আজবই তো! জলকে যে ভয় পায় তাকে যদি বলা হয়, ‘‘যাও গিয়ে মাঝনদীতে কিস্তি ভাসাও গে’’, তাহলে কেমন হয় ব্যাপারটা? নদী তো নদী! বরং আমাকে বলা হলো অচেনা সায়রে গিয়ে কিস্তি ভাসাতে! ভণিতা এখানেই শেষ। এবার আসল কথায় আসি।
আমি-- যাকে বলে-- আগাগোড়া প্রযুক্তি-ভীত এক বেফিকির বান্দা! যন্ত্র, প্রযুক্তি এসবের কথা শুনলে বা দেখলে ভয়ে ‘দে ছুট দে ছুট’ অবস্থা আমার। ছুরি-কাঁচি নয়, অতি গোবেচারা যন্ত্র যে টাইপরাইটার, সেটি থেকেও থাকতাম দশহাত দূরে। ৮০ দশকের গোড়ায় বন্ধুদের শত অভয়বাণী শোনার পরও টাইপ রাইটারে টাইপ করা শেখা হয়নি। আর কম্পিউটার? সকল-কাজের-কাজী এই যন্ত্রটির ধারেকাছে ঘেঁষতাম না! নববুইয়ের দশকের গোড়ায় কাগজের পত্রিকায় অন্যসব বন্ধু-সহকর্মীরা যখন কম্পিউটার-বিদ্যায় হাত পাকিয়ে দিব্যি ‘হরফুন মওলা’ বন গ্যয়া, এই অকৃতী-অধম তখনও খসখসে নিউজপ্রিন্টে কলম পেষাতে ব্যস্ত। পত্রিকার কর্তাব্যক্তিদের তাগিদ এমনকি চোখ-রাঙানি কিছুতেই কিছু হয়নি। একে একে বাংলাবাজার, জনকণ্ঠ, মুক্তকণ্ঠ, প্রথম আলো---কোনোখানেই কম্পিউটারের প্রেমের ফাঁদে ধরা দেয়নি এই বান্দা।
এভাবেই দিব্যি চলছিল। ২০০৫ সালের কোনো এক শীত-বিকেলে যায়যায়দিন পত্রিকায় বন্ধু-সহকর্মী-লেখক শিবব্রত বর্মন করলেন সেই অসাধ্য সাধন। ‘কতদমশন’ --কম্পিটারের কী-বোর্ডে খেলাচ্ছলে শিখিয়ে দিলেন কম্পোজ করার এক নতুন খেলা। এরপর একটু-আধটু ইন্টারনেট চালানো। ব্যস! এটুকুই। এরপর গেলাম সমকাল পত্রিকায়। সেখানেও আমার প্রযুক্তিজ্ঞান বলতে ওই ‘থোড়বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়’---সম্পাদনার কারণে একটু আধটু কম্পিউটার আর ইন্টারনেট চালানো আর ই-মেইল চালাচালি। সেই টেকনো-অধমকেই কিনা তরী ভেড়াতে হলো প্রিন্ট মিডিয়া থেকে অজানা-অচেনা অনলাইন পত্রিকার জগতে। এখন সে গল্পটাই বলি।
এসবের জন্য দায়ী একজন। তিনি আলমগীর হোসেন। আমাদের সবার প্রিয় আলমগীর ভাই। সমকালে তিনি ছিলেন নির্বাহী সম্পাদক। আর আমি জয়েন্ট নিউজ এডিটর। তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলেন গেলেন। আমি তখন প্রমোশন-টমোশন পেয়ে উচ্চতর পদে। একদিন তার ফোনকল এলো: ‘জুয়েল, একটা অনলাইন পত্রিকা করবো। আপনাকে চাই। ’
কথা শুনে আমার তো আক্কেল গুড়ুম! (আগেই জানতাম বাংলাদেশে অনলাইন পত্রিকার পথিকৃৎ ও জনক তিনিই। বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর.ডটকম নামের পত্রিকাটি দিয়েই বাংলাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতার পথরচনা করেছিলেন। )। তো যে কথা বলছিলাম, আলমগীর ভাই এমন একজন যার কথা ফেরানোর সাধ্য আমার ছিল না কখনো। কিন্তু তিনি সবকিছু জেনেও আমার মতো টেকনো-আনাড়ি বান্দাকে কিনা বলছেন অনলাইন সাংবাদিকতায় নাম লেখাতে! পড়েছি মোগলের হাতে...! তিনি অভয় দিলেন ‘এসব কোনো ব্যাপারই না জুয়েল। ’ আমিও ভাবলাম, ‘দেখিই না একবার... যা হবার হবে’। নিজেকে শোনাচ্ছি: ‘পারিব না একথাটি বলিও না আর..’। বলছি তো বলছি, কিন্তু এদিকে যে টি.এস এলিঅটের কবিতার নায়ক জে. আলফ্রেড প্রুফ্রকের মতো আমার ভেতরের-অন্য-এক-আমি আমাকে শোনাচ্ছে: ‘পারবো তো পারবো তো...?’। হ্যাঁ, আমিও পারলাম অবশেষে। অন্যদের মতো না হলেও একটু একটু করে! আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগের বদৌলতে যেন চোখের সামনে প্রতিদিনই খুলে যাচ্ছে একের পর এক জাদু-দরোজা।
হ্যাঁ, আজ থেকে পাঁচ বছর আগে—২০১০ সালের ১ জুলাই-- এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা ঘটিয়ে ফেললাম সেই ঘটনাটি---আত্মপ্রকাশ করলো বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। আজ সেটি সারাবিশ্বে বাংলাভাষার ‘লার্জেস্ট অনলাইন নিউজ পোর্টাল। ’
আমি নিজে এযাবৎকালে প্রিন্ট মিডিয়ায় যেটুকু সাংবাদিকতা শিখেছিলাম, বাংলানিউজে এসে শিখলাম নতুন আরো অনেক কিছু; প্রিন্ট মিডিয়ার থেকে আলাদা অনেক কিছু। আরো শিখলাম, বাসী খবর বিকোনোর দিন শেষ। এ-যুগে, প্রযুক্তির এই শনৈ: শনৈ: উৎকর্ষের যুগে, এই সুপার ফাস্ট, ন্যানো টেকের যুগে ১২ ঘণ্টা-১৮ ঘণ্টার পুরনো হয়ে-যাওয়া খবর বিলানো যাবে না আর। এখন শুরু হয়েছে সাংবাদিকতার নতুন যুগ --–‘যখনই ঘটনা তখনই সংবাদ’! চোখের সামনে দেখলাম আর শিখলাম ঘটনা ঘটামাত্র-জানামাত্র তা জানাতে হবে পাঠককে। হলোও তাই—মিনিটে দু’মনিটেই যেকোনো ঘটনার খবর আপলোড হয়ে যাচ্ছে বাংলানিউজে! আর পাঠক--তিনি দেশেই থাকুন বা বিদেশে, আফ্রিকায় থাকুন বা থাকুন অ্যামাজন নদীর কিনারে, থাকুন স্পেনে কিংবা খাইবার গিরিপথের পাশের কোনো লোকালয়ে, লেকিন কুছ পরোয়া নেহি— ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যেই খবরটি পেয়ে যাবেন তার মোবাইলে বা কম্পিটারের পর্দায়। শুধু কি খবর? সেই সঙ্গে ঝকঝকে ছবি --–মায় অডিও আর ভিডিও ভার্সনটাও।
‘ঘর আর বিদেশ-আঙ্গিনা’ সব এক হয়ে গেছে অনলাইনের জাদুতে। এখানে গাছ কেটে, বন ধ্বংস করে, প্রকৃতি পরিবেশ-প্রতিবেশের বারোটা বাজিয়ে টনকে টন কাগজ ধ্বংস করে কাগুজে পত্রিকার মতো মোচ্ছব করতে হয় না! ছাপাখানা লাগে না এর। লাগে না তেল-মোবিল, লাগে না হকারের কাছে জিম্মি হওয়ার ঝক্কি নেওয়া, গাড়িভর্তি করে দেশের আনাচে-কানাচে সাত সকালে পত্রিকা পৌঁছানোর দায়ও নিতে হয় না।
‘গো অনলাইন’ –এটাই স্লোগান আজ দুনিয়ার দিকে দিকে। দেরিতে হলেও প্রিন্ট মিডিয়াও সেটা বুঝতে শুরু করেছে ---এমনিতে নয়, ঠেকায় পড়ে। ‘নিউজ উইক’সহ কতো পত্রিকার যে ত্রাহি-অবস্থা আজ, সেটাও সবাই দেখছে। তো এভাবেই রাই কুড়াতে কুড়াতে বেল! এই আমি, এই টেকনো আনাড়ি আমিও অনলাইনের আজব দেশে এসে দিব্যি কিস্তি ভাসিয়ে চলেছি।
শুরুতেই যেমনটা বলেছিলাম, দায়টা যার কৃতিত্বটাও যে তারই! আই মিন আলমগীর হোসেনের। যিনি আমার মতো অনিচ্ছুক ঘোড়াকেও জল খাইয়ে ছাড়লেন আর করে তুললেন অনলাইন-দৌড়ের ঘোড়া! নিছক ছেঁদো কথায় তার ঋণ শোধ করতে চাই না। কিছু ঋণ আছে যা কখনো পরিশোধ করতে হয় না। ঋণী থাকলেই যেহেতু লাভ, সেহেতু তাঁর কাছে ঋণখেলাপি থেকে যাওয়াই তো ভালো!
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৩ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০১৫
** ষষ্ঠ বছরে বাংলানিউজ, কিছু উপলব্ধি