স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছরে ‘৩০ লাখ’ সংখ্যাটি শুধু একটি সংখ্যাই নয়, এটি পাকিস্তানের ঘুম হারামের কারণ হয়েও দাঁড়িয়েছে। শুধু এই একটি সংখ্যার সঙ্গে পাকিস্তান দীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছর যুদ্ধ করছে।
পাকিস্তান সরকার, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, তাদের গোয়েন্দা সংস্থা এই সংখ্যাটি ৩০ লাখ থেকে ৩ লাখে নামিয়ে আনার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে দীর্ঘ সময়। ৩০ লাখ সংখ্যাটি পাকিস্তানের আত্মশ্লাঘায় এতোটা আঘাত করে যে, পাকিস্তানের যে কমিশনের রিপোর্টকে আমরা মন্দের ভালো মনে করি সেই হামদুর রহমান কমিশনও ৩০ লাখ সংখ্যাটিকে অস্বীকার করে।
আমাদের যুদ্ধ দৃশ্যত একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর শেষ হয়ে গেলেও পাকিস্তানের যুদ্ধ শেষ হয়নি। তারা ৩০ লাখ ফিগারটির সঙ্গে দীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছর ধরে যুদ্ধ করছে।
বিবিসি বাংলার সাংবাদিক খ্যাত লন্ডন প্রবাসী সিরাজুর রহমানকে দিয়ে প্রথম ৩০ লাখ বিতর্কের আকামটা করানো হয়। বহু বছর সিরাজুর রহমান গং প্রলাপ বকেছে। তাতে তেমন কোনো ফল আসেনি। কলকাতার এক পতিত লেখিকা শর্মিলা বসুকে দিয়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দা আর্কাইভে বসিয়ে ‘ডেড রেকনিং’ শিরোনামে একটি বইও লেখানো হয়। তাতেও কাজ হয়নি।
সর্বশেষ বিএনপি এ যুদ্ধে যোগ হলো?
বিতর্কিত ব্যক্তি সিরাজুর রহমান দাবি করেন, ‘শেখ মুজিব ভুলবশত তিন লাখকে তিন মিলিয়ন (ত্রিশ লাখ) বলে ফেলেছেন। শেখ মুজিবের লাখ-মিলিয়ন জ্ঞান না থাকায় এমনটা হয়েছে’।
সিরাজুর রহমানরা বাঙালিদের যতোটা মাতাল মনে করেন, ততোটা কিন্তু তারা নয়। তারা ঠিকই পড়াশোনা করে, প্রাভদার নাম জানে, আজাদীর নাম জানে।
প্রাভদা সোভিয়েত কমিউনিস্টদের পত্রিকা। ১৯৭২ সালে ৪ জানুয়ারি প্রাভদা পত্রিকা তাদের সংবাদে ছেপেছিল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ লোক শহীদ হয়েছেন। তখনো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জেলে বন্দি। এ দেশের তরুণরা জানেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগারে বন্দি থাকাবস্থায় বিদেশি গণমাধ্যমে ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যাটি এসেছে।
ফলে সিরাজুর রহমানরা যাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন, তাতে কাজ হয়নি। এদেশের মানুষকে পাকিস্তান অজ্ঞ মনে করে, আসলে তা নয়। তারা অনেক জানে, অনেক পড়ে।
খালেদা জিয়া দু’বারের প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বল্প শিক্ষিত মানুষ (অষ্টম শ্রেণি পাস)- এটা সবাই জানেন। তিনিও কখনো অস্বীকার করেননি বা স্বীকার করতে এতোটুকু জড়তাবোধ করেননি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই সব নয়। তিনি দু’বারের প্রধানমন্ত্রী। আমরা ভেবেছি, তিনি যথেষ্ট জ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষা রাখেন। কিন্তু আসলেই খালেদা জিয়া ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে তার জ্ঞান ও দীক্ষা অর্জন করতে পারেননি।
তা না হলে তিনি কিভাবে বলেন, ‘এই যে এখন বলে, এত লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে, এটা নিয়েও বিতর্ক আছে’! কী বিতর্ক আছে? খালেদা জিয়া এর আগেও বারবার তার বক্তৃতায় বিবৃতিতে ৩০ লাখ শহীদের কথা বলেছেন। তখন কেন বিতর্কের কথা বলেননি? তার স্বামী সাবেক সেনাশাসক জিয়াউর রহমানও তার সকল বক্তৃতা-বিবৃতিতে ৩০ লাখ শহীদের কথা বলেছেন। তাহলে এখন কেন খালেদা ভিন্ন কথা বলছেন? আর, এখন এ বিতর্ক তোলার দরকারই বা কি ছিল তার? তিনি হঠাৎ এ কথা বলে কী বোঝাতে চাচ্ছেন? তিনি কি ভাবছেন, মুক্তিযুদ্ধকে আঘাত করা হলে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে আঘাত করা হবে?
আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে বিএনপি প্রায় সময়ই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরোধিতা করে ফেলে। এটা বিএনপির মূর্খতা। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছে, সুতরাং খালেদা জিয়াকে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারীদের নেতৃত্ব দিতে হবে! এটা তিনি পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে ধরে নিয়েছেন?
তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচারের সমালোচনা করেছেন। আমরা কিছু বলি না। আমরা ধরেই নেই যে রাজনৈতিক কারণে তিনি বাধা আছেন। কিন্তু খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের কটাক্ষ করে রাজনীতিবিদ হিসেবে চরম আক্কেল জ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন (আমি দু:খিত যে, একজন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এভাবে মন্তব্য করতে হচ্ছে। আমরা অনেকটা আহত হয়েছি)।
খালেদা জিয়ার হঠাৎ এমন মন্তব্যের কারণ কী? খালেদার সমস্যা কোথায়? আমার মনে হয়, এর কারণ হতে পারে, বিএনপির মিত্র দল জামায়াতের চাপ রয়েছে। তারা বিভিন্ন কারণে খালেদা জিয়ার ওপর নাখোশ। খালেদা জিয়া তাদের সুরে কথা বলে তাদের প্রতি হৃদ্যতা প্রমাণের চেষ্টা করছেন হয়তো। অথবা বিএনপিতে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার প্রভাবে বা পাকিস্তানের সঙ্গে আরো সখ্যতা গড়ে তোলার চেষ্টা থেকে তিনি এ মন্তব্য করেছেন।
খালেদা জিয়া ভারতের সঙ্গে কিছুদিন ধরে সুসম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছেন, সেটি পাকিস্তান ভালোভাবে নাও নিতে পারে। তাই হয়তো ভাবলেন, পাকিস্তানকে খুশি করার জন্য কিছু বলা দরকার। আবার এমনো হতে পারে, তিনি মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন। খালেদা জিয়া নিজে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে এমন মনোভাবই পোষণ করেন। যেটা সেদিন তার জিহ্বা দিয়ে অসাবধানতাবশত: বের হয়ে যায়। এবং এটি যদি হয় এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কি হতে পারে!
একটি দৈনিকে নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে বিব্রত বিএনপির একজন নেতা মত দিয়েছেন, ‘খালেদা জিয়া সম্প্রতি লন্ডন সফরে তার পুত্র তারেক রহমান এবং তার চারপাশে ঘিরে থাকা সিরাজুর রহমানের শিষ্যদের দ্বারা কোনো কিছু নসিহত পেয়েছেন, যার প্রভাবে এমন মন্তব্য করতে পারেন। ’
খালেদা জিয়া বড় একটি দলের প্রধান। তার যেকোনো বক্তব্যকে সঙ্গে সঙ্গে যুক্তি দিয়ে সমর্থন করার মতো চামচার অভাব হবে না। হয়েছেও এমন। জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল নামে একটি সংগঠন খালেদা জিয়াকে সমর্থন করে বলেছে, ‘সত্যিই তো, একাত্তরের শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে’।
একটি গোষ্ঠী খালেদাকে সমর্থন দেওয়ার জন্য হলেও শহীদদের নিয়ে বিতর্ক করবে। এদেশের তরুণদের গর্বের ও ঐক্যের এই স্থানটি বিভাজিত করা হচ্ছে। এতে পাকিস্তান এবং তাদের বন্ধু-বান্ধবদেরই লাভ।
স্পষ্টভাবে মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করলেন খালেদা জিয়া। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ভিন্ন কিছু বিশ্বাস করলেও তার পদ ও দায়িত্ব থেকে এমন বক্তব্য দেওয়া উচিত হয়নি। তিনি একজন জাতীয় নেত্রী। তিনি নিজ দেশের স্বাধীনতাকে নিয়ে উপহাস ও তাচ্ছিল্য করবেন- এটা কেউই আশা করেনি। যে মানুষগুলো আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কর্মী হলেও আলাদাভাবে বাংলাদেশকে ভালোবাসেন তারা খালেদার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কেউ কেউ ঘৃণাও করছেন তাকে।
খালেদা জিয়া এ কথা বলে আসলে কাকে ছোট করতে চেয়েছেন, আমি জানি না। এটাতে খালেদা জিয়ার লাভ হয়নি। বরং সবকিছুর ঊর্দ্ধে নিজের দেশকে ভালোবাসেন, এমন মানুষদের কাছে খালেদা জিয়ার সম্পর্কে এ ধারণা গড়ে উঠছে যে- ‘খালেদা জিয়া পাকিস্তানিদের মতো কথা বলেন। তিনি ক্ষমতার জন্য পাগল হয়ে গেছেন’।
তবে যাই হোক, তরুণ প্রজন্ম এসব ব্যাপারে অনেক সচেতন। কতোটা সচেতেন বলি। সেদিন একাত্তর টিভিতে আরিফ রহমান নামে একজন ব্লগার পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন এ বিতর্ক ফেইক। তিনি শুধু পরিসংখ্যানই দেননি। তার বক্তব্যের সমর্থনে ১৯৭১ সালের দেশ- বিদেশের বিভিন্ন আর্কাইভ থেকে সংগ্রহ করা সব পত্রিকার পেপার কাটিং নিয়ে তিনি স্টুডিওতে উপস্থিত হয়েছেন। টিভির মনিটরে হাত উঁচিয়ে ধরে দেখিয়েছেন। এই আরিফ রহমান বা অন্যরা কোনো ক্ষমতা, অর্থবিত্ত বা টাকার জন্য এসব গবেষণা করেন না। শুধুমাত্র দেশকে ভালোবাসেন বলে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান। তারা একেকজন স্বেচ্ছায় স্বদেশের ইতিহাসের সেফগার্ড হিসেবে কাজ করছেন। তো, এতো এতো স্বেচ্ছা যোদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তান বা তাদের এদেশের বন্ধুরা পেরে উঠবে না কখনোই। খামোখাই তারা পরিশ্রমটা করছে।
মনোয়ার রুবেল, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও কলামিস্ট
ই-মেইল: monowarrubel@yahoo.com