এক সময় খেলাধুলার রিপোর্ট করতাম বলে বিশ্বের নানা প্রান্তের ফুটবলার, ক্রিকেটার থেকে ক্রীড়াঙ্গনের প্রায় সবার পরিসংখ্যান মুখস্থ থাকতো। ইংলিশ লিগ কি ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন্স লিগ অথবা স্প্যানিশ লিগ; এমনকি আমাদের দেশের ঘরোয়া ফুটবলও।
তবে এত কিছু অজানার মাঝেও ঠিকই খবর রাখি বাঙালির গর্বের খেলা ক্রিকেট অথবা দেশের অন্য খেলার খুঁটিনাটি। আর এসব জানার মাধ্যম হয় ফেসবুক নয় অনলাইন নিউজপোর্টাল। কারণটা পরিষ্কার, যেখানেই থাকি সব ভুললেও দেশকে ভোলা যায় না। এ এক ভিন্ন রকম টান। বাংলাদেশের লাল-সবুজ আর ক্রিকেট এখন এক সুতোয় বাঁধা। ক্রিকেট এখন দেশে বিনোদনের সেরা মাধ্যম। বাঙালির সামর্থ্য প্রমাণের মঞ্চও। তবে এটাকে কতটা তার মধ্যে রেখেছি আমরা। বহুবার সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফিকে বলতে শুনেছি, আপনারা এটাকে এত বড় করবেন না। আমাদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে দেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? বর্তমান গণমাধ্যমের গণপ্রতিযোগিতায় সব ভেসে যায়। কে কার আগে সংবাদ করবে, মাশরাফি বলার আগে যেন গণমাধ্যমের কাজ তা বলে ফেলা। এমনও দেখেছি, পেসার রুবেলের মাঠে বল করার চেয়ে তার ব্যক্তিগত জীবন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে গণমাধ্যমের কাছে। অমুক বিয়ে করবে কি করবে না। অথবা অমুকের সন্তানের নাম কী হবে? কে কীভাবে ভায়রা হলো? এসব যেন বেশি গুরুত্ব পায়। হয়তো তারকাখ্যাতি। কিন্তু খেলায় কি মাঠের চেয়ে অন্য কিছু বড় হতে পারে?
একজন ক্রীড়াবিদ হয়তো সকালের খবর দেখে দুপুরে তার পরিকল্পনা ঠিক করেন অথবা বদলান। কিন্তু যদি মাঠে নামার আগে দেখেন খেলা নয়, তার ফোনের কথোপকথন বিশেষভাবে প্রকাশ করছে গণমাধ্যম। তাহলে তার মানসিক অবস্থা কী হয়? সেটা সেই ক্রীড়াবিদই জানেন।
মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। ক্রিকেট খেলাটাকে আমরা আর মাঠে রাখতে পারিনি। হ্যাঁ, ক্রিকেট আমাদের অনেক দিয়েছে। কিন্তু আমরা কী দিয়েছি? নিজেদের প্রচারে আমরা গণমাধ্যমে ক্রিকেটকে বানিয়েছি হাতিয়ার। মুস্তাফিজ ভারতের ঘরোয়া লিগে সুযোগ পেলে সেটাকে প্রথম পাতায় ছাপাই। অথচ হাজারো মাবিয়ার স্বর্ণজয়ের কান্নার কথা বলি না আমরা। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার এক যুগ পর ভারতের ঘরোয়া লিগে সুযোগ টাইগাররা পেলো কি পেলো না, এটা নিয়ে তর্ক বা গর্ব করার কিছু নাই। বরং গর্ব এটাই ভারতকে এখন হারাতে পারি আমরা। জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করার মাঝে এখন আমাদের অহঙ্কার নেই। বরং অহঙ্কার এটা ইংল্যান্ডকে মাটিতে নামিয়ে আনতে পারি আমরা। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারাতে পারি। এত বছর পর কেন আমরা এখনও ছোট দলের সঙ্গে লড়াইকে বড় করে দেখবো।
ভারতের আইপিলে কমপক্ষে আমাদের ১০ জন ক্রিকেটার খেলার যোগ্যতা রাখে। কিন্তু তারা নেবে না। নিলেও বসিয়ে রাখবে। এটা একটা স্নায়ুবিক লড়াই। মুস্তাফিজের পাঁচ উইকেট পাওয়া যেমন আমাদের বড় করে তেমনি মাহফুজার এসএ গেমসে স্বর্ণজয়, ফাহাদের দাবায় দেশের বাইরে পুরস্কার পাওয়া, মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবলের চ্যাম্পিয়ন হওয়া অথবা প্রতিবন্ধী অলিম্পিকে স্বর্ণজয় কোনোটা ছোট নয়। কিন্তু কয়জন প্রতিবন্ধী গোল্ডমেডেলিস্টের কথা প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে। হয়নি, কারণ বাণিজ্য। আর এটা করতে গিয়ে অকালে ধ্বংস করছি আমাদের সবচেয়ে অগ্রসরমান খেলা ক্রিকেটকে।
প্রতিপক্ষের চেয়ে সংবাদ সম্মেলন মোকাবেলা করা বেশি কঠিন- এ কথা বহুবার বলতে শুনেছি অনেক ক্রিকেটারকে। আপনি বলটা এভাবে কেন খেললেন, এভাবেও তো খেলতে পারতেন- এভাবে প্রশ্ন করা নিশ্চয়ই সাংবাদিকতার নীতির মধ্যে পড়ে না। অথবা আপনার দিকে তাকিয়ে আছে ১৬ কোটি মানুষ। প্রত্যাশার চাপ কী সেটা বাংলাদেশের ক্রিটোরের চেয়ে কে বেশি জানে?
আমার বলার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, ক্রিকটের উন্নয়নে গণমাধ্যমের কোনো ভূমিকা নেই। নিছক প্রচারের স্বার্থে ক্রিকেটকে ব্যবহার ঠিক নয়। পরিমিতিবোধটা সাংবাদিকতায় গুরুত্বপূর্ণ। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ সেমিফাইনালে ওঠায় যে উচ্ছ্বাস দেখিয়েছে গণমাধ্যম তা কোনো পরিমিতিবোধে পড়ে না। ক্রিকেটের এত বছর পথচলায় সেমিফাইনালে বালাদেশ খেলবে এটাই স্বাভাবিক। আমরা যখন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেই, মিরাজ দেখিয়ে দাও। এটাই আমাদের সেরা সময়। বা তোমাকে পারতে হবে মিরাজ। তখন খুব কষ্ট লাগে। কারণ মনের অজান্তে আমরা মিরাজকে চেপে ধরেছি।
একবার ভাবুনতো, মাত্র ১৮ বছরের একটা ছেলে কি করে ছোট্ট কাঁধে আপনার আমার মতো মানুষের প্রত্যাশার চাপ নেবে! যার বলিদান দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব। যদিও মিরাজও বলেছে, গণমাধ্যমের কোনো চাপ নেই। এটাই তো বড় কথা। একথা তাকে বলতে হবে কেন। সেমিফাইনালে ওঠার পর দেশের গণমাধ্যম যেভাবে মিরাজদের বীর বানিয়েছে তাতে একটু হতচকিত মিরাজরা না হয়ে পারে? ভারত টানা পাঁচবার এ আসরে ফাইনাল খেলছে। তাদের দেশে এ নিয়ে এত হৈ-চৈ নেই। কারণ তারা ভাবে এটা স্বাভাবিক। আমরা কেন খুদে কাঁধে এত বড় চাপ দিলাম? যাতে ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো বড় স্বপ্নটা।
এখন যা হচ্ছে মুস্তাফিজের সঙ্গে। আইপিএল-এ সুযোগ পাওয়া কি ক্রিকেটীয় সাফল্য নাকি নিছক বাণিজ্য? এটা ভারতের ঘরোয়া আসর। যেখানে চলে দুর্নীতি, ফিক্সিং আর ক্রিকেটার নষ্ট করার মহড়া। আইপিএল-এ সুযোগ পাওয়ার চেয়ে বিশ্বসেরা ওয়ানডে দলে মুস্তাফিজ সুযোগ পেয়েছে বরং এটা অহংকার করার মতো খবর।
খেলাকে খেলা হিসেবেই দেখেন দয়া করে। নিজেদের আবেগ এতে টানবেন না। বরং খেলোয়াড়দের আবেগকে গুরুত্ব দিন। সিদ্দিকুর প্রথম হলে নিউজ হবে কিন্তু না জিতলে করবেন না। তা কেন হবে? আরে গলফে লাল-সবুজ পতাকাটা তো তিনি উড়িয়েছেন। এ রকম অনেক খেলোয়াড় আছেন। আমাদের যারা দেশের বড় বিজ্ঞাপন। তাদেরকে তাদের মতো চলতে দেন। উৎসাহ দিতে হবে প্রত্যাশার চাপ নয়।
সেমিফাইনালে হেরে যাওয়ায় এখন সমালোচনা হচ্ছে, কেন টস জিতে বল না নিয়ে ব্যাট করলো মিরাজরা। কেন ক্যাচটা ফসকে গেলো? টিম ওয়ার্ক বোধহয় হয়নি। অথবা নানা চুলচেরা বিশ্লেষণ। হয়তো মিরাজদের এ হতাশা বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হবে। তোমরা পারলে না। কিন্তু মিরাজরা যেটা পেরেছে তা কি বলেছি। কি সুযোগ সুবিধা পায় আমাদের বয়স ভিত্তিক ক্রিকেট। কতটা দেখভাল করা হয়। অস্ট্রেলিয়া, ভারতে ক্রিকেটাররা যে সুবিধা পায় আমাদের ক্রিকেটাররা তার কতটা পায়? আমাদের দেশে ঘরোয়া লিগ শুরু করতে আন্দোলন করতে হয় ক্রিকেটারদের। এত কিছুর পরও মিরাজরা জ্বলে ওঠেন।
তবে যাই হোক একমাত্র লাল সবুজের দর্শকদের নিখাদ ভালবাসায় এগিয়ে যাচ্ছে টাইগাররা। গ্যালারির মানুষগুলোর নিঃস্বার্থ চিৎকারের চেয়ে বড় অনুপ্ররেণা আর কিছু হতে পারে না। বিশ্বকাপ ক্রিকেট কাভার করতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় দেখেছি প্রবাসী বাঙালিরা কিভাবে সমর্থন দিয়েছে মাশরাফিদের। যার প্রতিদানও দিয়েছে মাশরাফিরা। সামনে লাল-সবুজের কাণ্ডারি এই মিরাজ-শান্তরা। দয়া করে খেলোয়াড় হবার আগে তাদের তারকা বানাবেন না। আগে খেলোয়াড় হতে দিন। তারকা এমনি হয়ে থাকবে ১৬ কোটি মানুষের মনে। তাই যুব বিশ্বকাপ নিয়ে মিরাজদের প্রত্যাশার যে চাপ দিয়েছি তা তারা নিতে পারেনি। চূড়ান্ত লড়াইয়ে ভেঙে পড়েছে। আর যেন এমন না হয়। নিজেদের মতো করে খেলতে দিন। সাফল্য বা ব্যর্থতা দিয়ে নয়। ক্রিকেটারদের কিছু করে দেখানোর বাসনাটাকে গুরুত্ব দিই। এবার হয়নি তো কি হয়েছে। সামনে অনেক পথ। সাফল্য একদিন আসবেই। ততক্ষণ পর্যন্ত সমর্থন দিই, চাপ নয়। তাই মনের অজান্তে বলছি, মিরাজ তোমার ছোট্ট কাঁধে বড় প্রত্যাশার চাপ চাপিয়ে দেওয়ার জন্য ক্ষমা করো!
শান্তু বিশ্বাস: সাংবাদিক (Shetaz007@gamil.com)
বাংলাদেশ সময়: ১৮৫৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৬
এমজেএফ/