ঢাকা: দক্ষিণ এশিয়ার নদীবিধৌত কৃষিপ্রধান জনবহুল আয়তনে ক্ষুদ্র একটি দেশের নাম বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডের ২০০ বছরের শাসন আর পাকিস্তানের ২৪ বছরের নিপীড়ন শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়ায় ছোট্ট এই দেশটি, দেশের জনগণ পায় একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রীয় নাম এবং একটি লাল সবুজের পতাকা।
যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের এই দেশটি পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত হতে পারলেও সাত কোটি জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি মেলেনি। দেশ স্বাধীন হয় ঠিকই, কিন্তু স্বাধীন দেশের জনগণের মুখে দুই বেলা খাবার জোটেনি, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়নি।
যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭৪ সালে দেখা যায় দুর্ভিক্ষ !! ভয়াল সেই দুর্ভিক্ষে না খেতে পায়ে অনাহারে মারা যায় হাজার হাজার মানুষ! দিনের পর দিন না খেতে পেয়ে মারা যাওয়া জনগণের এই দেশটির মানুষগুলো আজ তিন বেলা পেট পুরে খেয়ে অন্য দেশে চাল রপ্তানি করে!
দূরদর্শী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে শুধুমাত্র কৃষির উন্নয়নের মাধ্যমে।
পরবর্তী সময়ে দেশ উন্নয়নের কাজে তাঁর যে পরিকল্পনা ছিল, তা ছিল কৃষিনির্ভর। বাংলাদেশে কৃষি বিষয়ক গবেষণার জন্য, বাংলাদেশের গরিব ও মেহনতি মানুষসহ সকলের মুখে তিন বেলা ভাত তুলে দেয়ার জন্য ১৯৭০ সালের প্রতিষ্ঠাকাল কাল থেকেই বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কাজ করে আসছে। যে কোন গবেষণার ইতিবাচক ফলাফল আনতে বিজ্ঞানীদের বছরের পর বছর মেধা ও শ্রম দিতে হয়। সেই মেধা ও শ্রম কাজে লাগিয়ে ব্রি’র সম্মানিত বিজ্ঞানীরা এই পর্যন্ত ৭৩টি উফশী ও ৪টি হাইব্রিড সহ মোট ৭৭টি ধানের জাত অবমুক্ত করেছেন এবং আধুনিক ধান চাষের কলাকৌশলসহ আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির মাধ্যমে ধানের মোট উৎপাদন পূর্বের চেয়ে প্রায় ৪ গুণ বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রেখে চলেছেন। প্রতিনিয়ত জলবায়ু ও আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে সাথে সময়োপযোগী গবেষণা কার্যক্রম যেমন বন্যা, খরা, শীত, লবণাক্ততা, জোয়ারভাটা প্রভৃতিকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে সেগুলো মোকাবেলা করতে পারে এমন গবেষণা চলছেই। খাদ্য ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্ত ধানের উৎপাদনের পাশাপাশি পুষ্টিসমৃদ্ধ ধানের গবেষণা এখন অগ্রগামী হচ্ছে। পৃথিবীর বুকে প্রথম দেশ হিসাবে আমরাই জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধান (ব্রি ধান৬২) আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি। ১৯৭৩ সালে কৃষি গবেষণার পথে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই) এর সম্মানিত বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত দানাজাতীয়, তৈল, ডাল, কন্দাল, সবজি, ফল, ফুল, মশলা সহ বিভিন্ন ফসলের ৪৫১টি উচ্চ ফলনশীল জাত এবং ৪৪২টি ফসল উৎপাদনের প্রযুক্তিসহ মোট ৮৯৩টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন।
বাংলাদেশে কৃষি বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য ১৯৭৩ সাল থেকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল কাজ করে আসছে। বাংলাদেশের কৃষি তথা পুরো দেশের সমগ্রিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে দেশ স্বাধীনের পর থেকে আজ পর্যন্ত বছরের পর বছর বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল এর অন্তর্গত সহযোগী গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো তথা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI), বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (BJRI), বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (BSRI),বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BINA), মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (SRDI), তুলা উন্নয়ন বোর্ড (CDB), বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (BFRI), বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (BLRI), বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট (BFRI), বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (BTRI) এবং বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (BSRTI) এর সকল বিজ্ঞানীরা নিরবে নিভৃতে নিরলসভাবে শ্রম ও মেধা দিয়েই চলেছেন যার ফলশ্রুতিতে আমরা আজ কৃষিতে অনেকাংশে স্বনির্ভর একটি দেশে পরিণত হতে পেরেছি।
কিছুদিন পূর্বে গত ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ৮ম পে-স্কেল এর গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। বর্তমান সময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন এবং পরিবারের বাবা, মাসহ সদস্যদের কথা চিন্তা করে এই ৮ম পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়। এই নতুন ঘোষিত পে-স্কেলে ক্যাডার সার্ভিসের কর্মচারী এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রভাষকদের নতুন চাকরিতে যোগদানের ক্ষেত্রে ৮ম গ্রেড ও অন্যান্য নন-ক্যাডার কর্মচারীসহ কৃষি বিজ্ঞানীদের যোগদান ৯ম গ্রেডেই রাখা হয়। একই শ্রেণীর সরকারি কর্মচারী হয়ে কেউ যোগদান করবেন ৮ম গ্রেডে আবার কেউ করবেন ৯ম গ্রেডে!! এটা কি ধরনের বৈষম্য? আমরা জাত, ধর্ম নির্বিশেষে যদি বৈষম্যহীন বাঙ্গালি জাতি হতে পারি, তবে চাকরি ক্ষেত্রে যোগদানের ক্ষেত্রে নতুন করে বৈষম্য সৃষ্টির কারণ কি? স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে দেশের অধিকাংশ কর্মচারী যখন নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করেছে, আর সেই সময় কৃষি বিজ্ঞানীরা তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব ও গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে গেছে বা এখনও আমরা গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি-এটাই কি আমাদের অপরাধ? কৃষি বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পড়ালেখা শেষ করে আজো বেশ কিছু মেধাবী ছাত্রছাত্রী কৃষি গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোতেই বিজ্ঞানী হিসাবে চাকরির স্বপ্ন দেখে, নতুন কিছু করার স্পৃহা থাকে তাদের মাঝে। চাকরিতে যোগদানের ক্ষেত্রে এমন বৈষম্য সৃষ্টি হলে এই স্বপ্নগুলো আর কেউ দেখার সাহস করবে না, সকলেই তখন “ক্যাডার” নামক চাকরির পেছনেই ছুটবে, আর একটা সময় আসবে যখন মেধাশূন্য হয়ে পড়বে গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো! বাংলাদেশ যেন কোন দিন পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য সকল মেধাবী ও বুদ্ধিজীবীদের ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর নির্মম ভাবে হত্যা করেছিল তৎকালীন পাকিস্তানি হানাদার ও দেশদ্রোহী আলবদর রাজাকার বাহিনী। প্রায় মেধাশূন্য সেই অবস্থা থেকে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের আজকের অবস্থানে আসতে অনেক বছর সময় লেগে গেছে, আর তাই কৃষি বিষয়ক গবেষণার জন্য যোগ্য মেধাবীরা যেন কৃষি বিজ্ঞানী হিসাবে আসার স্বপ্ন দেখতে পারে, সেজন্য বৈষম্যমূলক এই নতুন পে-স্কেলের সংশোধন সাপেক্ষে দরকার হলে স্বায়ত্তশাসিত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেল ঘোষণা করে দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেধাশূন্য হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা একান্ত জরুরি ।
লেখক: কৃষিবিদ গোলাম সারওয়ার জাহান, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, আঞ্চলিক কার্যালয়, বরিশাল
ইমেইলঃ gsjahan57@yahoo.com
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৫
আরআই