ডর্টমুন্ড (জার্মানি) থেকে : আমি যে স্পোর্টস পার্কটায় কাজ করি সেখানে শহর কর্তৃপক্ষ পরিচালিত দুটি স্কুলও আছে। এখন সামার ভ্যাকেশন চলছে।
গত মঙ্গলবার সকালের কথা। আমরা ক্লাসরুমের সরঞ্জামাদি সেটিংয়ের কাজ করছি। হঠাৎ নারীকণ্ঠ শুনলাম। ‘কম রাউস, কম রাউস’... মানে হলো, বাইরে আসো, বাইরে আসো। এই কমপ্লেক্সে আমি ওই নারীকে আগে দেখিনি। তার চোখে-মুখে ব্যাপক আতঙ্ক। গ্রিটিংস জানালাম, তিনি খেয়ালই করলেন না। পরে জানলাম তিনি এই রেনোভেশন কর্মকাণ্ডের পরিচালক, নাম ক্লাউডিয়া।
জনা বিশেক কর্মীর সঙ্গে আমিও বাইরে বের হলাম। অন্যদের মতো আমার মধ্যে ক্ষিপ্রতা নেই। ‘ভোয়াজ ইস্ট লোছ?’ - কী হয়েছে ---এ ধরনের প্রশ্ন পরস্পরকে করা হচ্ছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো জবাব নেই। বাইরে এসে দেখি সবাই সিগারেট ধরাচ্ছে রিলাক্স মুডে। কেউ বলে- গ্রিলপার্টি হয়ে যাক! আমি তো ভাবলাম, কারও জন্মদিন উদযাপন করতেই সবাই একযোগে বাইরে নেমে এলো কিনা! কারণ এমন মজা জার্মানরা করেই থাকে।
কিছুই বুঝতে পারছি না। ওদিকে হঠাৎ শুনছি গগণবিদারী শব্দে ফায়ারসার্ভিসের গাড়ি কোথাও যাচ্ছে। ততক্ষণে একজন বললো, আন্ডারগ্রাউন্ডে কোথায় নাকি ধোঁয়া দেখা গেছে। আমি সবকিছুর সূত্র মেলালাম। সবকিছুই ঘটলো দু-তিন মিনিটের মধ্যে। আর আমি দেখলাম, ফায়ার সার্ভিসের গাড়িটা আসলে কোথাও যাচ্ছে না, এখানেই আসছে। মনে মনে বললাম, ধূর এটুকুর জন্য এতো আতঙ্ক! কোথাও তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। রিলাক্স হয়ে আমিও ধোঁয়ার পরবর্তী ঘটনা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
লালরঙা বিশাল গাড়ি এসে থামলো। ধপাধপ নামলেন অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা। টিমে নারী কর্মীও আছেন। সম্মিলিত কর্মব্যস্ততা দেখে আমি বেশ মজা পেলাম। ধোঁয়াটা যে কোথায় সেটাই তো দেখলাম না। কিন্তু বিশাল গাড়ি, পানির পাইপ আর নানান যন্ত্রপাতি নিয়ে বিশাল এক কর্মযজ্ঞের সূত্রপাত করা হলো। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে মিনিট দুয়েকের মধ্যে আরও তিনটি গাড়ি এলো। গাড়ির ওপরে নানা বর্ণের যে বাতিগুলো জ্বলছে সেগুলো সহজেই হৃদয়ে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
সবার চোখেমুখের ব্যস্ততা দেখে বাংলাদেশে দাউদাউ করে জ্বলা ঘর-বসতি কিংবা অফিস-আদালতের দৃশ্য চোখে ভেসে উঠলো। এরই মধ্যে পুলিশও চলে এসেছে। এসেছে স্থানীয় সাংবাদিকও।
ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ব্যস্ততা আমাকে একদিকে অবাক করলো, অন্যদিকে হাসালো। এমন ঘটনায় আমি মজা পেয়ে ছবি তুলতে লাগলাম। ভিডিওও করলাম একটু। আমার কৌতূহল দেখে তার্কিশ এক সহকর্মী ভাঙা ভাঙা ইংরেজি আর জার্মান মিশিয়ে বলতে লাগলেন-কলিগা নো গুড, নো গুড। (সহকর্মী-বন্ধুকে জার্মানিতে কলিগা বলা হয়)।
১৫-২০ মিনিট এভাবে চলার পর দেখি সবাইকে বলা হলো- তোমরা এবার ভেতরে যেতে পারো। কেনইবা ফায়ারসার্ভিস এলো, এতোক্ষণ তারা কিইবা করলো তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। যা-ই হোক তারও প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর আমি যখন কাজ থেকে বের হয়ে যাচ্ছি তখনও দেখি ফায়ারসার্ভিসের লোকজন তাদের ‘কাজে ব্যস্ত’। পুলিশও হন্তদন্ত হয়ে কী যেন করছে। হয়তো এই ‘ধোঁয়া’র জন্য কে বা কী দায়ী তা খোঁজার চেষ্টা করছে পুলিশ। অথচ আগুন তো দূরের কথা, ধোঁয়াটাই আমি দেখতে পেলাম না। বড় আফসোস সেটাই। পরদিন স্থানীয় পত্রিকায় সেই ‘আগুন’ এর খবরও বের হলো ফলাও করে!
ওই ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশের অঙ্গার করা আগুন আর জার্মানির না দেখা ধোঁয়ার সাথে পার্থক্য করার চেষ্টা করছি প্রতিটা মুহূর্তে। মেলানোর চেষ্টা করছি, আমাদের ভবনগুলোর নিরাপত্তা, আমাদের ফায়ার সার্ভিস আর জার্মানির ‘ধোঁয়া নির্বাপণে’র জন্য কর্মীদের শশব্যস্ততা। আর মনে মনে ভাবছি, কবে বাংলাদেশ এমন হবে যে, ‘আগুন নিভিবার পর ফায়ার সার্ভিস আসিবে না, ধোঁয়া দেখিবার আগেই তাহারা উপস্থিত হইয়া যাইবে। ‘
লেখক: জার্মান প্রবাসী সাংবাদিক, press.moni@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১২৫১ ঘণ্টা, আগস্ট ৯, ২০১৫
জেডএম