মধ্যে এ পর্যন্ত আমরা দেখতে পারছি না। আমরা লক্ষ্য করছি- নির্বাচন যতই সুষ্ঠু হোক না কেন, তারা বিজয়ী না হলে সে নির্বাচন তাদের কাছে সুষ্ঠু বলে গণ্য হবে না। অর্থাৎ ‘বিচার যাই হোক, তাল গাছটা আমার’ এমনটিই আমরা ইঙ্গিত পেয়েছি হতাশাগ্রস্ত বিএনপি নেত্রীর সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য থেকে। ফলে নির্বাচন যত স্বচ্ছই হোক, তাদের প্রার্থী বিজয়ী না হলে যে তারা আবারো দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির অপচেষ্টা করবে এটা জনগণের বুঝতে বাকি নেই।
তাই এই তিন সিটি নির্বাচনের আগের দিন একজন সাবেক মেয়র হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রামবাসীর প্রতি বেশ কয়েকটি অনুরোধ রাখতে চাই-
এক. আপনারা কারো অপপ্রচার ও চোখের পানির আবেগে বিভ্রান্ত হবেন না। আপনারা নিজেদের বিবেচনায় যোগ্য, সৎ ও সত্যিকারের দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের প্রার্থীকে আপনাদের মূল্যবান ভোট প্রদান করে বিজয়ী করুন। আমার ৫ বছরের অভিজ্ঞতায় বলতে পারি-ঢাকা সিটির মতো নগরীর মেয়র পদ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ। শুধু দল বা পেশিশক্তির বলে কেউ পদ দখল করতে পারলেও যোগ্যতা না থাকলে নগরীর উন্নয়ন করা তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
দুই. গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচনে যেতে যারা ভয় প্রায় এবং নিজেদের দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা করে না, এমন গোষ্ঠীর সমর্থিত প্রার্থীদের নির্বাচনে ভোটদান বিরত থাকুন। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও নানা কেলেঙ্কারীর অভিযোগ রয়েছে এমন প্রার্থীদেরও বয়কট করুন।
তিন. বিগত দিনে যারা রাজনীতির নামে দেশবাসীকে দীর্ঘদিন জিম্মি করে রেখে রাজপথে সন্ত্রাস-নৈরাজ্য করেছে। পেট্রোলবোমায় পুড়িয়ে খেটে খাওয়া মানুষকে হতাহত করেছে। ভবিষ্যতেও যাদের হাতে দেশ ও দেশের মানুষ নিরাপদ নয়। ফলে এদেরকে নির্বাচনে ভোট দান থেকে বিরত থাকুন।
চার. বিগত চার সিটি নির্বাচনে জনগণ যে কতটা ভুল করেছে তা আজ রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটবাসী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ওই চার সিটিতে নির্বাচিত মেয়ররা মানবসেবা বাদ দিয়ে তাদের নেত্রীর আদেশ তামিল করতে গিয়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। যার ফলে আজ জনগণের সেবাদান তো দূরের কথা, জনগণের কাছে তারা আজ অমাবর্সার চাঁদ। তাই নতুন করে আপনারা কারো অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে ভুল করবেন না। নিজ নিজ সিটির উন্নয়নের ধারাবাহিতা বজায় রাখার স্বার্থে যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করুন।
পাঁচ. সন্ত্রাস-নৈরাজ্য ও দুর্নীতিকে না বলুন, শান্তি ও উন্নয়নকে হ্যাঁ বলুন।
সবশেষে নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহবান রাখবো- দেশবাসী একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়। তাই ভোটাররা যাতে নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন সেই ব্যবস্থা করার দায়িত্ব আপনাদের। নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করার জন্য আপনারা সাংবিধানিক ক্ষমতা যথাযথভাবে প্রযোগ করুন। বিরোধীপক্ষ যেভাবেই বাঁকা চোখে দেখুক না কেন, দেশবাসী মনে করছে নির্বাচন কমিশন আগামীকাল (মঙ্গলবার) একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে সক্ষম হবে। আমাদেরও প্রত্যাশা- নির্বাচন কমিশন এমন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেবে যা ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের জন্য এক মাইলফলক হিসেবে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। অন্যথা এর দায় নির্বাচন কমিশনকেই নিতে হবে। তিন ঢাকা দক্ষিণ, ঢাকা উত্তর ও চট্টগ্রাম সিটির ভোটার ও যোগ্যপ্রার্থীদের শুভকামনা করে আজ এখানেই শেষ করছি।
জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু, গণতন্ত্রকামী মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হোক।
লেখক: এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, সাবেক মেয়র রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন
বাংলাদেশ সময়: ১৯৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৭, ২০১৫
জেডএম/