গাড়িচালকরা কি মানুষ নয়? চালকদের জন্য খাবারের কেন পৃথক আয়োজন? সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিবেশিত খাবারে কেন অধিকার নেই তাদের? জীবিকার জন্য জীবনটা হাতের মুঠোয় রেখে তাদের দিবারাত্রি চাকরি। প্রাণান্ত পরিশ্রম শেষে অনেক রাতের নির্জনতায় অবসাদগ্রস্ত হয়ে তারা ঘরে ফেরে।
কী নিদারুণ অর্থ কষ্টের সঙ্গে তাদের জীবনের সখ্য। কতো বিনিদ্র রাত যাপন এবং কত মেপে মেপে জীবন-যাপন। প্রতি পদে পদে কৃচ্ছ্বতা, মিতব্যয়িতা। অথচ ‘স্যার’দের কী বিবেকহীনতা! অভিজাত ক্লাব, কমিউনিটি সেন্টার ও হোটেলে আয়োজিত সামাজিক অনুষ্ঠানে অভ্যাগত অতিথিদের জন্য রাজকীয় খাবারের আয়োজন করা হলেও অতিথিদের গাড়িচালকরা থাকে চরম উপেক্ষিত। এসব অনুষ্ঠান আকর্ষণীয় খাবারের ধোঁয়া ও ঘ্রাণে ভরে গেলেও তারা বঞ্চিত হয় এর স্বাদ থেকে।
এসব ঘটনা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা এবং প্রকৃত অর্থেই তা অমানবিকতা, হীনমন্যতা। অতিথিপরায়ণ জাতি হিসেবে আমাদের গর্বিত ঐতিহ্য থাকলেও নিম্নস্তরের মানুষের প্রতি আতিথেয়তায় আমাদের আছে চরম কৃপণতা, সামন্তবাদী চেতনা। সামাজিক অনুষ্ঠানের বাহ্যিক আবরণটা কত ঝকঝকে, চকচকে অথচ ভেতরটা কীভাবে পঁচে গেছে।
অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিরা বিরিয়ানি, রোস্ট, পোলাও, কোরমা, কাবাব, পায়েস খাচ্ছে। অথচ অতিথিদের গাড়িচালকরা অপলক তাকিয়ে থাকে, কখন তারা আপ্যায়িত হবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষান্তে তারা থাকছে অভুক্ত, অত:পর তাদের হাতে দেয়া হচ্ছে হোটেল থেকে কেনা নিম্নমানের খাবার। কত অযত্ন আর অবহেলায় তাদের হাতে হাতে প্যাকেট বিলানো হয়। এ খাবারটুকু শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলবে, সে সুযোগও তারা কদাচিৎ পায়। অনুষ্ঠান শেষে অতিথিকে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে গভীর রাতে বাসায় ফিরে চালককে গলাধ:করণ করতে হয় ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া খাবার।
এভাবেই মনের গহিন কোণে জমা হয় অসহনীয় মনোবেদনা। অবশেষে ক্ষোভের আগুনে পরিণত হয় এ যন্ত্রণা। বিত্তশালীদের এ সংকীর্ণতা ও হীনমন্যতা সমাজের জন্য চরম গ্লানিকর। কর্পোরেট জগতের কর্ণধার ও অভিজাতরা মসজিদ-মাদ্রাসাকে অজস্র দান-অনুদানে সিক্ত করেন। দরিদ্র জনগণের জন্য সিএসআর- এর মাধ্যমে অকাতরে অর্থ ব্যয় করেন। কিন্তু সামাজিক অনুষ্ঠানে অধীনস্তদের খাবার দিতে কেন এত আপত্তি-বিপত্তি? এ বৈষম্য আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির উপর এক গভীর ক্ষতচিহ্ন! শিশু-কিশোরদের মধ্যেও পর্যায়ক্রমে সংক্রমিত হচ্ছে এ হীনমন্য আচরণ। ভোগবাদিতার পথে দ্রুত ধাবমান এ সমাজে এখন বিত্তশালী পরিবারগুলোর বিয়ের বাজেট ২৫-৩০ লাখ টাকা। যে পরিমাণ খাবার অপচয় হয় এসব বিয়েতে তাকে তুঘলকি কাণ্ড বলা চলে!
নামি-দামি বাবুর্চিদের হাতে তৈরি হয় দেশি-বিদেশি খাবারের ম্যানু। একদিকে বিত্তশালীদের জন্য লোভনীয় খাবারের নামে বিশাল অপচয়, অন্যদিকে নিম্নআয়ের কর্মচারীদের অভুক্ত রেখে ব্যয় সাশ্রয়। এসব বঞ্চনার আড়ালে নবদম্পতিদের সুখ-শান্তির জন্য আবার দোয়া কামনা।
কত যে ভয়নাক অসুস্থ আমাদের মানসিকতা। সামাজিক অনুষ্ঠানে এক দেড়শ’ গাড়িচালকের জন্য কতইবা ব্যয় হয়? জনপ্রতি সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা। তাও কি খুব বিশাল বদান্যতা? একদিকে নিম্নশ্রেণীর মানুষকে খাবারের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, অন্যদিকে উচ্চমার্গের অতিথিদের উচ্চমানে আপ্যায়িত করার এ বৈষম্য ধর্মীয় দৃষ্টিতেও অনৈতিক।
অথচ সভা-সেমিনারে এসব বিত্তশালীদের বক্তৃতায় থাকে মানুষে মানুষে বৈষম্য বিলোপের দাবি, তাদের মুখে মুখে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষার ফুলঝুরি। কি আশ্চর্য দ্বিচারিতা! দেশের শ্রমজীবী, কর্মজীবী মানুষগুলো নিম্নবিত্ত হলেও এ সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সামাজিক অনুষ্ঠানে এসে সাহেব বা বেগম সাহেবের মত সমমানের খাবার খেতে তাদেরও অভিপ্রায় জাগে। অথচ অনুষ্ঠানের আলো ঝলমল পরিবেশে সাজানো টেবিলে তাদের আসন নেই। আসন পেলেও সবার শেষে শীতল হয়ে যাওয়া খাবারটুকু যখন তাদের খেতে দেয়া হয়, তখন যেন সব মানবিকতাকে ধুলিস্মাৎ করা হয়।
একটু উপলব্ধি করুন, একই যানবাহনে একজন চালকের আসনে, অন্যরা যাত্রীর আসনে। যে চালকের শ্রমে ও ঘামে অতিথিরা অনুষ্ঠানস্থলে এসে পৌঁছান, সে চালক ওই অনুষ্ঠানের খাবারের জন্য উপেক্ষিত, বঞ্চিত। কি নির্মম পরিহাস! নিম্ন আয়ের বলে এ অমর্যাদা, অবমাননা?
চালকদের খাবার নিয়ে কেন এ দুশ্চিন্তা? এতো জৌলুষের মাঝে কেন এত হীনতা, নীচতা? কত টাকা বাঁচবে? মানুষকে নিয়ে এসব বিভক্তি মূলত: এক বিকারগ্রস্ত সমাজের প্রতিচ্ছবি। এ ভাবেই উঁচু-নিচু প্রভেদের মনস্তত্ত্ব থেকে অধঃস্তন কর্মী, চালক-সেবকদের মধ্যে সৃষ্টি হয় মালিক বা বসের বিরুদ্ধে বিরাগ-বিতৃষ্ণা-অবাধ্যতা।
সম্প্রতি এক সরকারি কর্মশালায় খুব উন্নতমানের খাবারের আয়োজন করা হয়েছিল। অবাকচিত্তে লক্ষ্য করেছি, এখানে দায়িত্বরত গাড়িচালক, গার্ড, অধ:স্তন কর্মচারীদের ললাটে এ খাবার জোটেনি, তাদের হাতে গছিয়ে দেয়া হয় ২০০ টাকা। অথচ অতিথিদের খাবারের জন্য জনপ্রতি ব্যয় ছিল কমপক্ষে ৮০০-১০০০ টাকা। কী নিদারুণ বৈষম্য!
সম্প্রতি ডিপিডিসি’র বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রথমবারের মত সরকারের সচিব থেকে গাড়িচালক পর্যন্ত প্রায় দেড়শ’ জনের জন্য সমমানের ও সমমূল্যের খাবারের আয়োজন করেছিলাম। এতে বাদ পড়েনি সুইপার, পিয়ন, পিএ কেউই। এ শ্রেণীর প্রায় ৯৫ জনের জন্য বাড়তি ব্যয় হয়েছে সর্বসাকুল্যে ৪৮,৯৫২ টাকা। খাবারে এ বৈষম্যহীনতার দৃষ্টান্ত দেখে অধ:স্তন কর্মচারিরা আনন্দে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। সাম্যের এ চর্চা ছড়াতে হবে সমাজের সর্বত্র। আপ্যায়ন ও আতিথেয়তায় চালক, শ্রমিক ও সেবকদের প্রতি থাকতে হবে ভালবাসা, সহৃদয়তা। নতুবা বলবো এসব অনুষ্ঠান নিছক সুনাম অর্জনের জন্য লোকদেখানো আচার-অনুষ্ঠান।
সামাজিক অনুষ্ঠানের খাবারে উঁচু-নীচু, ধনী নির্ধন বিভেদ তৈরি না করে সব শ্রেণীর মানুষের মধ্যে সমতার-সংস্কৃতি গড়ে তোলার অনুরোধ করছি। সমতা রক্ষার জন্য যে মাত্রার বিবেকবোধ জাগ্রত করা প্রয়োজন, তা সৃষ্টি না হলে গাড়িচালককে বাদ দিয়ে স্বয়ং গাড়ি চালিয়ে অনুষ্ঠানে আসুন, নতুবা চালকবিহীন আধুনিক(!) প্রযুক্তির গাড়ি আমদানি করে চালকদের আপ্যায়িত করার আপদ (!) থেকে মুক্ত থাকুন।
মহানবী (সা:) আজ হতে চৌদ্দশ’ বছর আগে যে জীবনদর্শন উপহার দিয়েছিলেন, তার অন্যতম মর্মবাণী ছিল, ‘তোমরা যা খাবে, অধীনস্তদেরও তাই খাওয়াবে। ’ আসুন ঘরে-বাইরে এ মহৎ আদর্শ অনুশীলনের মাধ্যমে সমাজে প্রশান্তি ও সম্প্রীতির পাথেয় রচনা করি। আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সব অনুষ্ঠানে আপ্যায়নের আয়োজন সমভাবে নিবেদিত হোক অতিথি এবং অতিথিদের সঙ্গে আসা চালক, সেবক, কর্মচারীসহ সব প্রান্তিক মানুষের জন্য। আমাদের অন্তর হোক প্রসারিত, উদারতায় হোক উদ্ভাসিত।
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: সচিব, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, mmunirc@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১, ২০১৫
জেডএম