দীর্ঘ কালক্ষেপণের পর গত ২৭ আগস্ট বিইআরসি গ্যাস ও বিদ্যুতের দামহার বৃদ্ধির আদেশ দিয়েছে এবং ১ সেপ্টেম্বর থেকে এ আদেশ কার্যকর করেছে। বিইআরসি আইনের সাথে সামঞ্জস্যহীন হওয়ায় এ আদেশ আইনি কর্তৃত্ব বহির্ভূত বলে ভোক্তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
তাছাড়া ইলেক্ট্রনিক সংবাদ মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর উদ্ধৃতিতে প্রচারিত হয়েছে,সরকার আবারও বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ সংবাদে ভোক্তারা মর্মাহত। ফলে নিম্নে বর্ণিত বিষয়গুলির প্রতি আলোকপাত করা হলো:
এক
মন্ত্রণালয়ের চাপের মুখে বিইআরসি/কমিশন দামহার বৃদ্ধির প্রস্তাবগুলোর ওপর অতি দ্রুত ও স্বল্পতম সময়ে গণশুনানি করে। দামহার বৃদ্ধি হবে এবং ভূতাপেক্ষভাবে এ বৃদ্ধির আদেশ ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে- এ তথ্য বিইআরসি’র প্রতিনিধি গণমধ্যমকে শুনানি চলাকালেই অবহিত করেন। শুনানির সময় কমিশন প্রস্তাবকারীসহ সব পক্ষকে যাচিত তথ্য-উপাত্ত কমিশনের বেঁধে দেয়া সময়সীমার মধ্যে জমা দেয়ার আদেশ দেয়।
বিইআরসি আইনে বলা আছে, গণশুনানির পর তথ্য-উপাত্ত প্রাপ্তির ৯০ দিনের মধ্যে ওই সব প্রস্তাবের ওপর কমিশনের আদেশ হওয়া বাধ্যতামূলক। আইনে বেঁধে দেয়া ওই সময়সীমা এক একটি প্রস্তাবের ক্ষেত্রে এক এক সময় শেষ হয়েছে। গত মে মাসেই ওই সব সময় পেরিয়ে গেছে। অথচ কমিশনের আদেশ হয়নি। ওই সময়সীমার মধ্যে আদেশ না হওয়ায় কমিশনের আর ওই আদেশ প্রদানের আইনি এখতিয়ার থাকেনি। তাই কমিশনের এখতিয়ার বহির্ভূত হওয়ায় আইনগত বিবেচনায় ওই আদেশকে ভোক্তারা অগ্রহণযোগ্য বলেছে।
দুই
বিশ্ববাজারে ক্রমাগত জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারেও ঘন-ঘন বেশী-বেশী তেলের দামহার বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং আর্থিক ঘাটতি সমন্বয় হয়েছে। তেলের দামহার বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয়হার বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদ্যুতেও আর্থিক ঘাটতি বৃদ্ধি পায়। সে আর্থিক ঘাটতি সমন্বয়ের জন্য বিদ্যুতের দামহারও ঘন-ঘন বেশী-বেশী বাড়ানো হয়। যখনই জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে, তখনই বিদ্যুতের দামও বেড়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে তেলের দরপতন অব্যাহত আছে। ব্যারেল প্রতি বিশ্ববাজারে তেলের দর যখন ১২০ ডলার ছিল, তখন লিটার প্রতি আমাদের বাজারে তেলের দাম ছিল ফার্নেস ওয়েল ৬০ টাকা এবং ডিজেলে ৬৮ টাকা। বিগত ১ বছর ধরে বিশ্ববাজারে তেলের দর নামতে নামতে এখন ৪০ ডলারে নেমে এসেছে। অথচ আমাদের তেলের দর ওই ৬০ টাকা ও ৬৮ টাকাই রয়েছে।
দর বাড়লে সমন্বয় হয়, কমলে হবে না কেন? এ প্রশ্নের জবাবে বলা হয়, তেলের দর কমানোর সাথে সংগতি রেখে পরিবহন ভাড়া কমবে না। তাই তেলের দরপতন সমন্বয় করতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দামহার না কমালেও বৃদ্ধি করা হচ্ছে না, অপরিবর্তিত আছে, ভেবে ভোক্তারা স্বস্তিতে ছিল। তাই মূল্য বৃদ্ধিতে ভোক্তারা হতবাক হয়েছে। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিতে ওই জ্বালানি থেকে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। আবার জ্বালানির মূল্য কমলে পণ্যের মূল্যও কমবে। এ স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম না মানার সুযোগ নেই। তেলের দাম অনেক বেশী বেশী কমেছে। তাই সমতা ও ন্যায্যতার প্রশ্নে বিদ্যুতের দাম কমাতে হবে। অথচ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। ফলে ভোক্তারা ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
তিন
সরকারি ও ব্যক্তি উভয় খাতেই বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। এই উভয়ের জন্য প্লেইং ফিল্ড হিসেবে বিদ্যুৎ খাত একই রকম সমতল অর্থাৎ উভয়ের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সমতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা হলে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হতে পারে। তাতে ভোক্তা স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত হয়। ভোক্তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত করা বিইআরসি’র আইনি দায়িত্ব। মূল্য বৃদ্ধির আদেশে বিইআরসি সে দায়িত্ব পালন করেনি। যেমন: (ক) ব্যক্তি খাত বিদ্যুৎ নিজস্ব আমদানিকৃত তেলে উৎপাদন হয়। সে বিদ্যুৎ তেলের দরপতন ও ট্যাক্স-ভ্যাট মুক্ত সুবিধা পায়। এ সুবিধা সরকারি খাতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পায় না। এ ক্ষেত্রে উভয় খাতের মধ্যে সমতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা হলে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পেয়ে যে অর্থ সাশ্রয় হতো, দামহার বৃদ্ধিজনিত অর্থ সমন্বয় হয়েও সে অর্থ উদ্বৃত্ত থাকতো। (খ) ৩৭৪ মেগাওয়াট কুইক-রেন্টাল গ্যাস-বিদ্যুৎ ৮০ শতাংশেরও বেশী প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে উৎপাদন হয়। তার দামহার গড়ে ৫ টাকা। অথচ গ্যাস স্বল্পতার কারণে সরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় গড়ে ৫০ শতাংশ প্ল্যান্ট ফ্যাক্টরে। তার দামহার গড়ে ২ দশমিক ১৫ টাকা। গ্যাস সরবরাহে উভয়ের ক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত করা হলে সরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পেতো প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। (গ) তাছাড়া ন্যায্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৩৭৪ মেগাওয়াট কুইক-রেন্টাল প্ল্যান্ট-এর বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি নবায়ন না করে বা রদ করে এ প্ল্যান্টে ব্যবহৃত গ্যাসে সরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হলে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হতো। সুতরাং বিইআরসি বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে আর্থিক ঘাটতি দেখিয়েছে, তা কৃত্রিম। তার দায়ভার ভোক্তাদের ওপর চাপানো অন্যায়। আদেশ সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে হলে বিদ্যুৎ খাত ঘাটতিতে থাকতো না। ভর্তুকির পরিবর্তে মুনাফা হতো। বিদ্যুৎ খাত বর্তমানে মুনাফা হওয়ার মত পরিস্থিতিতে রয়েছে। তাই বিদ্যুতের দামহার বৃদ্ধি অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য।
চার
২০০৮ সালে গ্যাস খাত লাভে ছিল। এখনও লাভে আছে। তা সত্ত্বেও বর্ধিত সমুদয় অর্থ গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে (জিডিএফ) যাবে, সরকার কিংবা পেট্রোবাংলা কোন হিস্যা পাবে না, এমন শর্তে গ্যাসের দামহার ১১ দশমিক ২২ শতাংশ বর্ধিত হয়। সিএনজি’র দামহার বাড়ে একই শর্তে। আরো শর্ত ছিল, গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে নিয়োজিত জাতীয় কোম্পানির সক্ষমতা উন্নয়নে জিডিএফ-এর অর্থ ব্যয় হবে। তাতে সরবরাহকৃত গ্যাসে জাতীয় কোম্পানির গ্যাসের অনুপাত বাড়বে। ফলে একদিকে সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে থাকবে, অন্যদিকে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সহজ হবে। সে সক্ষমতা উন্নয়নের লক্ষ্যে কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য কমিশন পেট্রোবাংলাকে আদেশ দেয় এবং জিডিএফ-এর অর্থ ব্যবহারের একটি নীতিমালা চুড়ান্ত অনুমোদন করে। সে পরিকল্পনা প্রণয়নের আদেশ প্রতিপালিত হয়নি। বরং ওই নীতিমালা অগ্রাহ্য করে জ্বালানি বিভাগ নিজেই নীতিমালা তৈরি করে জিডিএফ-এর অবৈধ দখল নেয়। তাছাড়া গণশুনানিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত পেট্রোবাংলার প্রস্তাব মতে কমিশনের আদেশে পরিবর্তন করে লেখা হয় এবং সেমত সিএনজি’র দামহার বৃদ্ধির বর্ধিত অর্থের সিংহভাগ সরকার ও পেট্রোবাংলার মধ্যে বিলি-বণ্টন হচ্ছে। আবার জিডিএফ-এর নামে ভোক্তাদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ আংশিক জমা হচ্ছে। ভোক্তাদের পক্ষ থেকে কমিশনের কাছে পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি বিভাগকে এসব অভিযোগে অভিযুক্ত করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবেদন করা হয়েছে। গণশুনানিতে বলা হয়েছে, আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া কালতক গ্যাসের দামবৃদ্ধির আদেশ স্থগিত রাখতে হবে। অথচ কোন ব্যবস্থা ছাড়াই দাম বৃদ্ধি হলো। ভোক্তারা বিচার পেলো না।
পাঁচ
প্রতি বছর গ্যাস খাত থেকে সরকার রাজস্ব পায় ৫ হাজার কোটি টাকা, জিডিএফ-এ আসে সুদসহ ১ হাজার কোটি টাকা। পেট্রোবাংলাসহ ইউটিলিটিগুলোর প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে এফডিআর হিসেবে অলস পড়ে আছে। প্রয়োজনের তুলনায় তারা মার্জিন পায় ২-৩ গুণ বেশী। এসব অর্থ জ্বালানি খাত উন্নয়নে বিনিয়োগের উদ্যোগ নেই। গ্যাসের দাম বৃদ্ধিজনিত ওই অর্থ বিদ্যমান আইনে বিনিয়োগের সুযোগ নেই। এ-অর্থের ৫৫ শতাংশ পাবে সরকার এবং ৪৫ শতাংশ পেট্রোবাংলা। গ্যাসের সম্পদমূল্য ধারণা বিভ্রান্তিকর এবং আইনসম্মত নয়। সরকারের নির্দিষ্টকৃত নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় গ্যাসের সম্পদমূল্য নির্ধারিত না হওয়ায় ওই মূল্যের আইনি বৈধতা নেই। গণশুনানিতে তা প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত। তাই ওই মূল্যের ভিত্তিতে যেহেতু কমিশন ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দামহার বৃদ্ধির আদেশ দিয়েছে, সেহেতু সে আদেশও বৈধতাহীন।
আলোচ্য প্রেক্ষাপটে ন্যায় বিচারের স্বার্থে বিদ্যুৎ বিভাগ ও জ্বালানি বিভাগকে অনুগ্রহপূর্বক পরামর্শ দিন, তারা যেন স্ব-স্ব ইউটিলিটির মাধ্যমে বিইআরসি’র কাছে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির আদেশ পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব করে এবং পরবর্তী আদেশ না হওয়া পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধির আদেশের কার্যকারিতা স্থগিত রাখার প্রস্তাব করে। ভোক্তারা যেন ন্যায় বিচার পায়, সে জন্য আমরা আপনার সহযোগিতা চাইছি।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩১ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০১৫
জেডএম/