মেয়েটি তখন ছেঁড়া কম্বলটাকেই সম্বল করে গায়ে জড়িয়ে কুঁজো বুড়ির মতো বসে নির্বাক চেয়ে আছে। এ দৃশ্য দেখে হৃদয় ব্যাকুল হলো এক পর্যটকের।
কাছে এলেন তিনি। দেখলেন, হতভাগা মেয়েটি মানসিক ভারসাম্যহীন। টাকা দিতে চাইলেও নিতে রাজি হলো না সে। কিছু খাবার কিনে দেওয়ার পর হাত বাড়ালো মেয়েটি।
খাবার দিতে পেরে খুশি হলেন সেই পর্যটক। কিন্তু সেই খুশির রেশ শেষ হয়ে গেল একটি দৃশ্য দেখে। মেয়েটি হাত বাড়ানোর সময় তিনি দেখলেন, তার গায়ে কোনো কাপড় নেই।
দ্রুত ব্যবস্থা করে স্থানীয় এক নারীর মাধ্যমে তাকে কাপড়ের পরানো হলো।
বান্দরবান জেলার থানচিতে এভাবেই আবিষ্কার হলো মানসিক ভারসাম্যহীন একটি মেয়ের। তার পারিবারিক নাম- শিউলি রানী সরকার। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার শাহ্জাদাপুর গ্রাম থেকে স্বামী ফালান সরকার ও তিন সন্তানের কাছ থেকে হারিয়ে যায় সে।
বেড়াতে যাওয়া সহকর্মী বন্ধুদের সঙ্গে সেই পর্যটক ঢাকায় ফিরে এলেন। কিন্তু তার মনটা পড়ে থাকলো থানচির ওই মেয়েটির কাছে। কী খায়, কী পরে, কোথায় যায়, আহা রে...!
মনে মনে ভাবলেন তিনি, আমি তাকে মেয়ের ভালোবাসা দেবো। ঢাকায় এনে সুস্থ করাবো। বিষয়টি নিয়ে সহকর্মী-বন্ধু আলী সাব্বির এবং হাসান ফরহাদ আজাদের সঙ্গে আলোচনা করলেন। তারাও উৎসাহ দিলেন। তারা ঠিক করলেন, মেয়েটিকে ঢাকায় নিয়ে আসতে হবে। যে কথা, সেই কাজ।
মেয়েটির খোঁজে একদিন বান্দরবানের থানচিতে গিয়ে পৌঁছালেন তারা। কিন্তু তাকে না পেয়ে হতাশ হলেন তারা। তাদের একটাই চিন্তা, যে করেই হোক মেয়েটিকে খুঁজে বের করতেই হবে।
লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতে করতে এবং ঘুরতে ঘুরতে শেষে ১২ কিলোমিটার দূরে নিভৃত এক পল্লীতে খুঁজে পাওয়া গেল মেয়েটিকে।
স্থানীয় প্রশাসন, বাজার কমিটি ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয়। তখন স্থানীয় এক নারীর সাহায্যে তাকে জামা-কাপড় পরিয়ে মাথার জট বাঁধা চুল কেটে পরিচ্ছন্ন করে ঢাকায় এনে শেরেবাংলা নগর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হলো তাকে।
এরপর মেয়েটির নাম রাখা হলো- ‘অন্তর’। চিকিৎসা চললো। মেয়েটির মুখ থেকে হঠাৎ করে দুটি শব্দ বের হলো- চান্দুরা ডাকবাংলা। এ কথা শুনেই তারা অনুসন্ধান শুরু করেন। ফেসবুকেও যোগাযোগ চললো।
এরপর চান্দুরার চেয়ারম্যান শামিমুল হক চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। মেয়েটির ছবি দিয়ে পোস্টার করে বন্ধুরা মিলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে গিয়ে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পোস্টারিং করেন।
কয়েকদিন পর মেয়েটি আবার কয়েকটি নাম বলতে পারলো। তার মুখ দিয়ে উচ্চারিত হলো- সাগর, হৃদয়, লিপি।
ঢাকা থেকে ফের যোগাযোগ করা হলো চান্দুরার চেয়ারম্যানের সঙ্গে। সাগর, হৃদয়, লিপির খোঁজ করে করে হারানো সেই মায়ের ঠিকানা বের করা হলো। বাড়ির লোকজনদের ঢাকায় আসতে খবর দেওয়া হলো।
আত্মীয়-স্বজনেরা শ্যামলীর আদাবরে গিয়ে বুকের সেই হারানো ধন খুঁজে পেলেন। সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে গেলেন পাঁচ বছর আগে হারানো শিউলি রানী সরকার। ফালান সরকারও খুঁজে পেলেন তার হারানো জীবন সঙ্গিনীকে। সাগর, হৃদয় ও লিপি এ সময় তাদের মায়ের বুকে মাথা রেখে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছলো।
আনন্দের এ ঝিলিক দেখে বাবাতুল্য সেই পর্যটক শামীম আহমেদও অশ্রুজলে সিক্ত হলেন।
বাবার মর্যাদায় অভিষিক্ত শামীম আহমেদের নেতৃত্বে তারই দেওয়া নাম ‘অন্তর’-কে (শিউলি রানী সরকার) স্বামী, সন্তান ও পরিজনের কাছে তুলে দেওয়া হয়, আজকের এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
স্বতঃস্ফূর্ত মনে স্যালুট জানাই সেই পর্যটক ঢাকার যমুনা ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান জনাব শামীম আহমেদকে।
আসুন, আমরা শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করি এবং সহযোগিতার হাত বাড়াই!
লেখক- সাংবাদিক ও কলামিস্ট
বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ০২, ২০১৫
এবি/