বাংলাদেশের শেয়ারবাজার বা পুঁজিবাজারের সাম্প্রতিক সময়ের প্রেক্ষাপট ও বাজারের সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে সামগ্রিক একটা বিচার-বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনীয়তা জরুরি হয়ে উঠেছে। এছাড়া মোটাদাগে কোনো সিদ্ধান্ত বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নেওয়া সম্ভব হয় না।
আমাদের দেশের পুঁজিবাজার তার ক্রান্তিকাল পার করছে আর একইসঙ্গে সবাই অপেক্ষা করছি একটি সুষ্ঠু সুন্দর ও টেকসই পুঁজিবাজারের। বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে কেবল বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ ও দক্ষতা নয়, এর পাশাপাশি প্রয়োজন বাজার নিয়ন্ত্রণকারীদের স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধান। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সবসময় আমাদের প্রত্যাশা সুসংগঠিত বাজার ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে নীতি নির্ধারক মহল থেকে যথাযথ গুরুত্ব দেবে। এটাই আমাদের কাম্য।
বর্তমানে আমাদের দেশে বিদেশি বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। বিশ্বজুড়ে মহামন্দা শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে বিদেশিরা তাদের পুঁজি প্রত্যাহার করে নেয়, সেক্ষেত্রে আমাদের দেশীয় পুঁজিবাজারে কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং নিজস্ব শক্তি, দক্ষ বিনিয়োগকারী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উৎসাহে পুঁিজবাজার শক্তিশালী অবস্থান নেয়, যা আমাদের জন্য শুভ। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিদেশি বিনিয়োগ জরুরিভাবে প্রয়োজন। এই ক্রান্তিলগ্রে এসইসি, ডিএসই, সিএসইসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিৎ এই বাজারকে শক্তিশালী করার জন্য বহুমুখী সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তা বাস্তবায়ন করা জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজন। একইসঙ্গে যে সব নাগরিক দেশের বাইরে অবস্থান করেছে তাদের উৎসাহ অনুপ্রেরণা দিয়ে পুঁিজবাজারে প্রবেশের ব্যবস্থা করা।
অত্যন্ত ক্ষোভ ও দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এই বাজারে বিভিন্ন সময়ে বড় বড় ঝড় অতিবাহিত করছে। তার পরেও বাজার পুনরায় তার আপন গতিতে সুস্থ অবস্থানে এসেছে। এবারের চিত্র তার বিপরীত। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কেউ ইতিবাচক ধারায় মন্তব্য করেনি। করেছে বাজার বিমুখ মন্তব্য। এটা আমাদের প্রত্যাশা নয়। এই ক্রান্তিলগ্নে বর্তমান সরকার পুঁজিবাজারকে শক্তিশালীকরণ ও এতে আস্থা ফেরানোর সর্বাত্মক ব্যবস্থা নেবেন--এটা আমাদের প্রত্যাশা।
পুঁজিবাজারের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন ও বেকারত্ব নিরসন ও দেশকে অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত সমৃদ্ধিকরণ সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা, নতুন নতুন কোম্পানিকে বাজারমুখী করা।
বর্তমানে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক একচেঞ্জের তালিকাভুক্ত ব্রোকারেজ হাউজগুলো ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে নিয়মিত লেনদেন করছে। পুঁজিবাজারের সঙ্গে বেকার যুবক, ছাত্র, শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবীসহ নানান পেশার লোক জড়িত। অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর জীবিকা নির্বাহের অন্যতম উৎস এই পুঁজিবাজার।
জরুরিভাবে প্রয়োজন বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নত করা, তাহলেই মুক্তি পাবে লাখো পরিবার এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে, কমে যাবে দেশের অস্থিরতা, দেশে সৃষ্টি হবে সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি।
একটি দেশের অর্থনৈতিক ভীত নির্ণয়ের অন্যতম মাপকাঠি পুঁজিবাজার। এই পুঁজিবাজারকে এখনই টেকসই ও মজবুত করা দরকার।
সরকারি সংস্থার শেয়ারগুলো দ্রুততার সঙ্গে বাজারে ছেড়ে দেওয়া এবং বাজারকে সংস্কার করা প্রয়োজন। আমার মতে, আমাদের পুঁজিবাজার সংকট বা বিপদজনক ক্ষেত্র নয়। এখানে আছে অনেক সম্ভাবনা। তবে বর্তমান পরিস্থিতি ভয়াবহ। এই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হতে হলে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, মার্চেন্ট ব্যাংক ও বড় পুঁজির বিনিয়োগকারীদের বাজারে পুনরায় প্রবেশ করা। একইসঙ্গে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যেন আস্থা না হারায় তার ব্যবস্থা করা।
এই মুহূর্তে বাজারকে সমৃদ্ধকরণ এবং আস্থা ফেরানোর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, এসইসি, ডিএসই, সিএসই, মার্চেন্ট ব্যাংক, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান আইসিবির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন ও পর্যবেক্ষণ আবশ্যক। পুঁজিবাজারের স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হলে বড় বিনিয়োগকারী নয়, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী বাজারের প্রাণ।
আজকের পুঁজিবাজার পতনের অন্যতম কারণ গুজব এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। গুজব নির্ভর না হয়ে মৌলভিত্তি সম্পন্ন শেয়ার কিনলে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় না। আর বাজার ব্যবস্থাপনাকে পূর্বের ন্যায় করতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নমনীয় আচারণ ও সংস্কারমূলক পদক্ষেপের আশু প্রয়োজন। একই সাথে আর্থিক অনার্থিক প্রতিষ্ঠান যাতে দ্রুত বাজারে অংশ নিতে পারে তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
বর্তমান পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজার বিষয়ক কাউন্সিলিং আবশ্যক। কারণ, আমাদের বাজারের প্রসার ব্যাপক কিন্তু কোনো কর্মশালা নেই। যেসব জেলাতে ব্রোকারেজ হাউজ আছে সেসব স্থানে প্রতি মাসে অন্তত একবার কাউন্সিলিং প্রয়োজন। বাজার যখন প্রসার হয় তখন বাজার অস্থির হয় এবং অনভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায় আর ক্ষতির ভাগটা তাদের উপরই বর্তায়।
পুঁজিবাজার কখনোই টানা মূল্য বৃদ্ধি পায় না। দর উঠানামা করে। এজন্য আমাদের সবার মনে রাখা উচিৎ মৌলভিত্তি সম্পন্ন শেয়ার ক্রয় করা এবং গুজবে কান না দেওয়া। পুঁজিবাজার অস্থির করে তোলে গুজবকারীরা। এজন্য সতর্কতা অবলম্বন করা প্রত্যেক বিনিয়োগকারীর জন্য মঙ্গল। আর এজন্যে বাজার সংশ্লিষ্ট সব কিছু স্টক এক্সচেঞ্জ ও এসইসিকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা উচিৎ। বিনিয়োগকারীরা যখন কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে নিজেদের সচেতন করে তুলবে, বাজারকে বুঝবে তখনই একটা টেকসই মজবুত বাজারের সৃষ্টি হবে। আমাদের প্রত্যেকের উচিৎ ঋণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া। ঋণ ব্যবহারে যেমন লাভ হয়, তার থেকে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এজন্যে এক্ষেত্রে আমাদের সবার সংযত হওয়া প্রয়োজন।
বাজারকে বাঁচাতে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি
সুষ্ঠ-সুন্দর বিনিয়োগবান্ধব বাজেট, বাজারের প্রাণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো, পুনরায় ঋণ প্রদানের মাধ্যমে দর সমন্বয়ের ব্যবস্থা করা, অপ্রদর্শিত আয়কে পুনরায় বাজারে আসবার সুযোগ দান, বাজারে তারল্য প্রবাহ সৃষ্টি, গেইন ট্যাক্স প্রত্যাহার, নতুন নীতিমালা প্রণয়ন, ডি-মিউচ্যুয়ালাইজেশন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগসীমা বৃদ্ধি, টিআইএন সনদের পূর্বশর্ত প্রত্যাহার করা, ঋণের অনুপাত ১:২ করা, সরকারের কাছে থাকা সব শেয়ার অফলোড করা, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি করা, এই বাজারের জন্য আপোদকালীন তহবিল গঠন, সবসময় বাজারের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে মিউচ্যুয়াল ফান্ড, বাজারে আরও মিউচ্যুয়াল ফান্ড আনা, মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেন আরও বেশি টাকা বিনিয়োগ করতে পারে তার জন্য আইন সংশোধন করা, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের আইপিও কোটা বৃদ্ধি করা, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মেয়াদ বৃদ্ধি করা, মিউচ্যুয়াল ফান্ড ক্রয়ে যেন ঋণ পায় তার ব্যবস্থা করা, মিউচ্যুয়াল ফান্ড যেন রাইট বোনাস দিতে পারে সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
উপসংহারে বলতে চাই, আমরা কোনো মিছিল-মিটিং চাই না, চাই না ভয়াবহ ধস, চাই না কোন দুঃসংবাদ, চাই না সর্বস্ব হারাতে। চাই শুধু সুষ্ঠু-সুন্দর একটি বিনিয়োগবান্ধব পুঁজিবাজার। কর্তৃপক্ষের ইতিবাচক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যেন প্রকৃতপক্ষে বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন হয় এবং কিন্তু বিনিয়োগকারীরা যেন আস্থাহীনতায় না ভোগে এবং বাজারবিমুখ না হয়--এসবই আমাদের প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪২ ঘণ্টা, জুন ০২, ২০১১