ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

শুনেছি মায়ের কম্পিত ঠোঁটে || মাহবুবুর রহমান মুন্না

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৬
শুনেছি মায়ের কম্পিত ঠোঁটে || মাহবুবুর রহমান মুন্না

একাত্তরে জন্মাইনি বলে পারিনি রুখে দাঁড়াতে, তবু পয়তাল্লিশ বছর পর আজও একাত্তর বয়ে চলেছে বুকে। একাত্তর না দেখলেও শুনেছি মায়ের কম্পিত ঠোঁটে।

তার কাছে শুনেছি পাকিস্তানি বাহিনীর জুলুম অত্যাচারের কাহিনী। বিশেষ করে আমাদের গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের উত্তর কুমারিয়া জোলার হিন্দু পরিবারের উপর যে অত্যাচার নির্যাতন হয়েছিলো। শুধু কি অত্যাচার নির্যাতন! ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে মালামাল লুটের লোমহর্ষক বর্ণনা। হায়েনাদের ভয়ে অনেক হিন্দু নারী আশ্রয় নিয়েছিলেন আমাদের বাড়ি। যাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সন্তানসম্ভবা। ভারত যাওয়ার আগে অনেক হিন্দু পরিবারের গহনা, টাকা-পয়সা জমা রেখেছিলো আমাদের কাছে। রাখবেই না কেন, আমাদের বাড়িতেই ছিলো মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প।

বাবার মুখে শুনেছি, পাঁচগাঁও বাজারে তার মামাতো ভাই তৎকালীন ওই এলাকার এমএসসি পাস। বিমানবাহিনীতে চাকরিরত মনিরুল ইসলাম মুকুল যুদ্ধে শহীদ হন। তার মরদেহও পায়নি পরিবার। প্রতি বছর মার্চ এলেই মা-বাবার মুখে শোনা সেই করুণ কাহিনী হৃদয়স্পন্দনে আঘাত হানে।

মার্চ মানেই ইতিহাস। বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসের এটি একদিকে যেমন একটি কালো অধ্যায়ের সূচনালগ্ন, অন্যদিকে পৈশাচিকতার মহোৎসব যা চলে ৯ মাস ধরে। পৈশাচিকতার এই সিঁড়ি বেয়ে সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে সূচিত হয় নতুন প্রতিজ্ঞার ইতিহাস, শুরু হয় মুক্তির জন্য যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতার রক্তের ঢেউ পেরিয়ে অভ্যুদয় ঘটে বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নসাধ ও আকাঙ্ক্ষার ফসল।

তাইতো অগ্নিঝরা মার্চ বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিসত্তায় ওতপ্রোতভাবে জড়ানো একটি মাস। এই মার্চ না এলে বাংলাদেশ নিজের স্বরূপে প্রস্ফুটিত হতে পারতো কি না কে জানে! বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনলবর্ষী ভাষণ, নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্থানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণ, স্বাধীনতা ঘোষণা ও বীর বাঙালির নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া- এসবই জাতি হিসেবে আমাদের গর্বের উপাদান।

কিন্তু এই গর্বিত জাতি এতোকিছুর পরও স্বাধীনতার পুরোপুরি সুখ অনুভব করতে পারছে না। রাজনীতি নামক কুইনাইনের ফাঁদে পড়ে স্বাধীনতার এতো বছর পরও বাংলাদেশ স্বাবলম্বী হতে পারলো না। বিভিন্ন সময় ক্ষমতায় আসীন হয়ে শাসকগোষ্ঠী দেশের চেয়ে, দেশের মানুষের চেয়ে নিজের অবস্থানকেই সর্বাগ্রে ঠাঁই দিয়েছে। জন্মের এতোগুলো বছর পরেও বাংলাদেশ তার নিজের একটি শক্ত রাজনৈতিক অবকাঠামো পেলো না। যা খুবই দুঃখজনক।

এখনও এদেশে পাকিস্তানি পেতাত্মারা চলন্ত গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারছে। পাশবিকতায় দানবের হিংস্র থাবায় ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে মানুষ, হরতালের নামে বারুদের উত্তাপে বাংলার মাটি হচ্ছে তামা। রাজনৈতিক দলের লেভেল লাগিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনষ্ট করছে। ধর্মের নামে রাজনীতি করে পকেট ভরছে। আরও কত কি? পেশাদারী রাজনীতির গণ্ডি পেরিয়ে কেউ কেউ তাদের ছায়া দিচ্ছে। তাদের জন্য মায়াকান্না কাঁদছে। এসব ভণ্ডামি নতুন প্রজন্মের হাতে ধরা পড়ে গেছে। তারা দেশ ও মানুষ পোড়ানোকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে। নতুন প্রজন্ম জেগে উঠছে, প্রতিবাদ করছে।

নতুন প্রজন্ম দেশের ভালো প্রত্যাশা করে, উন্নয়ন প্রত্যাশা করে, জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তা প্রত্যাশা করে। কোনো নাগরিকই যেন নিরাপত্তাহীনতায় না ভোগে, কোনো নাগরিককেই যেন খোলা আকাশের নিচে দাঁড়াতে না হয় পরিবারসহ - এ নিশ্চয়তা চায় নতুন প্রজন্ম।

দেশমাতার একজন সচেতন সন্তান হিসেবে সবার প্রত্যাশা এমনটিই হওয়া উচিত। সবার অনুভব করা উচিত এ মাটিতেই জন্ম আমাদের। বেড়ে ওঠাও এখানে। আর চিরবিদায়ের পর এ মাটিই হবে আমাদের অনন্তকালের বিছানা।

অফুরন্ত প্রাণশক্তি আর অনন্ত সম্ভাবনার উৎস তরুণ প্রজন্ম। জীবনের মহাআয়োজনে তাদের নতুন নতুন চিন্তা-ভাবনার অসাধারণ সম্মিলন। বায়ান্ন, একাত্তরে তরুণ প্রজন্ম যেমন দেশকে ভালোবেসেছে, তেমনি বর্তমান প্রজন্মও দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত।

অন্যায়-অবিচার, অসত্য আর অসুন্দরের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধে প্রকৃত অর্থে তরুণরাই পারে সব পিছুটানকে তুচ্ছ করে, জীবন-মরণ পণ করে ঝাঁপিয়ে পড়তে। এই প্রজন্মই একটি দেশ-জাতির সবচেয়ে সৃজনশীল, প্রাণপ্রাচুর্যপূর্ণ সম্পদ, আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রদীপ আর প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু। যারা আগামী দিনে স্বাধীন দেশের নেতৃত্ব দিয়ে সোনার বাংলা গড়বে।

লেখক: মাহবুবুর রহমান মুন্না
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, খুলনা ব্যুরো কার্যালয়, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৬
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।