বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার হরিপুর-চককানু গ্রামে শিয়া সম্প্রদায় পরিচালিত আল মোস্তফা জামে মসজিদে অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের গুলিতে মোয়াজ্জিন নিহত এবং অপর তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। এ ঘটনা একই সঙ্গে আমাদের বিস্মিত, মর্মাহত ও উদ্বিগ্ন করেছে।
আমরা এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই।
বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো শিয়া মসজিদে এ ধরনের সন্ত্রাসী হামলা ও হতাহতের ঘটনা ঘটলো। কিছুদিন আগে রাজধানীর পুরনো অংশের ইমামবাড়া ‘হোসেনি দালানে’ মহররমের মিছিলের প্রস্তুতিকালে সমবেত মানুষের ওপর দুর্বৃত্তরা বোমা হামলা চালায়। যাতে দু’জন নিহত হওয়া ছাড়াও অনেকে আহত হন। বিগত চারশ’ বছরের ইতিহাসে হোসেনি দালানে এ ধরনের হামলার কোনো নজির ছিল না।
খবরে প্রকাশ, বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার হরিপুর, চককানুসহ আশপাশের ছয়টি গ্রামে দেড়শ’ ঘর শিয়া মুসলমানের বাস। তাদের কেউই বংশানুক্রমিকভাবে শিয়া নন, গত তিন দশকে শিয়া মতবাদ গ্রহণ করেছেন। এক পরিবারেরই এক ভাই শিয়া আর অন্যরা সুন্নি মতবাদে বিশ্বাসী। গ্রামের অনেক মানুষ জানেনই না, শিয়া-সুন্নির তফাতটা কী। তারপরও তাদের রক্ত দিতে হলো! এমনকি শিয়া মসজিদটির বিষয়ে স্থানীয় শিয়া সম্প্রদায় ও মসজিদের আশপাশের গ্রামের লোক ছাড়া অন্যরা জানতেনই না!
ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, এ দেশে শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত মুসলমানের সংখ্যা অতি নগণ্য। শত শত বছর ধরে তারা সংখ্যাগুরু সুন্নি মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের সঙ্গে শান্তি ও সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করছেন। কে সুন্নি, কে শিয়া এ ভেদ-বিভেদ আমাদের সমাজে নেই। কখনো, কোনোকালে শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে কোনো উত্তেজনা, বিরোধ-সংঘাত ঘটেছে- ইতিহাসে এমন কোনো তথ্যও খুঁজে পাওয়া যায় না।
শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব এতোটাই প্রগাঢ় যে, তাজিয়া মিছিলে শিয়াদের সঙ্গে সুন্নিরাও অবলীলায় অংশগ্রহণ করেন। হোসেনি দালানে হামলার ঘটনায় যে দু’জন মারা গেছেন, তারা সুন্নি মুসলমান। যারা আহত হয়েছেন তাদেরও বেশিরভাগ সুন্নি মুসলমান।
সঙ্গত কারণেই আমরা বলতে চাই, এ দু’টি হামলার ঘটনা মোটেই বিচ্ছিন্ন নয়, পরস্পর সম্পর্কিত, পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যমূলক।
এ ধরনের গোষ্ঠীগত সংঘাত-সংঘর্ষের পথ ধরে মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানে এ ধরনের ঘটনা দেশটির শান্তি ও নিরাপত্তাকে বিপন্ন করছে। এমন গোষ্ঠীগত সংঘাত দেশের সার্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করে পরিস্থিতিকে ধীরে ধীরে অগ্নিগর্ভ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা গেছে, গোষ্ঠীগত সংঘাত যেমন পুরনো, তেমনি বহুমাত্রিক। গোষ্ঠীগত সংঘাত জাতীয় ঐক্যে খুব দ্রুত ফাটল সৃষ্টি করে, আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে বিনষ্ট করে।
সর্বোপরি দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতাকে বিপন্ন করে তোলে।
সঙ্গত কারণেই বলতে হয়, এমন গোষ্ঠীগত সংঘাত কোনোভাবেই সৃষ্টি হতে দেওয়া যাবে না। যেকোনো উপায়ে তা বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে।
কথা একটাই, কোনোভাবেই গোষ্ঠীগত সংঘাত বাড়তে দেওয়া যাবে না।
আমরা মনে করি, এসব ঘটনার ক্ষেত্রে হামলাকারীদের প্রধানতঃ দু’টি উদ্দেশ্য থাকতে পারে। প্রথমতঃ কিছু মুসলিম দেশের মতো এখানেও শিয়া-সুন্নি ইস্যু তৈরি করা। দুই সম্প্রদায়ের মানুষের সদ্ভাব বিনষ্ট করা এবং তাদের মধ্যে সন্দেহ-সংশয়, অবিশ্বাস ও বিরোধের সৃষ্টি করা। একই সঙ্গে দেশের মধ্যে অশান্তি ও অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয়তঃ বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমর্যাদা বিনষ্ট করা। দেশকে অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে প্রতিপন্ন করা।
ঘটনাপ্রবাহ থেকে এটা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হচ্ছে, কোনো মহল দেশকে অস্থিতিশীল করা, অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা এবং বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমর্যাদা বিনষ্ট করার জন্য এসব ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। বিদেশিদের ওপর হামলা, শিয়াদের ইমামবাড়া ও মসজিদে হামলা, যাজকদের ওপর হামলা ও হুমকি ইত্যাদির মধ্যে একটি বার্তা রয়েছে, যা দেশের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। একবার দেশে গোষ্ঠীগত সংঘাত শুরু হলে তা থামানো মুশকিল হয়ে যাবে। এর অনেক নজির আমাদের সামনে রয়েছে, আমরা আত্মবিনাশী এমন উদ্বেগকে বংশ পরম্পরায় বহন করতে চাই না।
ইতোমধ্যেই বিশ্বের অসহিষ্ণু দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম তিন নম্বরে উঠে এসেছে। সুইডেনের অর্থনীতিবিদদের পরিচালিত এক জরিপে ভারতকে এক নম্বর, জর্ডানকে দুই নম্বর ও বাংলাদেশকে তিন নম্বর অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। দেশের সার্বিক ভাবমূর্তির জন্য এটা যে কতো বড় ক্ষতি, তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। যদি অনিরাপদ ও অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে বহির্বিশ্বে দেশের পরিচিতি স্থায়ী হয়, তবে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির সমূহ ক্ষতি হবে। এসব যে সরকার বোঝে না বা অনুধাবন করে না, সেটা বলা অনুচিত।
তাই আমরা মনে করি, সাম্প্রতিককালে যেসব সন্ত্রাসী হামলা ও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, তার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও ত্বরিত তদন্তের ব্যবস্থা করা হবে। এসব ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক বা অন্যান্য পরিচয় যাই থাক, গ্রেফতার করতে হবে এবং দ্রুত বিচার ও উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে দোষারোপের রাজনীতি এবং সময়ক্ষেপণকারী গল্প তৈরির প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সব ঘটনাকে রাজনৈতিক রং দিয়ে স্বার্থ হাসিলের বদলে জাতির বৃহৎ স্বার্থ বিবেচনা পদক্ষেপ নিতে হবে।
আরেকটি কথা, বর্তমানে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী কোনো ঘটনা ঘটলেই আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস ওই হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়। আর ওই বিবৃতি শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপেই প্রকাশিত হয়। এর রহস্যও খুব দ্রুত উন্মোচিত করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ২২০৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৫
এমএ/এএসআর