শ্রীমঙ্গল: আমিনা বেগম। গ্রামের এক দিনমজুরের নাম।
শ্রীমঙ্গল উপজেলায় মাস চারেক আগে কোনো এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। কিছু নারীর জটলা আর কথাকাটাকাটি দেখে এগিয়ে গেলাম। নিজের পরিচয়টুকু তাদের সামনে তুলে ধরতেই এক ধরনের প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে গেলেন তারা; কে কার আগে নিজের মনের জমাটবদ্ধ অভিমানটুকু-ক্ষোভটুকু মেলে ধরবেন এ নিয়ে; নিজের ন্যায্য পাওনা বঞ্চিত হওয়ার কথা কে আগে বলবেন- এ নিয়ে
আসলে, এমন দৃশ্য অনেকবারই দেখেছি। গভীর মনোযোগ দিয়ে তা প্রত্যক্ষ করেছি। কোনো সহজ-সরল মানুষ যখন অপর একটি জটিল মানুষের কূটকৌশলের জালে জড়িয়ে পড়ে পরাজয় বরণ করতে থাকেন, তখন তারা মনে করেন সংবাদকর্মীরাই তাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল। সংবাদকর্মীরাই পারেন তাকে বিপদের হাত থেকে উদ্ধার করতে। তার প্রতি অন্যায় বা অন্যায্য আচরণ করার বিষয়টি তিনি যদি গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন, তাহলেই সত্যঘটনা আলোর মুখ দেখবে। ফিরে আসবে তার হৃদয়ে কিছুটা শান্তি-সুখ।
সেদিন আমি একজন আমিনা বেগম নয়- অনেকগুলো আমেনা বেগমকে একসঙ্গে খুঁজে পেয়েছিলাম। অভিন্ন অভিযোগের সুর তুললেন একত্রে। প্রায় বিশ মিনিট সময় ব্যয় করার পর তখন ওই আমিনাদের আমি কথা দিয়েছিলাম; তাদের এলাকায় একদিন যাবো। সবার কথা তুলে ধরবো। কিন্তু ব্যস্ততার দরুণ যাওয়া আর হয়নি। তবে যাবার তাগিদ এখনও জীবিত রয়েছে মস্তিষ্কে।
আজ মে দিবস উপলক্ষে কিছু লিখতে বসেই কী-বোর্ড হয়ে একটি নাম বেরিয়ে আসছে; তিনি আমিনা বেগম। একজন নয়। অনেকগুলো আমিনা বেগমের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। অনেকগুলো আমিনা বেগমের প্রজ্জ্বলিত মুখশ্রী ভেসে উঠছে স্মৃতিতে। আমিনা বেগমরা কখনোই ন্যায্য পারিশ্রমিক পান না। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-কাউন্সিলররা ঠিক মত মুজুরি দেন না তাদের। চার মাস কাজ করেন; এক মাসের বেতন ধরিয়ে দেওয়া হয় তাদের হাতে। প্রতিবাদ করলে পুলিশ, মামলা, নির্যাতন প্রভৃতির ভয়-ভীতি দেখান প্রভাবশালীরা জনপ্রতিধিরা।
এমনটি যেন আমাদের মে দিবসের ভেতরকার চিত্র। আমিনা বেগমদের কষ্টের গল্প। কিছু যে করার নেই তাদের। শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের রক্তক্ষয়ী আত্মত্যাগের যে সংগ্রামী ইতিহাস এখানে জড়িয়ে আছে; তার কোনো খবরই জানেন না শ্রীমঙ্গলের আমেনা বেগমরা। শ্রমিকদের স্বীকৃত অধিকারের অনেকটাই ভূ-লুণ্ঠিত এখানে।
আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্র সুযোগ করে দিয়েছে বঞ্চিত, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিককে তার ন্যায্য পাওনা আদায়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ায়। কিন্তু নুন আনতে পানতা ফুরানোর মতো আমিনা বেগমদের কী হবে? পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিদ্যমান শ্রমআইনের সংস্কার জরুরি হয়ে পড়ছে। কোনো কোনো খাতের শ্রমিক শ্রেণী শ্রম আইনের আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কল-কারখানায় কর্মরত শিশু শ্রমিক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকলেও স্বল্প মজুরিতে আট ঘণ্টার অধিক সময় শ্রম দিতে বাধ্য হচ্ছে। গৃহকর্মী, শিশু-নারী নির্বিশেষে বঞ্চিত শ্রম বিনিয়োগের বিধিবদ্ধ সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে। আমিনা বেগমের মত কোটি কোটি মেহনতি মানুষের পূর্ণ অধিকার এখন প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়েছে- এমন দাবি কিছুতেই করা চলে না।
তাহলে, আমিনা বেগমদের কথা আমরা কি একটু ভেবে দেখতে পারি না? নিজেদের অবস্থান থেকে তাদের জন্য সামান্য কিছু করতে পারি না? এসব শ্রমিকদের ন্যায্য অর্থ এভাবে আত্মসাতের মাধ্যমে মে দিবস কে কলঙ্কিত করছেন যারা, সেসব কর্তাব্যক্তিদের ধিক্কারের আগুনে পোড়াতে পারি না? আমরা কি বলতে পারি না- 'তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে'।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২৮ ঘণ্টা, মে ০১, ২০১৫
এইচএ